গাঁজা টানার ক্ষমতা অনুযায়ী দেওয়া হত নাম, পুরনো কলকাতার গঞ্জিকা সেবনের ইতিহাস এমনই

অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকের কথা। কলকাতা তখন ছিল পাখিদের অধীনে। যে সে পাখি না, মানুষ পাখি। তাঁরা গান গাইত, পাখির ভাষায় কথা বলত এমনকি ডানা মেলে আকাশেও উড়ত, কিন্তু এমনিতে না, ছিলিম ছিলিম গাঁজা টানার পর। 

কলকাতার যুবকরা বেশ্যাসক্ত ছিলেন কিন্তু মদ্যপান করতেন না। তাঁদের নেশা ছিল মূলত গাঁজার। শিবনাথ শাস্ত্রী জানাচ্ছেন, সেইযুগে কলকাতায় তিনটে গাঁজার আড্ডা বিখ্যাত ছিল - বাগবাজার, বটতলা আর বউবাজার। বাগবাজারের পক্ষীদলের সৃষ্টি করেছিলেন রাজা নবকৃষ্ণর ইয়ার শিবচন্দ্র ঠাকুর। তবে এর উত্থান আর এক শিবচন্দ্রের হাত ধরে। ধনী দেওয়ান দুর্গাচরণ মুখুজ্জের (যার নামে বাগবাজারে রাস্তাও আছে) ছেলে শিবচাঁদ মুখুজ্জে। এখানেই গাঁজা টানার পারদর্শিতার উপরে এক একজন এক এক পাখির নাম পেতেন আর সারাজীবন ধরে সেই পাখির হাবভাব আচার আচরণ অনুকরণ করে যেতেন। ঈশ্বর গুপ্ত লিখছেন ‘এই পক্ষীদলের পক্ষী সকলেই ভদ্রসন্তান ও বাবু এবং শৌখিন নামধারী সুখী ছিলেন। পাখির দলেরা নিধুবাবুকে কর্তা বলিয়া অত্যন্ত মান্য করিত।’ এই নিধুবাবু ছিলেন টপ্পাখ্যাত রামনিধি গুপ্ত। রামনারায়ণ মিশ্র এই দলের প্রতিষ্ঠা আর ব্যায়নির্বাহ করলেও ‘নিধুবাবু রাজার উপর মহারাজা ছিলেন।’

শোভাবাজারে এই পাখিদের একটা বিখ্যাত আটচালা ছিল। প্রতিদিন রাতে সেখানে গাঁজার আসর আর গানের চর্চা হত। নিধুবাবু নিজেই গান গেয়ে লোক মাতাতেন। কিন্তু তাঁরা চলতেন নিজের মর্জিতে। একবারের গল্প বলি। মহারাজ গোপীমোহন দেবের ইচ্ছে এই পক্ষীদলের রগড় দেখবেন। অনেক অনুরোধের পরে পক্ষীরা বললেন ‘যাব, তবে খাঁচা পাঠাতে হবে।’ পালকি নামের খাঁচা এল। পাখিরা নিজের নাম অনুযায়ী সেজেগুজে পালকি চেপে রাজবাড়ি গেলেন। রাজা তাঁদের সম্মান দিয়ে পেটপুরে আহার করালেন, তাঁরাও পাখিদের মত কিচমিচ, ঘুরুৎ ঘুরুৎ শব্দ করে খেয়েই আবার খাচায় ঢুকে গেলেন। রাজা তাঁদের অনুষ্ঠান শুরু করতে বলতেই সব পাখি একজোটে ‘চুকু মুক চুক, চুকু চুকুন’ করে উঠল। তাঁদের কলকাকলি থেকে রাজা উদ্ধার করতে পারলেন আহারের পর তাঁদের বিশ্রাম দরকার। রাজা আহার না দিলে তাঁরা নিশ্চিত রগড় দেখাতেন এখন আর সম্ভব না। তাঁরা আটচালায় ফিরে যাবেন। আদেশ অনুরোধ ভয় দেখানো কিছুতেই কিছু হল না।

আর একটা গল্প বলা যাক। প্রখ্যাত পাঁচালীকার গঙ্গানারায়ণ নস্কর এসেছেন আটচালায় পাখিদের কাণ্ড দেখতে। দ্বাররক্ষক পাখি জিজ্ঞেস করল ‘তুমি কে? কার সঙ্গে দেখা করবে?” তিনি নাম বলে বললেন রাজার সঙ্গে দেখা করব। এই রাজা খুব সম্ভব নিধুবাবু। রক্ষী গিয়ে বলল ‘কে এক নস্কর এসেছে।’ রাজার মৌতাত তুঙ্গে। তিনি বললেন ‘এ কি মানুষ না জন্তু?” প্রহরী জানালো ‘হিন্দু মানুষ এবং সূত্রধর।’ শুনেই প্রধান অমাত্য চেঁচিয়ে বললেন -

