দুচাকার ছিপছিপে বাইসাইকেল কৌলীন্যের মর্যাদা পায় না। রাস্তা দাপিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারে না। বড় বড় গাড়ির চাপে ফুটপাতের গা ঘেঁষে এগোতে হয়। তবে সাইকেলকে নিয়ে কিন্তু তামাম বিশ্ববাসীর মতো বাঙালির রোমান্টিকতাও কিছু কম ছিল না। কলকাতার ইতিহাস ঘাঁটলে পাওয়া যায় তারই সাক্ষ্য।
১৮১৯ খ্রিস্টাব্দে 'সমাচার দর্পণ' পত্রিকা খবর দেয় নতুন এক গাড়ির। এই গাড়ি চালাতে লাগে না ঘোড়া বা অন্য কোনো বাহন। প্রতিবেদনে পিছনে বসে কল ঘোরানোর কথা বলা হলেও, প্যাডেল দেওয়া সাইকেল তখনও তৈরি হয়নি। 'সমাচার দর্পণে'র প্রতিবেদনে সম্ভবত জনসন'স হবি হর্সের কথা বলা হয়েছিল। এই সাইকেল সিটের উপর বসে পা দিয়ে হেঁটে হেঁটে চালাতে হত। জার্মানি, ফ্রান্স ও ব্রিটেনে বেশ জনপ্রিয় হলেও শেষপর্যন্ত ঘোড়ার গাড়ি ও পথচারী মানুষের জন্য বিপজ্জনক বলে নিষিদ্ধ করে দেওয়া হয় জনসন ও ডাইসিনের সাইকেল।
তবে নতুন এই গাড়ি ততদিনে পৃথিবীব্যাপী সাড়া ফেলে দিয়েছে। ফ্রান্স ও ব্রিটেনে সাইকেলের উন্নত প্রযুক্তির সন্ধানে গবেষণা করতে থাকেন গাড়ির নির্মাতারা। তবে এ'দেশের সংবাদপত্রে আর কোন উচ্চবাচ্য দেখা যায় না। আরো পঞ্চাশ বছর পরে ১৮৬৯ সালে 'এডুকেশন গেজেট' প্রকাশিত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয় 'ভেলোসিপেড' যন্ত্রের কথা। ফ্রান্সে ততদিনে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে দুই বা তিন চাকার এই গাড়ি যা যাত্রী নিজেই চালাতে পারে। 'এডুকেশন গেজেট'এর প্রতিবেদনে উল্লেখ ছিল, ফ্রান্সের পুরুষরা চালায় দুই চাকার ভেলোসিপেড, আর মহিলারা তিন চাকার।
এই সংবাদ প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই কলকাতায় সাইকেলের আমদানি করা হয়। ১৮৭০ সালে 'সুলভ সমাচার' পত্রিকায় লেখা হয়, "বছর দুই হইল, কলিকাতায় দুই চাকার এবং তিন চাকার একরকম গাড়ী আসিয়াছে, যাহার উপর চড়িয়া পা নাড়াইলেই গাড়ীর মত দৌড়ায়।" ১৮৮৬ সালের ১৩ই সেপ্টেম্বর সাইকেলে চড়ে কলকাতায় আসেন টমাস স্টিভেন্স। তাঁকে দেখতে ময়দানে ভিড় জমায় ছেলে-ছোকরার দল। শহর জুড়ে সেদিন সাজো সাজো রব। কলকাতাবাসী প্রেমে পড়ে যায় দুচাকার এই ছিপছিপে গাড়িটার। অবশ্য তার আগেই ১৮৭০ সালে 'সুলভ সমাচার' পত্রিকায় লেখা হয়, "সম্প্রতি সাঁতরাগাছিতে একজন কর্মকার বুদ্ধি খাটাইয়া একখানি সেই রকম গাড়ী প্রস্তুত করিয়াছেন। তাহাতে অগ্রে একজন এবং পশ্চাতে দুইজন পা দিয়া চাকা ঘুরাইয়া থাকে। এবং গাড়ীখানি আপনাআপনি চলিয়া যায়।" সাঁতরাগাছির প্রসন্নকুমার ঘোষের তৈরি তিনচাকার সেই সাইকেলের নাম ছিল 'ট্যান্ডেম'। অবশ্য তারও আগে অবস্থাপন্ন লোকজন বিলাত থেকে আমদানি করতেন ভেলোসিপেড সাইকেল। একইসময় কলকাতায় জনপ্রিয় ছিল পেনি-ফার্দিং সাইকেল। প্যাডেল দেওয়া এই সাইকেলের সামনের চাকা ছিল অতিকায়, আর পিছনের চাকা ছোটো। ইন্দিরা দেবীর লেখায় কলকাতার রাস্তায় পেনি-ফার্দিং এর বর্ণনা পাওয়া যায়।
সাইকেল ততদিনে ব্রিটেনে আভিজাত্যের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৮৮৫ সালে ব্রিটেনে কেম্প স্টার্লি তৈরি করেন প্রায় আধুনিক সাইকেলের মতো 'সেফটি বাইসাইকেল'। কলকাতার অভিজাত শ্রেণীর মধ্যেও সাইকেল বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। শোনা যায় রবীন্দ্রনাথের বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথ সাইকেলে চড়ে চৌরঙ্গী অঞ্চলে হাওয়া খেতে যেতেন। ১৮৯৭ সালে কলকাতাতেও তৈরি হয় 'সাইক্লিস্ট অ্যাসোসিয়েশন'। ১৯০৩ সালে বাঙালি উদ্যোগপতি হেমেন্দ্র মোহন বসু তৈরি করেন 'এইচ বোস অ্যান্ড কোং সাইকেলস'। হেমেন্দ্র মোহনের কাছেই সাইকেল চালানো শিখেছিলেন জগদীশচন্দ্র বসু, তাঁর স্ত্রী অবলা বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, নীলরতন সরকার, নির্মলা দেবী। দেখতে দেখতে আভিজাত্যের সীমানা ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষের হাতের নাগালে পৌঁছে যায় বাইসাইকেল। জগদীশচন্দ্রের কোথায়, 'আমাদের পুষ্পক রথ'। দুই বিশ্বযুদ্ধের মাঝখানে সমাজতান্ত্রিক রাজনীতির প্রভাবে সারা পৃথিবীর মতোই কলকাতাতেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে বাইসাইকেল। ১৯৪৬ সালের ডিরেক্ট অ্যাকশন ডে'র আগে মুসলিম লীগের কর্মীদের সাইকেল প্রচারের বিবরণ পাই শেখ মুজিবর রহমানের লেখায়।
আজকাল ট্রাফিকের ভিড়ে সাইকেল কলকাতার রাজপথে ব্রাত্য। গলিঘুঁজিতেও তাকে বড় একটা দেখা যায় না। মফস্বলে যদিও সাইকেলের জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি। আর বিশ্বউষ্ণায়নের সময় সাইকেলের পরিবেশ বান্ধব ভূমিকার কথা তো আমরা সকলেই জানি।
ঋণ - কলির শহর কলকাতা, হরিপদ ভৌমিক
‘টিংটিং বাজে বেল’ – সাবেক কলকাতার সাইকেল-কথা, সুরমিতা কাঞ্জিলাল, বঙ্গদর্শন
সাইকেল আবিষ্কারের সচিত্র ইতিহাস, রোর বাংলা
Powered by Froala Editor