১৯৬৮ সালের ১৪ মার্চ। আর পাঁচটা দিনের মতোই শুরু হতে পারত আমেরিকার উটাহ (Utah) প্রদেশের ডাগওয়ে অঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবন। কিন্তু ঘুম ভেঙে যে দৃশ্য তারা দেখল, তাতে কার্যত বাকরুদ্ধ অবস্থা তাদের। হাজার হাজার ভেড়ার মৃতদেহে ভরে গেছে গোটা অঞ্চল। সঠিকভাবে বললে সংখ্যাটা প্রায় ৬০০০। যতদূর চোখ যায়, শুধু সাদা প্রাণীদের দেহে ঢেকে গেছে ঘাসের চাদর। অথচ আশ্চর্যজনক কোনো ঘটনা চোখে পড়েনি কারোরই। অতীতে কোনো মহামারির ঘটনাও ঘটেনি উটাহতে। তবে কীভাবে রাতারাতি মৃত্যু ঘটল নিরীহ প্রাণীদের?
স্বাভাবিকভাবেই বাতাসে ভেসে বেড়াতে থাকে অসংখ্য তত্ত্ব। অনেকেই তুলে আনেন ষড়যন্ত্রের কথা। কিন্তু নির্দিষ্ট কোনো তথ্যপ্রমাণ ছাড়া কিছু প্রমাণ করা মুশকিল। তবে একটা বিষয় প্রত্যেকেরই নজর কেড়েছিল, তা হল ডাগওয়ের আমেরিকার সেনাবাহিনীর রাসায়নিক পদার্থ পরীক্ষানিরীক্ষার প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন কার্যকলাপ। সময়কালটাও যথেষ্ট বিপজ্জনক। একদিকে চলছে আমেরিকা-সোভিয়েতের ঠান্ডা যুদ্ধ, অন্যদিকে শুরু হয়ে গেছে ভিয়েতনাম যুদ্ধ। নাপাম বোমার মতো ভয়ানক বিষাক্ত বোমার কথাও উঁকি দিল অনেকের মনে। হয়তো ডাগওয়ে প্রুভিং গ্রাউন্ডের কোনো গোপন পরীক্ষায় মৃত্যু ঘটেছে ভেড়াদের। কিন্তু প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে পরিষ্কার জানিয়ে দেওয়া হল, সাম্প্রতিক সময়ে কোনো অস্ত্রের পরীক্ষা তারা করেনি। ফলে রহস্য ঘনীভূত হয়ে উঠল আরো। খবরের কাগজে ডাগওয়ের ওই বিশেষ জায়গার নাম হয়ে উঠল ‘স্কাল ভ্যালি’ (Skull Valley)।
কিন্তু সত্যিই কি বিশ্বাসযোগ্য প্রুভিং গ্রাউন্ডের বক্তব্য? ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়েছিল অনেকে। এক সপ্তাহ পরের কথা। উটাহ-র সেনেটর ফ্র্যাংক মস ফাঁস করে দিলেন পেন্টাগনের কিছু গোপন নথিপত্র। সেখানে দেখা যায়, ভেড়ার মৃত্যুর আগের দিন প্রুভিং গ্রাউন্ডের তরফ থেকে চালানো হয় তিনটি বিশেষ পরীক্ষা। তার মধ্যে একটি ছিল এফ-৪ বিমানের মাধ্যমে স্কাল ভ্যালি থেকে ৪৩ কিলোমিটার পশ্চিমে পরীক্ষামূলকভাবে ‘ভিএক্স নার্ভ এজেন্ট’ ছড়ানো। যার সামান্য পরিমাণ প্রয়োগে মৃত্যু ঘটতে পারে মানুষের, সেখানে ছড়ানো হয়েছিল ৩২০ গ্যালন। প্রথমে এই ঘটনার কথা খারিজ করে দেয় আমেরিকা সরকার। তাদের যুক্তি ছিল, যে অঞ্চলে নার্ভ এজেন্ট প্রয়োগ করা হয়, তা লোকালয় থেকে বহু দূরে।
যদিও কিছুদিনের মধ্যেই সর্বসমক্ষে এসে পড়ে প্রকৃত ঘটনা। আমেরিকার স্বাস্থ্যবিভাগের প্রাথমিক রিপোর্টে জানা যায়, এফ-৪ বিমানের যে ট্যাঙ্কগুলিতে নার্ভ এজেন্ট ছিল, তাতে সেদিন যান্ত্রিক ত্রুটি দেখা দেয়। ফলে যে উচ্চতা থেকে স্প্রে করার কথা, তার থেকে বেশি খানিকটা উঁচুতে উঠে যায় বিমান। বাতাসের কারণে তা এসে পড়ে স্কাল ভ্যালির সবুজ তৃণভূমিতে। আর সেই বিষাক্ত ঘাসই মৃত্যু ডেকে আনে ভেড়াদের। হাজারে হাজারে মৃত্যু না ঘটলে হয়তো পুরো ব্যাপারটাই ধামাচাপা পড়ে যেত।
আরও পড়ুন
এক বাঙালির হাতেই শুরু আমেরিকার প্রথম পুরুষ স্ট্রিপ ক্লাব
কিন্তু এত বড়ো একটা বিপদ সত্ত্বেও ডাগওয়ের স্থানীয় বাসিন্দারা বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ করেনি। কারণটা অবশ্যই অর্থনৈতিক। এই বিতর্কের মধ্যে প্রুভিং গ্রাউন্ড বন্ধ হয়ে গেলে, বিপদে পড়ে যেত তাদের রুটিরুজি। ফলে মুখে কুলুপ এঁটে রইল তারা। একই পথ অবলম্বন করলেন অ্যালভিন হ্যাচ। মৃত ভেড়াদের অধিকাংশই ছিল তাঁর খামারের। ক্ষতিপূরণ হিসেবে সরকারের থেকে তাঁকে প্রায় চার লক্ষ ডলার দেয় আমেরিকা সরকার। হাজার কয়েক ভেড়ার প্রাণের থেকে অনেক বেশি মূল্য! এই ঘটনার তিরিশ বছর পরে, ১৯৯৮ সালে একটি অসম্পূর্ণ রিপোর্ট প্রকাশ ছাড়া আর কোনো পদক্ষেপই নেওয়া হয়নি। উপযুক্ত শাস্তি পায়নি দায়ী ব্যক্তিরা। ফলে খাতায়-কলমে ‘ডাগওয়ে শিপ ইনসিডেন্ট’-র (Dugway Sheep Incident) অনেক বিষয় আজও রহস্যাবৃত। যুদ্ধের সময় তো এরকমই পরীক্ষা হামেশাই চলতে পারে। আপতকালীন পরীক্ষায় জনগণের কাজই হবে সরকারকে সমর্থন করা। বিশ্বের সব যুদ্ধবাজ দেশই বিশ্বাস করে এই নীতিতে। গিনিপিগের বদলে নাহয় ভেড়াদের উপরেই চলল সাম্রাজ্যবাদের পরীক্ষা!
আরও পড়ুন
হারানো শিকড়ের খোঁজে: বাংলাভাগ থেকে হলোকাস্ট, যুদ্ধবিধ্বস্ত লাতিন আমেরিকাকে জুড়ল ‘ক্যান্টো’
Powered by Froala Editor