আরও পড়ুন
কলকাতার ‘দেবতা’ হয়ে উঠেছিলেন এই চিনা ব্যক্তি, টেরিটিবাজারে আজও রয়েছে মন্দির

‘কস্কর, খস্কর, গস্কর, ঘস্কর, ঙস্কর

আরও পড়ুন
হেস্টিংসের সঙ্গে কলকাতায় এল পিয়ানো, ভারতচন্দ্রের গানে সুর তুললেন রুশ সাহেব

মহারাজ, কয়ের কোটায় পাওয়া গেল না।’

আরও পড়ুন
কলকাতার নাম বদলে হল ‘আলিনগর’, ইংরেজদের শহর থেকে তাড়িয়ে ছাড়লেন সিরাজ

এইভাবে সব কটা বর্ণ বলে শেষে সিদ্ধান্ত হল ‘যাবে কোথায় ব্যাটা? তস্করের ঘরেই নস্করের বাস।’ ব্যস! আর যায় কোথায়? পাখির দল রে রে করে তেড়ে এল। নস্কর মশাই এতটা আশা করেননি। কেউ তাঁকে ঠুকরে দিল, কেউ কানের সামনে ক্যাঁ ক্যাঁ করে চিৎকার করতে লাগল আর গঙ্গানারায়ণ ‘অম্বলচাকা ভোম্বলদাসের ন্যায় ফ্যা ফ্যা করিতে করিতে অমনি ছুটে প্রস্থান করিলেন।’

তবে পাখি হওয়া বড় সহজ কাজ ছিল না। গাঁজা টানার ক্ষমতা লাগত। পাখি হওয়ার উদ্দেশ্যে কেউ আটচালায় এলে প্রথমে তাঁকে এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিতে হত। পরীক্ষা নিতেন স্বয়ং পক্ষীরাজ। তাতে টানা ছিলিমের পর ছিলিম গাঁজা খেতে হত। একবারও না কেশে। পক্ষী অনেক থাকলেও পক্ষীরাজ ছিলেন মাত্র দেড়জন। যে সব মহাপুরুষ একাসনে বসে একশো আট ছিলিম গাঁজা খেতে পারত, তারা একটা করে ইট পেত। এই ইট জমিয়ে যিনি গোটা বাড়ি বানাতে পারতেন, তিনিই পক্ষীরাজ। কলকাতায় দেড়জন পক্ষীরাজের একজন ছিলেন পটলডাঙার রূপচাঁদ পক্ষী আর বাগবাজারের নিতাই হাফ পক্ষী। বেচারা বাড়ির চার দেওয়াল বানানোর পরেই মারা যান। ফুল পক্ষী হয়ে ওঠা তাঁর হয়নি।

রূপচাঁদ পক্ষী ছিলেন পক্ষীকুলের সেরা। সঙ্গীতের কথায় ও সুরে মাতিয়ে রাখতেন সবাইকে। একদিকে ভক্তিরস আর অন্যদিকে হাসির গানে তাঁর জুড়ি ছিল না। নিধুবাবু নিজে রূপচাঁদের গুণগ্রাহী ছিলেন। তখন নব্য আলোকপ্রাপ্ত ইংলিশ বুলি বলা উচ্চশিক্ষিতকে নিয়ে তিনি গান বাঁধেন -

‘লেট মি গো, ওরে দ্বারী

আই ভিজিট টু বংশীধারী

এসেছি ব্রজ হতে আমি ব্রজের ব্রজনারী।’

আবার উমা-মেনকা সংবাদ কথন বা আগমনী গানে তিনিই আবার লেখেন-

‘গো মেনকা! অম্বিকা হের আসিয়ে।

একবার নয়ন প্রকাশিয়ে,

গগনের শশী আসি উদয় তবালয়ে।’

তবুও পাখিরা হারিয়ে গেলেন কলকাতা থেকে। উনিশ শতকের মাঝামাঝি দেখতে পাই তাঁরা আর নেই। হুতোম তাঁর নকশায় লিখছেন ‘ এখন আর পক্ষীর দল নাই… পাখিরা বুড়ো হয়ে মরে গেছেন, দু একটা আদমরা বুড়ো গোছের পক্ষী এখনও দেখা যায়, দল ভাঙা, টাকার খাঁকতিতে মন মরা হয়ে পরেচে। আড্ডাটি মিউনিসিপাল কমিসনরেরা উঠিয়ে দেছেন অ্যাখন কেবল তার রুইনমাত্র পড়ে আছে।’ এই ‘মনিমেন্টের মত রুইনখানি’ বাংলার পাখি সংস্কৃতির শেষ চিহ্ন হিসেবে আরও কিছুদিন টিঁকে ছিল। তারপর অন্য অনেক কিছুর মতোই হারিয়ে গেল চিরতরে…

Powered by Froala Editor