সময়টা ১৯৬৯। পরের বছরের মেক্সিকো ফুটবল বিশ্বকাপের যোগ্যতা নির্ধারণের ম্যাচ চলছে এল সালভাদোর (El Salvador) আর হন্ডুরাসের (Honduras) মধ্যে। ফুটবল বিশ্বে তো বটেই, ‘কনকাকাফ’ বা উত্তর আমেরিকার ফুটবল বৃত্তেও নিতান্তই বামন দুটি দেশ। তবুও প্রথমবার বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করতে মরিয়া দুজনেই। টানটান উত্তেজনার মধ্যে নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত মিনিটের গোলে ৩-২ ব্যবধানে ম্যাচ জিতে নেয় এল সালভাদোর। এতটা পর্যন্ত ঠিকই আছে। বিশ্বফুটবলে এরকম উত্তেজনাপূর্ণ ম্যাচ তো আকছার ঘটেই চলেছে। কিন্তু কে জানত এই ম্যাচের ১৪ দিনের মাথায় এল সালভাদোর আর হন্ডুরাসের মধ্যে শুরু হবে এক ভয়ানক যুদ্ধ! কে জানত যে ম্যাচের খবর আর পাঁচটা খবরের তলায় চাপা পড়ে একদিন হারিয়ে যেত, আজ সেই ম্যাচই বিখ্যাত হয়ে আছে ‘ফুটবল যুদ্ধ’-এর (Football War) অনুঘটক হিসেবে।
ঠিক এইখানে ফিরে যেতে হবে দুবছর আগে, ১৯৬৭ সালে। যখন হন্ডুরাস সরকার প্রযুক্ত নতুন ভূমিরাজস্ব ও অভিবাসন নীতি দুই দেশের মধ্যে রাজনৈতিক সম্পর্ক নষ্ট করতে থাকে। আসলে হন্ডুরাস দেশটি এল সালভাদোরের থেকে প্রায় পাঁচগুণ বড়ো। কিন্তু জনসংখ্যা প্রায় ৪০ শতাংশ কম। ফলে বিশ শতকের শুরু থেকেই এল সালভাদোরের মানুষ হন্ডুরাসে গিয়ে দিব্যি জমি কিনত, ফসল ফলাত, এমনকি বিয়ে-থা করে সংসার করাও শুরু করত। ১৯৬৯ সালের হিসেবে এল সালভাদোরের ২৩ লাখ মানুষের মধ্যে তিন লাখ তখন হন্ডুরাসে দিব্যি জাঁকিয়ে বসেছে। যা হন্ডুরাসের মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। হন্ডুরাসের অধিকাংশ জমির দখলই ছিল মুষ্টিমেয় সামন্তপ্রভুদের হাতে। ১৯৬২-তে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি রামোন মোরালেস্ সামন্তপ্রভুদের সংগঠন ‘ফেনাঘ’-এর ক্ষমতা সংকোচন ও কৃষকদের সরাসরি জমিবন্টন শুরু করার আইন পাশ করার কিছুদিনের মধ্যেই ক্ষমতা থেকে অপসৃত হন। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি স্বৈরাচারী ওসওয়াল্ডো লোপেজ ফেনাঘের স্বার্থরক্ষার জন্য এল সালভাদোরের অধিবাসীদের অধিকৃত জমি কেড়ে নেয়। শুধু তাই নয়, দেশ থেকেও বের করে দেওয়া হয় তাদের। উদ্বাস্তু সালভাদোরবাসীদের উপর শুরু হয় ধর্ষণ, বোমাবর্ষণ এবং গণহত্যা!
এই পরিস্থিতিতে শুরু হয় ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ যোগ্যতা অর্জনের ম্যাচ। ‘কনকাকাফ’ থেকে বিশ্বকাপে খেলার মাত্র একটাই স্থান পড়ে আছে তখন। ফুটবলের উত্তেজনার সঙ্গে জড়িয়ে গেল, দুই দেশের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ। ১৯৬৯-এর ৮ জুন প্রথম পর্বের ম্যাচ অনুষ্ঠিত হল হন্ডুরাসের রাজধানী তেগুচিগালপায়। হন্ডুরাসের পক্ষে ম্যাচের ফলাফল ১-০, আর সামান্য হাতাহাতির মধ্যেই কেউই পরবর্তী ম্যাচের সিঁদুরে মেঘ দেখেনি। ১৫ জুন এল সালভাদোরের রাজধানী সান সালভাদোরে দ্বিতীয় পর্বের ম্যাচ চলাকালীন পরিস্থিতি ভয়ানক রূপ ধারণ করে। আগের রাতে সালভাদোর সমর্থকরা হন্ডুরাসের প্লেয়ারদের হোটেলের ঘর লক্ষ্য করে পচা ডিম, মরা ইঁদুর, গালাগালি আর হুমকি ছুঁড়ে মেরেছে। ম্যাচ চলাকালীন হন্ডুরাসের জাতীয় পতাকা আর জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে চলেছে অকথ্য নোংরামি। শুধু তাই নয়, ম্যাচের পরের দাঙ্গায় মারা যায় তিন সালভাদোরবাসী। ম্যাচের ফলাফল সালভাদোরের পক্ষে ৩-০। হয়তো প্রথমবার এবং শেষবার কোনো পরাজিত দলের কোচ পরাজয়কে সৌভাগ্যের সঙ্গে তুলনা করেছিল। এদিকে সীমান্তে তখন বেজে উঠেছে যুদ্ধের বাদ্য। ২৭ জুন মেক্সিকোতে অনুষ্ঠিত প্লে-অফের ম্যাচে ফের মুখোমুখি দুটি দেশ। আর ওইদিন সকালেই এল সালভাদোরের সরকার হন্ডুরাসের সঙ্গে সমস্ত রাজনৈতিক সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করার বার্তা। সেই ম্যাচে অতিরিক্ত সময়ের ১১ মিনিটে রদ্রিগেজের গোলে সালভাদোর ম্যাচটি ৩-২ গোলে জিতে যায়।
