দেশজুড়ে তখন স্বদেশি ঝড়। বিদেশি কোনো পণ্যই আর সহজে গ্রহণ করতে রাজি নন ভারতীয়রা। শুধু ব্রিটিশ পণ্য নয়, বিদেশি নাম থাকলেই হল। ঠিক এই কারণেই মার খেতে বসল নতুন এক ব্যবসা। ভারতের প্রথম যুগের বিউটি ক্রিমের একটি, ‘আফগান স্নো’। নামে আফগানিস্তানের উল্লেখ থাকলেও এই ক্রিম যে নিখাদ ভারতীয়। তবু স্বদেশিদের বিষ নজরে পড়তে হল। কী করা যায়? শেষ পর্যন্ত খোদ মহাত্মা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করার সিদ্ধান্ত নিলেন কোম্পানির কর্ণধার ইব্রাহিম সুলতানি পাঠানওয়ালা। গান্ধিজী পুরো বিষয়টা শুনলেন। শেষে উপায় বাতলালেন নিজেই। তিনি নিজে এই ক্রিমের বিজ্ঞাপন লিখে দেবেন। তাহলেই তো আর স্বদেশিদের আপত্তি থাকবে না। বিজ্ঞাপনে তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করবেন, এই ক্রিম আসলে একটি স্বদেশি পণ্য।
ব্যবসার শুরুতেই যে লোকসানের মুখ দেখেছিল ‘আফগান স্নো’, তার থেকে মুক্তি পাওয়া গেল অবশেষে। শুধু তাই নয়, ক্রমশ সারা দেশে জনপ্রিয়তা পেল আফগান স্নো। আজ থেকে ৫ দশক আগেও বিউটি ক্রিমকে ভারতীয় মহিলারা স্নো নামেই চিনতেন। এই স্নো আর কিছুই না, আফগান স্নো-র ডাকনাম। কিন্তু একটা ভারতীয় বিউটি ক্রিমের নামের সঙ্গে কীভাবেই বা জড়িয়ে গেল আফগানিস্তানের নাম? সেও এক মজার গল্প। সালটা ১৯১৯। ভারতে এসেছেন আফগানিস্তানের রাজা মহম্মদ জাহির শাহ। তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে উপস্থিত মুম্বাইয়ের বহু তরুণ ব্যবসায়ী। তাঁদের মধ্যেই ছিলেন ইএস পাঠানওয়ালা। তাঁর ব্যবসা ছিল মূলত সুগন্ধি দ্রব্যের। তবে রাজাকে খুশি করতেই তিনি বানিয়েছেন একটি ক্রিম। আর সেই সাদা ক্রিমের ঢাকনা খুলতেই জাহির শাহের মনে পড়ে যায় কাবুলের বরফের কথা। তিনিই এই ক্রিমের নাম রাখেন ‘আফগান স্নো’।
দেখতে দেখতে ভারতের অন্দরমহলের দখল নিয়ে নেয় এই ক্রিম। সব জায়গায় বিপণন কেন্দ্র খোলা সম্ভব হয়নি। তবে তাতে বিক্রি কমেনি। গ্রাম-মফস্বল থেকে শহরে এসে মহিলারা কিনে নিয়ে যেতেন এই ক্রিম। কেউ কেউ আবার পরিবারের পুরুষদের দিয়ে আনাতেন। হাজার রকম কসমেটিক্স ব্যবহার করতে তখনও শেখেননি ভারতের মহিলারা। আফগান স্নো একাধারে ছিল মেক-আপ বেস, ময়েশ্চারাইজার এবং সান স্ক্রিন। আর তেমনই ছিল তার সুগন্ধ। একটু স্নো আর একটু পাউডার, ব্যাস! এটুকুতেই সেদিনের মহিলাদের সাজসজ্জা হয়ে যেত। তাঁদের সাজের বাক্সও তাই ছিল ছোটো। তবে সেই ছোটো বাক্সে গোলাপি ঢাকনা দেওয়া কাঁচের কৌটোটি থাকবেই।
এরপর দেখতে দেখতে স্বাধীনতা এসেছে। ভারতীয় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলিরও দায়বদ্ধতা বেড়েছে অনেকটা। মুম্বাই শহরে প্রথম মিস ইন্ডিয়া প্রতিযোগিতার আয়োজনের পিছনেও ছিল এই কোম্পানিটিই। সেইসময় দেবিকা রানির মতো জনপ্রিয় তারকারাও আফগান স্নো-র বিজ্ঞাপন করেছেন। আর সেইসব বিজ্ঞাপনও ছিল দেখার মতো। আজকাল যে-কোনো বিউটি ক্রিমের বিজ্ঞাপনেই বলা হয়, এই ক্রিম মেখে ফর্সা হওয়া যাবে। এই ধরনের বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে অবশ্য আইনি ব্যবস্থাও নেওয়া হয়েছে। কিন্তু আফগান স্নো-র বিজ্ঞাপন কোনোদিন ফর্সা হওয়ার কথা বলেনি। বরং সবসময় গুরুত্ব দিয়েছে ত্বকের সুস্বাস্থ্যের উপর। এই বিউটি ক্রিমের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে ভারতীয়দের নস্টালজিয়া। ১৯৭০-এর দশক পর্যন্ত গোটা দেশে একচ্ছত্র বাজার ছিল তার। কিন্তু ক্রমশ নানা বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে প্রতিযোগিতায় পিছু হঠতে হয় তাকে। ধীরে ধীরে তার নামটাই ভুলে যাচ্ছিলেন সবাই। তবে আফগানিস্তানে তালিবান শাসনের প্রেক্ষাপটে আবারও ফিরে আসছে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি। দুই দেশের বন্ধুত্বের ইতিহাসকে উস্কে দিচ্ছে একটা ধুলো পড়া ক্রিমের কৌটো।
আরও পড়ুন
টোকিও-য় আফগানিস্তানের দুই খেলোয়াড়, প্যারালিম্পিক মঞ্চে রূপকথার জন্ম
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
মারাঠাদের দমন করতে বিশাল আফগান সৈন্য, ভয়ংকর সেই যুদ্ধের পরিণতি কী?