কলকাতার ইতিউতি ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ এসে পড়া আলিপুরে। শহরের বেশ নামকরা জায়গা বলতে হয়; ঐতিহাসিকও বটে। একদিকে চিড়িয়াখানা ইশারা দিচ্ছে ছোট্ট ছোট্ট খুদেদের, অন্যদিকেই দাঁড়িয়ে রয়েছে বিরাট বেলভেডিয়ার হাউজ। অর্থাৎ কিনা ন্যাশনাল লাইব্রেরি; গবেষকদের তথ্য সংগ্রহের শেষ ঠিকানা। চারিদিকে হাজার বাড়ি, অফিস, পুরনো হেরিটেজের মাঝখানে প্রায় ‘নেই’ হয়ে আছে একটি রাস্তা। হয়ত মাঠের মাঝখানে হাজার কোলাহল আর বড়ো রাস্তার ব্যস্ততার ভিড়ে হারিয়েই গেছে তার অস্তিত্ব। শহরের বুকেই দুঃখী সন্তানটির মতো শুয়ে আছে।
কিন্তু একটা রাস্তা নিয়ে এত কথা কেন? কারণ এই রাস্তায় ঘটা একটি বিশেষ ঘটনার জন্য। আজ যা প্রায় কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে গেছে। ব্রিটিশ আমলের একটা সময় কলকাতার এই রাস্তাতেই লড়া হয়েছিল একটি ডুয়েল। ব্যস, অনেকের মাথাতেই এসে গেছে ঘটনাটার কথা। ওয়ারেন হেস্টিংস এবং স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিসের সেই ঐতিহাসিক ডুয়েল। আর সেখান থেকেই নাম পেল এই রাস্তা— ডুয়েল অ্যাভিনিউ। আজ অবশ্য অতি কষ্টে খুঁজে বের করতে হয় তাকে। কিন্তু একবার পেলে গায়ে যেন শিহরণ দিয়ে ওঠে…
ব্রিটিশরা তখন ধীরে ধীরে বাংলা-সহ গোটা ভারত দখল করার পথে। তখনও রয়েছে অন্যান্য দেশের উপনিবেশ। বাংলার গভর্নর পদে বিরাজ করছেন ওয়ারেন হেস্টিংস। বড়ো বিচিত্র মানুষ তিনি। একদিকে ভারতীয় ভাষা, সংস্কৃতি, বিশেষ করে সংস্কৃত ভাষা নিয়ে তাঁর আগ্রহ তুঙ্গে। চিত্রশিল্প নিয়ে অসম্ভব আগ্রহ। আর ছিল প্রেমিক মন। এতসবের পাশাপাশি জীবনে কালো দাগও কিছু কম পড়েনি। মহারাজ নন্দকুমারের ফাঁসির পেছনে তাঁর হাত আছে বলে বলেন অনেকে। অন্যদিকে অযোধ্যার বেগমদের অর্থ জোর করে ছিনিয়ে নেওয়া— হেস্টিংসের নামে অপবাদ প্রচুর। এদিকে মানুষটাও চাইতেন স্বাধীনভাবে কাজ করতে। কিন্তু সেই সময় সেটা সম্ভব ছিল না। কারণ ইংল্যান্ডের কোর্ট অফ ডিরেক্টরেটের নির্দেশ মেনে তৈরি হয়েছিল চারজনের একটি বিশেষ কাউন্সিল। তাই যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে হেস্টিংসকে কাউন্সিলের সঙ্গে বসতে হত।
আর এখানেই ছিল সমস্যা। ওই কাউন্সিলেরই এক সদস্য ছিলেন স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস। একই গোষ্ঠীতে যখন দুই প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন ব্যক্তি থাকেন, তাহলে তো ঠোকাঠুকি লাগেই। আর এক্ষেত্রে ‘ব্যক্তিত্ববোধ’টা একটু বেশিই ছিল। প্রসঙ্গত, ফিলিপ ফ্রান্সিস একটা সময় কলকাতার বেশ আলোচ্য ব্যক্তি হয়ে উঠেছিলেন। একটি পরকীয়ার ঘটনায় ধরা পড়ে শেষে জরিমানা দিতে হয় তাঁকে। তাঁর হেস্টিংসের প্রতি রাগ সেই শুরু লগ্ন থেকেই। ১৭৭৪ সালে ফ্রান্সিস যখন প্রথম কলকাতায় আসছেন, তখন নিয়ম অনুযায়ী ২১ বার তোপ দাগার কথা। কিন্তু করা হয় ১৭ বার। এখান থেকেই শুরু শত্রুতার। তারপর থেকে নানা ঘটনায় হেস্টিংস আর ফ্রান্সিস পরস্পরের বিরুদ্ধে কথা বলতেই লাগলেন। পারদ চড়তে লাগল ক্রমশ…
