শ্রমজীবী মহিলাদের সাম্যের লড়াই দিয়ে শুরু, ১৯০৯ সালে পালিত হয়েছিল বিশ্বের প্রথম নারী দিবস

‘লিঙ্গসাম্যই আগামীর মূলমন্ত্র’। 

আজ নারী দিবস। প্রতি বছর ৮ মার্চ তারিখটি ‘আন্তর্জাতিক নারী দিবস’ (International Women's Day) হিসাবে পালিত হয় গোটা বিশ্বজুড়ে। আর এ-বছর শুরু প্রতিপাদ্যটিকেই সামনে রেখে নারী দিবস উদযাপন করছে জাতিসংঘ। কিন্তু একুশ শতকের দাঁড়িয়েও কি সম্পূর্ণভাবে লিঙ্গ বৈষম্যকে হারাতে পেরেছি আমরা? বিশেষত ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সমাজে পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে বৈষম্যের জটিল সমীকরণ। তবে আশার কথা এই যে, ক্রমশ বাড়ছে নাগরিকদের সচেতনতা। লড়াইয়ে সামিল হচ্ছেন বহু বহু মানুষ।

তবে এই লড়াই আজকের নয়। আজ থেকে প্রায় এক শতক আগে বৈষম্যের বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের পথে নেমেছিলেন শ্রমজীবী মহিলারা। নারী দিবসের জন্ম সেই আন্দোলন থেকেই। সে-গল্পেই ফেরা যাক বরং। 

বিশ শতকের শুরুর দিক সেটা। ১৯০৮ সাল। তারিখটা ছিল ২৮ ফেব্রুয়ারি। সেদিন এক অভিনব পদযাত্রার সাক্ষী হয়েছিল নিউ ইয়র্ক শহর। রাস্তায় নেমেছিলেন প্রায় ১৫ হাজার মহিলা। শ্বেতাঙ্গদের পাশপাশি সেদিন মিছিলে সামিল হতে দেখা গিয়েছিল কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের মহিলাদেরও। কিন্তু এই আন্দোলনের কারণ কী? 

আরও পড়ুন
ভেনেজুয়েলার হারাতে-বসা অরণ্যকে বাঁচাচ্ছেন উপজাতি মহিলারা

মূলত, সেদিনের আন্দোলনকারীরা সকলেই ছিলেন কোনো না কোনো মার্কিন বস্ত্র উৎপাদনকারী কারখানার শ্রমিক। ভারতে সেসময় কল-কারখানায় মহিলাদের শ্রমিকদের অস্তিত্ব ছিল এক প্রকার কল্পনাতীত। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে এর প্রায় কয়েক যুগ আগে থেকেই দেখা গিয়েছিল মহিলা শ্রমিকদের আধিক্য। হ্যাঁ, আধিক্যই। কেননা, মহিলা শ্রমিকদের দিয়ে কাজ করানো তুলনামূলকভাবে বেশি লাভজনক ছিল সেসময়ের কর্মসংস্থানগুলির কাছে। পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় অনেকটাই অল্প বেতনে সমপরিমাণ কাজ করিয়ে নেওয়া হত তাঁদের দিয়ে। এই ‘শোষণ’-এর প্রতিবাদেই স্বতঃস্ফূর্তভাবে পথে নেমেছিলেন মার্কিন মহিলারা। বেতনসাম্য তো বটেই পাশাপাশি তাঁদের দাবিদাওয়ার তালিকায় ছিল সুনির্দিষ্ট কর্মসময় ও ভোটাধিকার।

আরও পড়ুন
কাশ্মিরের প্রথম মহিলা হুইলচেয়ার বাস্কেটবল খেলোয়াড়, স্বপ্ন দেখাচ্ছেন বাসির

১৯০৯ সালে ২৮ ফেব্রুয়ারি দিনটিকেই ‘নারী দিবস’-এর আখ্যা দেয় আমেরিকার সোসালিস্ট পার্টি। সেটিই ছিল বিশ্বের প্রথম নারী দিবস। যদিও দেখতে গেলে এই আন্দোলন সাফল্যে পায় আরও বছর দশেক বাদে। ১৯১৯ সালে। ৪ জুন আমেরিকার জাতীয় কংগ্রেস পাস করে মহিলাদের ভোটাধিকার বিল। 

