কলকাতার প্রাচীনতম রাস্তার সঙ্গে জড়িয়ে বর্গি আক্রমণের ইতিহাস

সাল ১৭৪৪। পলাশি থেকে ২৯ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি স্থান মানকরা। সেখানে তাঁবু ফেলে বসে আছেন আলিবর্দি খাঁ। তিনি স্বয়ং মুর্শিদাবাদের নবাব, তাঁর তাঁবুটিও বেশ জাঁকজমকপূর্ণ। কিন্তু এর বাইরেও আরও বিশেষত্ব আছে। তিনি অপেক্ষা করছেন একজন বিশেষ মানুষের জন্য। তাঁর জন্যই এই তাঁবু তৈরি, এতসব আয়োজন। বিধাতা যেন হাতে করে লিখে দিচ্ছিলেন সমস্তটা। একটু রাত হতেই হাজির হলেন সেই বিশেষ মানুষটি। ভাস্কর পণ্ডিত; জাতিতে মারাঠা। ইতিমধ্যেই তাঁর সৈন্যরা বাংলায় আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। সেই মানুষটি আজ নবাবের খাস মেহমান। তাঁবুতে ঢুকলেন; কিন্তু বেরোতে পারলেন না। মুহূর্তে পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল নবাবের সশস্ত্র রক্ষীরা। এক কোপে ধড় আর মাথা আলাদা হয়ে গেল ভাস্কর পণ্ডিতের। আলিবর্দি খাঁ ভাবলেন, এবার শেষ হল বর্গিরা…

‘খোকা ঘুমল, পাড়া জুড়ল, বর্গি এল দেশে। 

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কীসে?’

বাংলার ঘুমপাড়ানি ছড়ার তালিকা বানালে এই লেখাটি আসবে না, তা কি হয়! সেই কবে থেকে মা-ঠাকুমাদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে এটি। আজকের এই আধুনিক সময়ও হারিয়ে যায়নি এই ছড়াটি। তবে স্রেফ ছড়া হিসেবে ধরলে সাংঘাতিক ভুলই হবে। এর আড়ালে রয়েছে বাংলার ইতিহাসের একটি কালো অধ্যায়। হ্যাঁ, বর্গি আক্রমণের কথাই হচ্ছে। যা বিচলিত করেছিল সেই সময়ের বাংলার সামগ্রিক পরিস্থিতিকে… 

কারা ছিল এই ‘বর্গি’? এক কথায় বললে, মারাঠা সৈন্যদের একটা ভাগ। এদের কাজই ছিল ভারতের বিভিন্ন জায়গায় হানা দিয়ে ‘চৌথ’ বা কর আদায় করা। আর না দিলেই লুঠতরাজ, আক্রমণ। একটা সময় মালিক অম্বরের নেতৃত্বে লড়াইয়ের কৌশল শিখে দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছিল এই বর্গিরা। মারাঠা পেশোয়াদেরও সমর্থন ছিল নিশ্চয়ই। অষ্টাদশ শতকে এই বর্গিদের দায়িত্ব নেন ভাস্কর কোলহটকর বা ভাস্কর পণ্ডিত। যিনি রঘুজি ভোঁসলের প্রধানমন্ত্রীও ছিলেন। তাঁরই নেতৃত্বে বাংলায় তাণ্ডব চালিয়েছিল এই বর্গিরা। হঠাৎ বাংলাকে আক্রমণ করার কারণ? 

তখন বাংলার নবাব পদে বসেছিলেন আলিবর্দি খাঁ। নবাব সুজা খাঁ-এর পুত্র সরফরাজ খাঁ-কে ছলনা করে পরাস্ত ও হত্যা করে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে বসেছিলেন। এই ঘটনাটাই মেনে নিতে পারলেন না সুজা খাঁয়ের জামাই রুস্তম জঙ্গ। তিনি এবং তাঁর নায়েব মীর হাবিব কটক থেকে আলিবর্দি খাঁয়ের উদ্দেশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। কিন্তু প্রবল শক্তিশালী আলিবর্দির বিরুদ্ধে সকল প্রতিরোধই বিফলে গেল। এরই সুযোগ নিল ভাস্কর পণ্ডিত। বিশাল বর্গি বাহিনি নিয়ে আক্রমণ করল বাংলা। উপলক্ষ্য, চৌথ সংগ্রহ। হয় টাকা দাও, নয়তো চোখের সামনে ধ্বংস দেখো। 

আরও পড়ুন
সারমেয়-র আক্রমণ থেকে বোনকে বাঁচিয়ে ‘হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন’ ৬ বছরের খুদে