অবশেষে এল ১৭৮০ সাল। কাউন্সিলের মিটিংয়ের সময় হয়ে এল। হেস্টিংস স্ত্রীকে নিয়ে চুঁচুড়ায় গেলেন বেড়াতে, আর ফিলিপ ফ্রান্সিস অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। শেষমেশ ১৫ আগস্ট হেস্টিংস নিজের ভাষণ দিলেন। নানা কথা তো বললেনই; সেইসঙ্গে ফ্রান্সিসের নামে করলেন ব্যক্তিগত আক্রমণ। তিনি বলছেন, “I judge of his public conduct by my experience of his private, which I have found to be void of truth and honour.” এমন লোকের সঙ্গে কাজ করতেও নাকি ‘তাঁর লজ্জা হয়’! ফ্রান্সিস একেবারে হতবাক। এভাবে সবার সামনে হেস্টিংস তাঁকে ছোটো করবেন, সেটা ভাবেননি তিনি। এঁর উচিত জবাব দিতেই হবে। সব শেষ হবার পর পাশের ঘরে হেস্টিংসকে ডাকলেন। আহ্বান করলেন ডুয়েল লড়াইয়ের। স্থান, কাল সব ঠিক হয়ে গেল। এবার শুধু সামনে আসার পালা!
সাহেবদের কাছে এই ডুয়েল ব্যাপারটা হামেশাই ঘটে থাকে। কোনো ঘটনার মীমাংসাও এর মাধ্যমে হয় অনেক ক্ষেত্রে। তবে ডুয়েলের নিয়ম অনুযায়ী, একজন আরেকজনকে কেবল আহত করতে পারেন। হত্যা করতে পারেন না। যাই হোক, ১৭ আগস্ট আলিপুরে রাস্তায় চিন্তিত হয়ে ঘোরাঘুরি করছেন ফ্রান্সিস। আগেই পৌঁছে গিয়েছেন, মানসিক প্রস্তুতিও সাড়া। এমন সময় হেস্টিংস পৌঁছলেন। পুরনো একটা বটগাছের তলায় জায়গা বাছা হল। নিয়ম মেনে চোদ্দো পা দূরে দাঁড়ালেন দুজনে। ওয়ান… টু… থ্রি… দুজনেই ফায়ার করলেন। ফিলিপ ফ্রান্সিস টার্গেট মিস করেছেন। হেস্টিংসের গুলি লেগেছে ফ্রান্সিসের পায়ে। চিৎকার করে বলছেন, “আই অ্যাম আ ডেড ম্যান!” হেস্টিংস একটু হেসে জবাব দিলেন, “আই হোপ নট!” তখনই জানা গেল, এর আগে কখনও পিস্তল চালানইনি স্যার ফিলিপ ফ্রান্সিস!
আরও পড়ুন
বিলুপ্তপ্রায় নকশার হদিশ মন্দির প্রাঙ্গণে, ‘আদু হুলি’ খেলার আড়ালে লুকিয়ে কোন ইতিহাস?
এরপর ফ্রান্সিসও চলে গেলেন। হেস্টিংসও গভর্নর পদ থেকে বিদায় নিলেন। ধীরে ধীরে কলকাতার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে গেল ঘটনাটা। কিন্তু রাস্তাটা? যে রাস্তা এই ঘটনার একমাত্র সাক্ষী? আজও আছে আলিপুর অঞ্চলে; কিন্তু খুঁজে পেতেই যা সমস্যা। সেই বটগাছটিও কবে কাটা পড়েছে! এভাবেই ইতিহাসের ওপর পরত পড়ে। বদলায় অনেক কিছু। কলকাতার ঘাসে, ভিড়ে, আওয়াজে ঢাকা পড়ে আছে ডুয়েল অ্যাভিনিউ। খাতায় কলমে যার অস্তিত্ব আছে। কাউকে জিজ্ঞেস করলে হয়ত দেখিয়েও দেবে। তখন কি নাকে আসবে বারুদের গন্ধ? ভারী বুটের আওয়াজ? শরীরে ভর দিয়ে নেমে আসল বিকেলবেলা। ইতিহাসের ভেতর এখনও হয়তো ধোঁয়া উঠছে…
Powered by Froala Editor