এই শহর কলকাতারই এককোণে রয়েছে এক আশ্চর্য রাস্তা। নাম শুনলেই গা ছমছম করে ওঠে বইকি! ‘গুমঘর লেন’। হারিয়ে গিয়েছে এর অতীত কথার অনেকগুলো পাতা। কিন্তু গুমঘর গলির শুরুটা যখন দানা বাঁধছে, অষ্টাদশ শতকের কলকাতা তখন সাক্ষাৎ যমপুরী। লিখছেন শ্রীপান্থ তাঁর 'ডাক্তার-বদ্যি' শীর্ষক মনোজ্ঞ কলামে- “লোক আসে আর মরে। মরে, তবুও আসে।… দিব্যি সুস্থ-সমর্থ জোয়ান ছেলে সন্ধ্যায় নেমেছে চাঁদপাল ঘাটে। রাত্তিরটাও কাটল না। ভোরবেলাতেই দেখা গেল কলকাতার অ্যাডভেঞ্চারে দাঁড়ি পড়ে গেছে তার।… লোক মরত। এখনও মরে, তখনও মরত। সাহেব-নেটিভ নির্বিশেষেই মরত।" এই নেটিভ শব্দটাই গুমঘর গলির দিকে এগোনোর প্রথম ক্লু। এখন যেমন নেটিজেনরা কোয়ারেন্টাইন, সেই সময়েও গুমঘর গলি নেটিভদের একঘরে রাখার একমাত্র ঠিকানা।
কী নেটিভ, কী নেটিজেন - চিকিৎসা ব্যবস্থা দুই সময়েই খরচের খাতে। এখন যেমন উপযুক্ত পরিকাঠামোর অভাবের মধ্যেও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন ডাক্তার-নার্সরা, অষ্টাদশ শতকের কলকাতায়, বিশেষ করে ব্ল্যাক টাউনেও চিকিৎসা বলতে তেমন কিছু ছিল না। অথবা ছিল কবরেজি, হেকিমি, ঝাড়-ফুঁক, তাবিজ-কবচ। ঠাকুর যেমন, নৈবেদ্যও তেমনই, ওষুধ বলতে দৈব বা স্বপ্নাদ্য, ভালুকের লোম, সাপের চোখ, ধনঞ্জয় পাখির ঠোঁট। এ সব নিয়ে এ বার কালো চামড়ার সমস্যা থাকুক আর না-ই থাকুক, সমালোচনায়-সমস্যায় পড়লেন তাঁদের সাদা মালিকরা। নেটিভ যদি মরে, খিদমত খাটবে কে? অবশ্য সহৃদয়তার দিকটাও একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভালো-মন্দ সমাজে দুই থাকে। তাই প্রস্তাব উঠল ১৭৯২ সালে - ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানির ভারতীয় কর্মীদের জন্য হাসপাতাল তৈরি হোক, আলাদা ভাবে। এক টেবিলে যেমন সাদা আর কালো চামড়া বসে না, তেমনই একই হাসপাতালের বিছানাতেই বা শুয়ে থাকে কেমনে?
যাই হোক, তা নিয়েও বিস্তর জলঘোলা। না হলে কলুটোলায় হাসপাতাল তুলতে আরও বছর দুই লাগে?
দেখা গেল, এর পরের বছরগুলোয় এক ঠিকানা থেকে অন্য ঠিকানায় হারিয়ে যাওয়া, গুম হয়ে যাওয়াই নেটিভ হসপিটাল-এর নিয়তি। কারণ স্বাস্থ্যসম্মত খোলামেলা জায়গার অভাব। তাই কলুটোলায় চার বছর চিকিৎসা চলার পর ১৭৯৬ সালে হাসপাতাল উঠে এল ধর্মতলায়। এখনকার হিসেবে বললে চাঁদনি চকে। আর এই সময়েই শহর পেল তার গুমঘর গলি। সেই সময়ে যে বাড়িতে চলত হাসপাতালের কাজকর্ম, তার উত্তর দিকেই ছিল এই গলি। বলা হয়, এই গলির এক বাড়িতেই না কি আলাদা করে রাখা হত ছোঁয়াচে অসুখের রোগীদের। মূল হাসপাতাল বাড়ি থেকে গুম হয়ে যাওয়া, অসুখ না সারলে জীবন থেকেও - সেই জন্যই কি লোকের মুখে মুখে গলির নাম হয়ে গেল গুমঘর?
সেটা স্পষ্ট ভাবে জানা যায় না। ঠিক যেমন জানা যায় না গলির কত নম্বর বাড়িতে এই কোয়ারেন্টাইন ওয়ার্ড ছিল, সে কথাও। সন-তারিখের হিসেব শুধু বলছে, একটানা ৭৮ বছর ধরে গুমঘর লেন-এ চলেছে ছোঁয়াচে অসুখের চিকিৎসা। তারপর?
একটা টুকরো খবর মেলে ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট-এর ১৯১৯ সালের মে মাসের সংখ্যায়। সেই খবর জানিয়ে দিয়েছে, শুধু ঠিকানাই নয়, ধর্মতলার পর নেটিভ হাসপাতালের নামটাও বদলিয়েছে, হয়েছে মেয়ো নেটিভ হসপিটাল। ধর্মতলা থেকে সে গিয়েছে গঙ্গার ঘাটে, স্ট্রান্ড রোডে। উদ্যোক্তা হাসপাতালের প্রায় সর্বেসর্বা সার্জিয়ন-মেজর এন সি ম্যাকনামারা। ধর্মতলার কিছু মানুষ এবং উপরতলার অফিসারদের আপত্তি সত্ত্বেও এক সকালে তিনি ম্যাকিনটশ বার্নের দলবল নিয়ে হাজির হলেন গঙ্গার ঘাটে, আবর্জনা সরিয়ে বের করে নিলেন হাসপাতাল স্থানান্তরিত করার জমি। ১৮৭৩-এ লর্ড নর্থব্রুক প্রথম ইটখানা গেঁথেও দিলেন জমিতে, চলতে থাকল টাকা তোলার কাজ। একা মেয়ো মেমোরিয়াল কমিটি-ই দিল ৫০,০০০ টাকা; শর্ত এই হাসপাতালের নামের আগে মেয়ো জুড়তে হবে। কে জানে কেন, একদিন বন্ধ হয়ে গেল স্ট্রান্ড রোডের হাসপাতালও।
থেকে গেল শুধু গুমঘর লেন। পুরসভার গেজেটে, বেঙ্গল আগ্রা ডিরেক্টরি আর শহরবাসীর মুখে। লকডাউন উঠে গেলে একবার চাঁদনি চকে সাবির রেস্তোরাঁর ঠিক উল্টোদিকের গলিটা দিয়ে হেঁটে আসবেন না কি? না কি বর্তমান ছোঁয়াচে অসুখ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে অতীতের ছোঁয়ায় না যাওয়াটাই ঠিক হবে?
তথ্যসূত্র: ডাক্তার-বদ্যি/শ্রীপান্থ
ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল গেজেট, ১৯১৯
Powered by Froala Editor