শরীর থাকলে শরীর খারাপ করবেই— মনোবল চাঙ্গা রাখতে এমন কথা অনেকেই বলেন। তাই বলে কাজ থামিয়ে রাখা যায় নাকি! কেউ তো থামাতে চায় না সেসব। কিন্তু শরীরকেও তো ঠিকঠাক রাখতে হবে। মাথা ব্যথা হোক বা ঘাড় ব্যথা, পায়ে যন্ত্রণা কিংবা বয়সকালের কোমরের ব্যথা— ব্যামো লেগেই আছে। তবে এই সবকিছুর মলমও রয়েছে ভারতের প্রায় সবকটি ঘরে। একটা সাদা জেলির মতো পদার্থ, ভীষণ ঝাঁজ; কিন্তু ব্যথার সময় ঠিক জায়গায় লাগালে যেন কাজ করে ম্যাজিকের মতো। ঠান্ডা হয়ে যায় শরীরটা। বস্তি থেকে কোটিপতি, সবার কাছে সমাধান একটাই। অমরুতাঞ্জন!
এই একটা নাম আমাদের রোজকার জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিটা ভারতীয়ের বাড়ির ওষুধের বাক্সে এর জায়গা পাকা। তাও আজ থেকে নয়! নস্টালজিয়া, ইতিহাস সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে গেছে এই অমরুতাঞ্জ মলম। একটা সময়ের ট্রেডমার্ক হলুদ কাচের শিশি আজ বদলে গেছে সবুজ প্লাস্টিকে। কিন্তু ভেতরের পদার্থটি একই রয়েছে। ক্লাস টুয়েলভের রসায়ন বইতে ‘অয়েল অফ উইন্টারজিন’-এর নাম হয়তো মনে থাকত না। কিন্তু ‘অমরুতাঞ্জন’ বললে এক লহমায় মাথায় চলে আসত সমস্ত সূত্র, গঠন বিন্যাস। এমনই ছিল তার মাহাত্ম্য।
অমরুতাঞ্জনের ইতিহাস আজকের নয়; এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে স্বাধীনতার লড়াইয়ের কাহিনি। আর যুক্ত রয়েছেন কাসিনাধুনি নাগেশ্বর রাও। যার হাত ধরে প্রাণ পেয়েছিল এই কোম্পানি। অন্ধ্রপ্রদেশে বেড়ে ওঠা নাগেশ্বর চাকরিসূত্রে চলে এসেছিলেন কলকাতায়। এই শহরেই শিখেছিলেন কী করে ওষুধ প্রস্তুত করা হয়, কী করে বিক্রি করা হয়। এরপর অভিজ্ঞতার জেরে আরও বড়ো জায়গায় কাজ পান তিনি, এবং চলে আসেন মুম্বই। সবই তো হল, কাজও করছেন দিব্যি; কিন্তু সে তো ইউরোপিয়ান কোম্পানিতে। নিজের দেশের জন্য কি কিছু করতে পারবেন না তিনি?
একটু একটু করে স্বদেশচেতনাও বেড়ে উঠছিল তখন নাগেশ্বরের। নিজের জোরে কিছু করতে হবে, তৈরি করতে হবে ভারতের নিজস্ব সংস্থা— এটাই ছিল জেদ। কলকাতায় কাজের সূত্রে যা শিখেছিলেন, সেইসব কাজে লাগাতে শুরু করলেন তিনি। সাল ১৮৯৩। মুম্বইতেই শুরু করলেন নিজের কোম্পানি। তৈরি করলেন হালকা হলুদ রঙের একটি বিশেষ জেলির মতো মলম। অত্যন্ত শক্তিশালী, ঝাঁজেই যেন কথা বলে। তৈরি হল অমরুতাঞ্জন। কিন্তু আজ যার এত রমরমা, শুরুর সময় সেরকম কেউ গ্রাহ্যই করেনি! বিদেশি জিনিসের ওপর মোহ তো লেগেই আছে। নাগেশ্বর রাও ঠিক করলেন, মানুষদের কাছে তাঁর প্রোডাক্টকে পৌঁছে দিতে হবে। অমরুতাঞ্জনকে হয়ে উঠতে হবে গোটা ভারতের সঙ্গী। নিলেন মস্ত বড়ো ঝুঁকি। যখনই কোনো মিউজিক কনসার্ট হত, সেখানে গিয়ে বিনামূল্যে অমরুতাঞ্জন দিতেন নাগেশ্বর।
আরও পড়ুন
৬২ বছর পেরিয়েও, নস্টালজিয়ার অপর নাম 'নটরাজ' ও 'অপ্সরা' পেনসিল
কথায় বলে, সবার দিন সমান যায় না। খারাপ সময় ঠিক কেটে যায়। অমরুতাঞ্জনের ক্ষেত্রেও তাই হল। বিনামূল্যে পাওয়ার পর মলমের কার্যকারিতার কথা ছড়িয়ে যায় সব জায়গায়। আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তরতরিয়ে এগিয়ে গেছে অমরুতাঞ্জন। আর আজ সে সবার ঘরের সঙ্গী। একটু ব্যথা হলেই সঙ্গে সঙ্গে ডাক পড়ে তার। তবে স্রেফ ব্যবসাতেই থেমে যাননি নাগেশ্বর রাও। মহাত্মা গান্ধীর ডাকে আইন অমান্য আন্দোলনেও যুক্ত ছিলেন তিনি। দেশের স্বাধীনতা মানুষের স্বাধীনতা ছিল সবার আগে।
সেইসঙ্গে ছিল তেলেগু ভাষাভাষীর মানুষদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথাও। এঁদের জন্য আলাদা রাজ্য দরকার, বারবার এই কথাটাই বলে এসেছেন নাগেশ্বর রাও। মুম্বইতে অমরুতাঞ্জন কোম্পানি চালানোর সঙ্গে বের করতেন একটি দৈনিক পত্রিকাও, নাম ‘অন্ধ্র পত্রিকা’। তিরিশের দশকে সোজা চলে যান অন্ধ্রপ্রদেশে; কারণ সেখানে আরও বেশি মানুষের কাছে পৌঁছতে পারবেন। অন্ধ্র আন্দোলনের একদম শুরুর দিন থেকেই নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। কিন্তু শেষটা দেখে যেতে পারলেন না। ১৯৩৮ সালেই প্রয়াত হন নাগেশ্বর রাও। যে লড়াই শুরু করেছিলেন, তারই ফল হিসেবে ১৯৫২ সালে অন্ধ্রপ্রদেশ নামের রাজ্যের সৃষ্টি। আর অমরুতাঞ্জন তো আগেই ছিল। আজও বহাল তবিয়তে রয়েছে সে। সেখানে কোনো বিভেদ নেই; ব্যথার উপশম দিয়ে গোটা ভারতকে একসঙ্গে করে দিয়েছে এই মলম। রং বদলালেও, আসল জিনিস তো বদলায়নি!
আরও পড়ুন
রেলযাত্রার ছবি, ডাইরেক্টরি থেকে তন্ত্র – ২০০ পেরিয়েও ‘নতুন’ বাঙালির পঞ্জিকা
Powered by Froala Editor