পাশাপাশি দুই ঐতিহাসিক পুজো। একদিকে বাগবাজার সর্বজনীন। আর তার কিছু দূরেই কুমারটুলি সর্বজনীন। দুই দলের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবে স্বাভাবিক। তবে শেষ পর্যন্ত এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়িয়েছিল বাস্তব হাতাহাতিতেও। সেটা ১৯৬৮ কি ১৯৬৯ সাল। “ঠিক কোন বছর মনে নেই। আমারও তখন বয়স বেশ কম। আর এখন তো চুলের মতোই স্মৃতিতেও পাক ধরেছে।” বলছিলেন বাগবাজার সর্বজনীন দুর্গাপুজো কমিটির সহ-সভাপতি অভয় ভট্টাচার্য।
চুলে পাক ধরলেও এইসব স্মৃতিতেই আজও ধরা রয়েছেন অনেক অজানা ইতিহাস। সেবছর দুই সমিতির প্রতিমা প্রায় একসঙ্গেই ঘাটে পৌঁছেছিল বিসর্জনের উদ্দেশ্যে। “কুমারটুলি সর্বজনীন প্রতিমা ফেলে দিয়েই পালিয়েছিল। আমরা কিন্তু প্রতিমা নিয়ে ফিরে আসতে পেরেছিলাম।” বলছিলেন অভয় ভট্টাচার্য। তবে কেউই প্রতিমা বিসর্জন করতে পারেননি। তিনদিন ধরে ঠান্ডা লড়াই চলার পর অবশেষে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
১৯১৮ সালে লেবুবাগান বারোয়ারি দুর্গাপুজো নামে ৫৫ নং বাগবাজার স্ট্রিটে প্রথম শুরু হয় পুজো। দুবছর পর পুজোর জায়গা পালটে চলে যায় কাটাপুকুর। তারপর চলে যায় কপিবাগান। এমন সময় স্বদেশি আন্দোলনের নেতারা ঠিক করলেন পুজোকে এক জায়গায় স্থায়ী করা দরকার। শুধু পুজোর জন্য নয়, পুজোকে সামনে রেখে পিছনে চলবে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ড। আর সেই কর্মকাণ্ডের বেশিরভাগটাই ছিল সশস্ত্র। এইসব নেতাদের মধ্যে ছিলেন হেমন্ত বোস, দুর্গাচরণ ব্যানার্জির মতো মানুষরা।
১৯৩০ সালে কলকাতা শহরের মেয়র হলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। সহকারী ছিলেন সুভাষচন্দ্র। দুর্গাচরণ ব্যানার্জিই তাঁদের কাছে আবেদন নিয়ে গেলেন। কলকাতা কর্পোরেশনের গোডাউনে যা মাল আছে, তা যদি একমাসের জন্য সরিয়ে রাখা যায়, তাহলেই স্থায়ীভাবে সেখানে পুজোর ব্যবস্থা করা যায়। তবে সেটা আর একমাস নয়, স্থায়ীভাবেই স্থানান্তরিত হল গোডাউন। স্থায়ী ঠিকানা পেল বাগবাজার সার্বজনীন দুর্গাপুজোও। আর সেই যে জড়িয়ে পড়লেন সুভাষ বসু, সেই সম্পর্ক টিকে ছিল তাঁর দেশত্যাগের আগে পর্যন্ত।
নেতাজির হাত ধরেই বাগবাজার সার্বজনীনে শুরু হয়েছিল বীরাষ্টমী উৎসব। আর তাতে অংশ নিতেন অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর দলের সদস্যরা। “এবার আর বীরাষ্টমী উৎসব হবে না। প্রায় ১০০ বছর হতে চলল এই রীতি। সবাই লাঠি-সড়কি নিয়ে এসে খেলা দেখান প্রতিমার সামনে। এখন যদিও শুধুই প্রদর্শনী। তবে এর ইতিহাস তো একটা সংগ্রামের ইতিহাস।” বলছিলেন অভয়বাবু। সেই সংগ্রামের ইতিহাসেই শুধু নয়, ছেদ পড়েছে দুর্গাপুজোর সামগ্রিক আয়োজনেই। হাইকোর্টের রায়ে সবই তো প্রায় বন্ধ হতে চলেছে। পুষ্পাঞ্জলি, সিঁদুর উৎসব, সবকিছুর আয়োজনই অনিশ্চয়তার মুখে।
আরও পড়ুন
পুজোতেও 'মেলা' নেই, আরও ঘোর অন্ধকারে মেলার দোকানিরা
কুমারটুলি সর্বজনীন এবং বাগবাজার সর্বজনীন, দুই সমিতির সঙ্গেই জড়িয়ে সুভাষচন্দ্রের নাম। ১৯৩৮ সালে কুমারটুলির সভাপতি হয়েছিলেন সুভাষ। কিন্তু যে বাগবাজারের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক দীর্ঘদিনের, সেই ক্লাব যে যার পর নাই অসন্তুষ্ট হল। তাই ১৯৩৯ সালে তাঁকে বাগবাজারের সভাপতি হতে হল। এরপর অবশ্য আর বেশিদিন দেশে থাকেননি সুভাষ। তবে তাঁর স্মৃতিকে ধরে রেখেছিল বীরাষ্টমী উৎসব।
২০২০ সাল প্রথম নয়, এর আগেও একাধিক দুর্ঘটনায় স্তব্ধ হয়েছে বাগবাজার সর্বজনীনের পুজো। ১৯৪৬ সালে দাঙ্গার কারণে প্রতিমা পুজো হয়নি। ঘটপুজোর মাধ্যমেই সেরে ফেলা হয় উৎসব। ১৯৪৭ সালে ডালডার গোডাউন থেকে আগুন লেগে যায় পুজা মণ্ডপে। ১৯৫৫ সালে বাগবাজার তরুণ ব্যায়াম সমিতি থেকে প্রতিমা মণ্ডপে নিয়ে আসার সময় পদপিষ্ট হয়ে মারা যান এক কুলি। তবে এইসব দুর্ঘটনার পরেও আবারও ইতিহাস মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
শোনা যায় এক সময় এই পুজোর অনুষ্ঠান থেকেই গ্রেপ্তার হয়েছিলেন চারণকবি মুকুন্দদাস। বীরাষ্টমীর অস্ত্রাঞ্জলির সময় কড়া নজর রাখত ব্রিটিশ পুলিশ। আজও যেন ছোট্ট মাঠের চত্বরে বসে সেইসব ইতিহাস বাস্তব হয়ে উঠছিল। স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস হয়তো এইসব বর্ণনা লিখবে না কোনোদিন। কিন্তু মানুষের স্মৃতিতেই বেঁচে থাকবে ঐতিহ্য।
আরও পড়ুন
শিশুর অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনে মুখ্যমন্ত্রীর দেওয়া ৫০ হাজার খরচ পুজো কমিটির
Powered by Froala Editor