এই জয় সালভাদোরের রাজনৈতিক অবস্থানকে আত্মবিশ্বাসের তুঙ্গে পৌঁছে দিয়েছিল। এর ঠিক ১৬ দিনের মাথায় ১৪ জুলাই এল সালভাদোর আচমকাই আক্রমণ করে হন্ডুরাসের বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেয়। রাতের অন্ধকারে বোমাবর্ষণ করা হল হন্ডুরাসের তোনকন্তিন এয়ারপোর্টে। উত্তরে হন্ডুরাস সৈন্যবাহিনী সালভাদোরের বিভিন্ন তেলের খনি ও ইলোপাংগো বিমানবন্দর আক্রমণ করে। নিকারাগুয়ার শাসক অ্যানাস্তাসিয়ো সোমোজাও হন্ডুরাসের পক্ষে যোগ দেন। যুদ্ধের আগেই প্রায় তিন লাখ সালভাদোরবাসী উদ্বাস্তু হয়েছিল। যুদ্ধকালে মারা যান সালভাদোরের প্রায় ৯০০ সাধারণ মানুষ, এবং হন্ডুরাসের ২৫০ প্রশিক্ষিত সৈন্য, ২০০০ সাধারণ মানুষ। হন্ডুরাসের বেশ কিছু জনপদ ধ্বংস হয়ে যায়। নিজেদের দেশেই উদ্বাস্তু হন হাজারে হাজারে মানুষ। টানা ১০০ ঘণ্টা যুদ্ধ চলার পর ১৮ জুলাই OAS বা Organization of American States–এর মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি ঘটে। যদিও আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহের আগে সালভাদোরান সৈন্য হন্ডুরাস থেকে নিজেদের প্রত্যাহার করে নেয়নি। অবশেষে হন্ডুরাসের সরকার দেশের অবশিষ্ঠ সালভাদোরবাসীর নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে। কিন্তু দুই দেশের ব্যবসায়িক যোগাযোগ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়, যার ব্যাপক প্রভাব পড়ে CACM বা Central American Common Market–এর উপর। সীমান্তও সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন
ফুটবলের মক্কায় ‘সম্রাট’ পেলে : এক ময়দানি রূপকথার জন্মদিন
যুদ্ধ শেষ হল ঠিকই, কিন্তু বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ রইল প্রায় আটের দশক পর্যন্ত। অবশেষে ১৯৮০ সালে লাতিন আমেরিকার অন্যান্য দেশগুলির মধ্যস্থতায় পেরুতে বসে দুটি দেশই শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। ১৯৯২ সালে ICJ বা International Court of Justice–এর রায়ে হন্ডুরাস তার অধিকাংশ জমিই ফেরত পায়। ফনসেকা অঞ্চলটিকে আজও দু’দেশের মৈত্রীস্থাপনের চিহ্ন হিসেবেই বিবেচনা করা হয়।
আরও পড়ুন
ব্রাজিলের ক্লাবে ফুটবল খেলেন মহাত্মা গান্ধী!
তবে এই যুদ্ধের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় এল সালভাদোরই। একদিকে তিন লাখ উদ্বাস্তু, অন্যদিকে যুদ্ধের ফলে ব্যাপক অর্থব্যয়, সব মিলিয়ে দেশের অর্থনীতি প্রায় ধ্বংস হয়ে যায়। যার ফল- গৃহযুদ্ধ। সালভাদোরবাসী এবার নিজের দেশ থেকেই উদ্বাস্তু হয়ে পালিয়ে যেতে থাকে। কোথায়? হন্ডুরাসেই। আর ১৯৭০-এর বিশ্বকাপ থেকে এল সালভাদোর বিদায় নিল একটিও ম্যাচ না জিতে, একটিও গোল না করে। অদ্ভুত এক সমাপতন!
এরপর আর মাত্র একবার ১৯৮২ সালে এল সালভাদোর বিশ্বকাপে যোগ্যতা অর্জন করে। হন্ডুরাসও সে-বছর প্রথমবার বিশ্বকাপে খেলার ছাড়পত্র পায়। তারপর অবশ্য ২০১০ ও ২০১৪ সালে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছে। আশ্চর্যের বিষয় দুটি দেশই আজ পর্যন্ত বিশ্বকাপে কোনো ম্যাচ জিততে পারেনি। ফুটবলপ্রেমীদের কাছেও নিতান্তই অপাংক্তেয় এই দুটি দেশের ফুটবল। একমাত্র এই যুদ্ধের জন্যেই হন্ডুরাস ও এল সালভাদোর ফুটবল ইতিহাসচর্চার বিষয়বস্তু হয়ে ওঠে।
Powered by Froala Editor