সেবারও একইভাবে এসেছিল বড়োদিন। যিশুর জন্মদিনের উৎসবে মেতে উঠেছল সারা পৃথিবী। কিন্তু আমেরিকা যেন তখনও উৎসবের আনন্দে গা ভাসিয়ে দিতে পারেনি। মাত্র কিছু সপ্তাহ আগেই ঘটে গিয়েছে পার্ল-হারবারের কুখ্যাত বিস্ফোরণ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতা ইউরোপ আফ্রিকা ছাড়িয়ে আমেরিকাতেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। প্রত্যেকের মনের মধ্যেই জমছে আতঙ্ক। আর ঠিক এমনই বড়োদিনের সন্ধ্যায় ‘ন্যাশানাল ব্রডকাস্টিং কোম্পানি’-র ‘দ্য ক্রাফট মিউজিক হল’ অনুষ্ঠানে বেজে উঠল একটি গান। বড়োদিনের গান। ‘হোয়াইট ক্রিসমাস’। আর্ভিং বার্লিনের কথায়, সুরে গান ধরলেন শিল্পী বিং ক্রসবি।
১৯৪১ সালের সেই বড়োদিনের বেতার অনুষ্ঠান থেকেই জন্ম নিয়েছিল একটি ইতিহাস। বিং ক্রসবি নিজেও ভাবতে পারেননি, তিনি এমন একটা গান গাইতে চলেছেন যা আগামী বেশ কয়েক দশক ধরে রেকর্ড হয়ে থাকবে। আর এই ২০২০ সালে প্রায় ৮০ বছর পেরিয়ে এসেই এখনও সেই রেকর্ড অক্ষত। গানের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রি হওয়া সিঙ্গেল কপি বিং ক্রসবির গলায় ‘হোয়াইট ক্রিসমাস’। শুধু এই একটি গানের রেকর্ডিং বিক্রি হয়েছে ৫০ মিলিয়ন কপি। আর গিনেস বুকের রেকর্ড অনুযায়ী সমস্ত অ্যালবাম মিলিয়ে গানটি বিক্রি হয়েছে ১০০ মিলিয়ন।
অবশ্য প্রথমেই তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি ‘হোয়াইট ক্রিসমাস’। ১৯৪২ সালের মিউজিক্যাল ফিল্ম ‘হলিডে ইন’-এও ব্যবহার করা হয় গানটি। সেবছর গানটি অস্কার পুরস্কারও পায়। কিন্তু তখনও তেমন জনপ্রিয়তা পায়নি। আসলে যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধই গানটিকে জনপ্রিয় করে গিয়েছে। ১৯৪২ সালের জুন মাস নাগাদ আমেরিকা সমস্ত প্রস্তুতি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে যুদ্ধে। একে একে বহু মানুষকে পাঠানো হয় যুদ্ধক্ষেত্রে। আর চলে যাওয়ার মুহূর্তে যেন ফেলে যাওয়া জীবনের সুন্দর দৃশ্যগুলোকেই আঁকড়ে ধরতে চাইল মানুষ। অনেকেই অবশ্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর ফিরে আসেননি। কিন্তু শেষ মুহূর্তেও নিজের দেশের কথা মনে করিয়ে দিয়েছিল এই বড়োদিনের গানটি। উৎসবের মধ্যেই যে জীবনকে খুঁজে পাওয়া যায়। একটানা ১১ সপ্তাহ ধরে সবচেয়ে জনপ্রিয় গানের মর্যাদা পেয়েছিল ‘হোয়াইট ক্রিসমাস’।
বড়োদিনের গান হলেও এর মধ্যে কোনো ধরণের ধর্মীয় প্রভাব নেই। আছে শুধু প্রকৃতির আহ্বান। আজ থেকে ৮০ বছর আগে এমন একটা গান হয়তো অনেকেই কল্পনা করতে পারতেন না। আর সেই গানের জন্ম দিয়েছেন আমেরিকা প্রবাসী ইহুদি গীতিকার সুরকার আর্ভিং বার্লিন। আসলে গানটির মধ্যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতাকেই হয়তো স্পর্শ করতে চেয়েছিলেন তিনি। পরবর্তীকালে নানা শিল্পী গানটিকে নিজের মতো করে পরিবেশন করেছেন। তবু আজও ‘হোয়াইট ক্রিসমাস’ বললেই মনে আসে বিং ক্রসবির গলা। ৮ দশক পেরিয়ে এসেও সত্যিই অনবদ্য সেই রেকর্ডিং।
Powered by Froala Editor