আরও পড়ুন
চাকরি ছেড়ে শিশু ও মহিলাদের জন্য লড়ছেন সাংবাদিকা


যাই হোক, আবার ফিরে আস যাক নারী দিবস প্রসঙ্গে। ১৯০৯ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ‘নারী দিবস’ পালিত হলেও, আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি তো নয়ই সেদিন প্রশাসনিক স্বীকৃতিও পায়নি সেটি। আন্তর্জাতিকভাবে নারী দিবসের সূত্রপাত হয় তার ঠিক পরের বছর। ১৯১০ সালে। নেপথ্যে ছিলেন ডেনমার্কের এক মহিলা— ক্লারা জেটকিন। ডেনমার্কে আয়োজিত আন্তর্জাতিক মহিলাকর্মীদের সম্মেলনে তিনিই প্রথম প্রস্তাব দেন ‘আন্তর্জাতিক মহিলা দিবস’-এর। ইউরোপের অধিকাংশ উন্নত দেশের প্রতিনিধিরাও উপস্থিত ছিলেন সেই সম্মেলনে। জেটকিনের এই আবেদনে সায় দেন তাঁরাও। শেষ পর্যন্ত কোপেনহেগেন প্রশাসনের সরকারি উদ্যোগে ১৯ মার্চ দিনটি অস্ট্রিয়া, ডেনমার্ক, সুইজারল্যান্ড, জার্মানি, ফ্রান্স-সহ একাধিক দেশে পালিত হয় আন্তর্জাতিক নারী দিবস। 

উল্লেখ্য, এই সবটাই ছিল কর্মক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্যের বিরুদ্ধে। তবে বছর কয়েকের মধ্যেই বদলে যায় প্রেক্ষাপট। ইউরোপজুড়ে বেজে ওঠে বিশ্বযুদ্ধের দামামা। ১৯১৩ সাল সেটা। দ্বিবিভক্ত হয়ে যায় ইউরোপীয় শক্তিগুলি। লক্ষ লক্ষ পুরুষ তাঁদের চিরাচরিত কর্মক্ষেত্র ছেড়ে হাজির হন যুদ্ধক্ষেত্রে। আর সেই শূন্যস্থান পূরণের দায়িত্ব অনেকটাই যেন চাপিয়ে দেওয়া হয় মহিলাদের ওপর। এই ঘটনার প্রতিবাদে প্রথম সরব হন রাশিয়ার মহিলারা। ১৯১৪ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ‘রুটি ও শান্তি’-র দাবিতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করেই বিশ্বযুদ্ধের প্রতিবাদ করেন তাঁরা। তার ঠিক কয়েকদিন পরেই ৮ মার্চ একই ধরনের আন্দোলনে সামিল হন ইউরোপীয় মহিলারাও। 

এই বিশেষ দিনটির ঐতিহাসিক গুরুত্বকে সম্মান জানিয়েই ১৯৭৫ সালে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক নারী দিবসের তকমা দেয় ৮ মার্চকে। তার আগে পর্যন্ত নারী দিবস কেবলমাত্র আবদ্ধ ছিল ইউরোপ এবং আমেরিকার গণ্ডিতে। জাতিসংঘের উদ্যোগের পর আনুষ্ঠানিকভাবে গোটা বিশ্বজুড়ে শুরু হয় নারী দিবস পালন। ধীরে ধীরে শুরু হয় নারী উন্নয়নের জন্য একাধিক বিশেষ প্রকল্প। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের তত্ত্বাবধানে দেশে দেশে আয়োজিত হতে থাকে একের পর এক সচেতনতামূলক প্রচারানুষ্ঠান। যা স্বমহিমায় চলছে আজও। কিন্তু বৈষম্য কি মুছেছে আমাদের সমাজ থেকে?

না। জাতিসংঘের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের খাদ্য উৎপাদনে ৮০ শতাংশ ভূমিকাই নারীদের। অথচ, তাঁদের হাতে রয়েছে কেবলমাত্র ১০ শতাংশ কৃষিজমির মালিকানা। শুধু খাদ্য উৎপাদনই নয়, সমস্তক্ষেত্রেই রয়েছে এই সুস্পষ্ট বিভেদ। কেবলমাত্র নারী দিবস পালন নয়, বরং সমাজের মানসিকতার বদল এলেই একমাত্র তৈরি হতে পারে বৈষম্যহীন সমাজ…

Powered by Froala Editor