আলিবর্দি খাঁয়ের বাহিনির সঙ্গে বেশ কয়েকবার যুদ্ধ হল বর্গিদের। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে নবাবের। শুধু তাই নয়, সেই সময় বর্গিরা যথেচ্ছ লুটপাট চালিয়েছিল। গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, যাকে সামনে পায় তাঁকেই হত্যা করে। এদিকে লুঠ করতে করতে তাঁরা পৌঁছে গেল মুর্শিদাবাদে। আলিবর্দি খাঁ তখন কাটোয়ায়। ফলে, মুর্শিদাবাদ অরক্ষিত হয়ে ছিল। সেই সুযোগে ব্যাপক লুঠ চালিয়ে গেল বর্গিরা। তবে এবার অন্য একটি বিপদ বর্গিদের সামনে এসে হাজির হয়েছিল— বাংলার বর্ষাকাল। এবারের মতো পিছু হটলেন ভাস্কর পণ্ডিত। কিন্তু পরে আবারও বাহিনি নিয়ে ফিরে এলেন। একটাই দাবি, দশ লাখ টাকার চৌথ। 

এদিকে মুর্শিদাবাদের অবস্থা দেখে কলকাতা রীতিমতো শঙ্কিত। বর্গিরা যদি শহরে একবার পৌঁছে যায়, তাহলে তো কেলেঙ্কারি। ইংরেজরাও চিন্তিত হয়ে পড়ল। ইতিমধ্যেই কলকাতার পূর্বে রয়েছে গঙ্গা। কাজেই সেই পথ দিয়ে বর্গিরা আসতে পারবে না। বাকি জায়গা অবরুদ্ধ করার জন্য ঠিক করা হল, শহরকে ঘিরে একটি খাল কাটা হবে। অষ্টাদশ শতকে কলকাতার পরিসীমা আজকের মতো ছিল না। ইংরেজদের এই পরিকল্পনায় সায় দিলেন আলিবর্দি। তাঁরও তখন প্রধান চিন্তা বর্গি ও ভাস্কর পণ্ডিত। নবাবের অনুমতি পেয়েই শুরু হল খাল কাটা। কলকাতাকে কেন্দ্র করে অর্ধবৃত্তাকার পথে কাটা হল এই খাল। মারাঠা বর্গিদের জন্য কাটা খাল বা ডিচ— সেখান থেকেই নাম হল মারাঠা ডিচ বা মারহাট্টা ডিচ। সেইসঙ্গে বসল কামান। তৈরি হল সেনা। কোনোভাবে বর্গিরা ঢুকলে যাতে প্রতিহত করা যায়। 

সৌভাগ্যক্রমে, কলকাতা বর্গি আক্রমণ থেকে রেহাই পেয়েছিল। কিন্তু আলিবর্দি খাঁ তখনও চিন্তায়। যুদ্ধে এঁদের সঙ্গে কিছুতেই পারা যাচ্ছে না। তবে কৌশলেই হারাতে হবে। নিশানা স্থির হল ভাস্কর পণ্ডিতের দিকে। ১৭৪৪ সালে মানকরায় খাটানো হল তাঁবু। উদ্দেশ্য, ভাস্কর পণ্ডিতের হত্যা। নবাবের পাতা ফাঁদে পা-ও দিয়েছিলেন ভাস্কর পণ্ডিত। যার ফলাফল কাহিনির প্রথমেই বলা হয়েছে। 

আরও পড়ুন
সিরাজের ভয়েই লুকনো অজস্র ধনসম্পদ! মুর্শিদাবাদের প্রাসাদ ও মুখে রক্ত ওঠার ‘গল্প’

আলিবর্দি ভেবেছিলেন, বর্গিরা শেষ পর্যন্ত পরাজিত হয়ে পালিয়েছে। কিন্তু তিনি ভুল ছিলেন। এরপরও নানা সময় বর্গিরা বাংলা আক্রমণ করে। টানা দশ বছর বর্গিরা ত্রাস হয়ে থাকে বাংলায়। শেষ পর্যন্ত ১৭৫১ সালে চুক্তিতে যেতে রাজি হন আলিবর্দি খাঁ। চুক্তি অনুযায়ী, মারাঠাদের উড়িষ্যার অধিকার ছেড়ে দেন। অবশেষে বন্ধ হল বর্গি আক্রমণ। সেই সময়ের স্মৃতি কি আজও টিকে আছে? ছড়াটা তো আছেই; তাছাড়াও মুর্শিদাবাদে মারাঠাদের তৈরি শিবমন্দিরও আছে। ভাস্কর পণ্ডিত নিজে দুর্গাপূজা চালু করেছিলেন। আর মারাঠা ডিচ? সেসব এখন অতীত। সেই খাল বুজিয়েই পরবর্তীকালে তৈরি হয়েছে লোয়ার আর আপার সার্কুলার রোড। ম্যাপে দেখলে ঠিক যেন অর্ধবৃত্তাকার পথের মতোই লাগে। কলকাতার প্রাচীনতম পথ সেটিই। ইতিহাস এভাবেই তৈরি করে চালচিত্র; যার হাত ধরে এক একটা স্লাইড ভেসে আসে চোখের সামনে।

তথ্যসূত্র-
কলকাতা বিচিত্রা/ রাধারমণ রায়

Powered by Froala Editor

More From Author See More

Latest News See More