৩ মে, ১৯৫৩। সিঙ্গাপুর থেকে দমদম বিমান বন্দরে এসে ভিড়েছে ব্রিটিশ ওভারসিজ এয়ার কর্পোরেশনের একটি বিমান। তখনও দমদম বন্দরের নাম নেতাজি সুভাষ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়নি। এই বিমান দমদম থেকে যাবে দিল্লি। দিল্লি থেকে সোজা লন্ডন। তখনকার বিমান কিন্তু খুব বেশি উপরে উঠতে পারত না। যেমন এই বিমানটি যাচ্ছিল মাত্র ১০ হাজার মিটার উপর দিয়ে। ট্রপোস্ফিয়ারের ঝড়-ঝঞ্ঝা-বৃষ্টিপাত, এসব তখনও বিমানকে কাবু করতে পারত। বিওএসির এই বিমানটির ছিল তেমনই দুর্ভাগ্য। দমদম থেকে আকাশে উড়তে না উড়তেই সামনে পড়ল কালবৈশাখী। বিমান আকাশেই টুকরো টুকরো হয়ে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। এমনকি মুর্শিদাবাদেও নাকি কিছু টুকরো পাওয়া গিয়েছিল। পরের দিনে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী নদিয়ার একটি গ্রামে আমবাগানের উপর ভাঙা বিমানের টুকরো পড়ে রীতিমতো অগ্নিকান্ডের সৃষ্টি হয়। ১৪ বছরের এক বালক তাতে রীতিমতো জখমও হয়। কিন্তু দমকল পৌঁছয় ২৪ ঘণ্টা পরে।
সে যাই হোক, খাতায় কলমে কিন্তু দুর্ঘটনায় মৃত বলতে শুধু যাত্রীদের নামই দেওয়া হয়েছিল। বাকিদের খোঁজ রাখেননি কেউই। আর সেই যাত্রীদের সংখ্যা মাত্র ১০। এবং তাঁরা প্রত্যেকেই ইউরোপীয়। বোঝা যায়, স্বাধীনতার প্রায় ৬ বছর পরেও কলকাতায় ইউরোপীয়ের সংখ্যা নেহাৎ কম ছিল না। মাঝেমধ্যে তাঁরা স্বদেশে পাড়ি দিতেন। আসলে কলকাতা আর লন্ডনের সম্পর্ক তো শুধু ঔপনিবেশিকতার ছিল না। আত্মীয়তারও ছিল।
লন্ডন থেকে কলকাতায় প্রথম বিমান এসে পৌঁছয় ১৯২২ সালে। মেজর ব্ল্যাক, ক্যাপ্টেন ম্যাকমিলান এবং ক্যাপ্টেন ম্যালিন যে বিমানে এসেছিলেন সেটি দমদমেই নিলামে বিক্রি করে দিয়ে চলে যান। ব্যবসায়িকভাবে এই যাত্রা শুরু হয় ১৯২৭ সালে ইম্পেরিয়াল এয়ারওয়েজের হাত ধরে। ১৯২৫ সালেই লন্ডন থেকে করাচি বিমান চলাচল শুরু হয়। ১৯২৭ সালে সেটি কলকাতা পর্যন্ত সম্প্রসারিত করা হয়। তবে সেটা পরীক্ষামূলকভাবে। স্থায়ী বিমান চলাচল শুরু হয় ১৯৩৩ সালে। রুটটা ছিল, লন্ডন থেকে করাচি, যোধপুর, দিল্লি, কানপুর, এলাহাবাদ, কলকাতা। কিছুদিনের মধ্যেই এই রুট সিঙ্গাপুর পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়।
তবে লন্ডন কলকাতা বিমান যোগাযোগ সবথেকে জোরালো হয় ১৯৪০ সালের পর থেকে। সৌজন্যে অবশ্যই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। তবে সেটা ব্যবসায়িক কারণে নয়। কিন্তু যুদ্ধ মিটে গেলে সামরিক যোগাযোগের এয়ারলাইনস গুলিকেই ব্যবহার করতে শুরু করে ব্রিটিশ ওভারসিজ এয়ার কর্পোরেশন। ইম্পেরিয়াল এয়ারওয়েজ স্বাধীনতার পরেই ব্যবসা গুটিয়েছে। বিওএসি পরে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের সঙ্গে এক হয়ে যাবে। এর মধ্যে ১৯৫৩ সালের দুর্ঘটনাটির মতো বেশ কিছু দুর্ঘটনাও ঘটেছিল। কিন্তু সাধারণ মানুষ বিমান চালিয়ে যাওয়ার পক্ষেই সওয়াল করেন। আকাশে ডানা মেলতে চাওয়ার স্বপ্ন যে বিমানের মাধ্যমেই বাস্তবায়িত হয়েছিল।
ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ দীর্ঘদিন কলকাতা-লন্ডন বিমান পরিষেবা চালু রেখেছিল। এমনকি এই রুটে কোম্পয়ানির আয় ছিল সবথেকে কম। কোম্পানির ম্যানেজমেন্ট বিভাগের পক্ষ থেকে রুট বাতিলের কথা বলা হয়েছিল বারবার। কিন্তু শীর্ষ কর্তৃপক্ষ সে কথা কানে তোলেননি। আসলে এটা শুধু ব্যবসা ছিল না। ছিল একটা ইতিহাসের বাস্তব মুর্তি। এমনকি যে পরিষেবা সপ্তাহে দুদিন চালু ছিল, ২০০৩ সালে সেটা সপ্তাহে ৩ দিন করা হয়। শুক্র ও শনিবারের পাশাপাশি বুধবারও কলকাতার আকাশ থেকে লন্ডনের দিকে যাত্রা শুরু করে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিমান। আর এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান তো ছিলই।
তবে কোনো এক অজ্ঞাত কারণে ২০০৮ সাল থেকেই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। প্রথমে এয়ার ইন্ডিয়া এবং পরে ২০০৯ সালে ব্রিটিশ এয়ারোয়েজ কলকাতা-লন্ডন এয়ার-রুট বন্ধ করে দেয়। কারণ হিসাবে বিমানপথের কিছু পরিকাঠামোগত পরিবর্তনের কথা বলা হলেও অনেকেই মনে করেছিলেন ব্যবসায় মুনাফার অভাবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল এই রুট। যদিও ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ বারবার আশ্বাস দিয়ে এসেছে, আবার চলবে কলকাতা-লন্ডন বিমান।
আরও পড়ুন
বিমানের মধ্যে করোনা সংক্রমণের সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে, জানাল জার্মান গবেষণা
সেই আশ্বাস অবশেষে সত্যি হতে চলেছে। সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখ থেকেই শুরু হতে চলেছে কলকাতা-লন্ডন বিমান পরিষেবা। ভারত সরকারের বন্দে-ভারত প্রকল্পের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে আবারও এই পরিষেবা চালু করছে ব্রিটিশ এয়ারওয়েজ। রাজ্য সরকারের তরফ থেকেই ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গিয়েছে এই প্রকল্পের বিষয়ে। স্বাভাবিকভাবেই কলকাতা শহরবাসীর মধ্যে এখন খুশির হাওয়া। আর সেই খুশির হাওয়ার মধ্যেও কি মিশে নেই এই রুটের বিমান চলাচলের দীর্ঘ ইতিহাস?
তথ্যসূত্রঃ কলিকাতা দর্পণ, রাধারমণ মিত্র
দ্য টেলিগ্রাফ
আরও পড়ুন
এগিয়ে এলেন খোদ প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীনতার পর ‘সরকারিকরণ’ হল দেশের সমস্ত বিমান সংস্থার
Powered by Froala Editor