সে অনেককাল আগের কথা। ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি সুতানুটি অঞ্চলে ঘাঁটি গেড়েছে কিছুকাল হল। সেই পুরনো কলকাতাতে জমে উঠেছে একাধিক বাজার। পলাশির যুদ্ধের তখনও দেরি অনেক। তেমন সময় থেকেই উল্লেখ পাওয়া যায় শ্যামবাজার আর শ্যামপুকুর থানার। দুইই ইংরেজদের অধিকারভুক্ত। অতএব শ্যামবাজারের ইতিহাস যে প্রায় ৩০০ বছরের, একথা বোঝাই যায়। কিন্তু শ্যামবাজারের ‘শ্যাম’কে খুঁজে পেতে বেগ পেতে হয় রীতিমতো। এই নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে কত না কাহিনি। তার সবই একসঙ্গে সত্যি হতে পারে না। তবে বিচিত্র জনশ্রুতির কোনটা সত্যি কোনটা মিথ্যে, তার যাচাইও যে আজ আর সম্ভব নয়।
আরও পড়ুন
তাঁর নাম থেকেই নামকরণ সোনাগাছির, চিৎপুরের গাজী ও এক বিলুপ্ত মসজিদের গল্প
“...শ্যামবাজার ও শ্যামপুকুর নামক দুইটি পল্লী বহু প্রাচীন। ১৭৪৯ খ্রীষ্টাব্দের গবর্নমেন্টের কাগজপত্রে শ্যামবাজার নামক পল্লীর অস্তিত্ব পাওয়া যায়।” এ-কথা লিখেছেন রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে এই এলাকা দুটি ঠিক কত পুরনো, তার কোনো হদিশ পাওয়া যায় না। অনেকে বলেন, একসময় শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায় নামে এক জমিদার থাকতেন এখানে। আর কম্পানির খাতায় যে বিরাট বাজারের উল্লেখ আছে, তার মালিকও ছিলেন তিনি। লোকমুখে সেই শ্যামাচরণবাবুর বাজার হয়ে দাঁড়ায় শ্যামবাজার।
আরও পড়ুন
মর্ত্যেই রয়েছে ‘কৈলাস’, কলকাতার বুকে আশ্চর্য কীর্তি মহারাজা জয়নারায়ণের
বাজারের পাশেই নাকি একটি বিরাট পুকুর খনন করেছিলেন শ্যামাচরণ। তার বিরাট আয়তনের জন্য রঙ্গলাল উল্লেখ করেছেন ‘দীর্ঘিকা’ বলে। সেই পুকুরের নাম থেকেই জায়গার নাম হয় শ্যামবাজার। কিন্তু সেই জমিদার শ্যামাচরণ মুখোপাধ্যায় যে কে, তার কোনো হদিশ পাওয়া যায় না। জানা যায় না, তিনি কবে এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করেন। তেমনই জানা যায় না বাজার প্রতিষ্ঠা এবং পুকুর খননের সাল-তারিখ। তাই এই ব্যাখ্যা মানতে খানিকটা দ্বিধা থেকেই যায়।
আরও পড়ুন
বিপ্লবীর পরামর্শে শুরু প্রকাশনা, শতবর্ষের দোরগোড়ায় কলকাতার ডি এম লাইব্রেরি
অপর একটি জনশ্রুতি আছে কলকাতার ‘জুট লর্ড’ শ্যামাচরণ বল্লভকে নিয়ে। বর্তমান আর. জি. কর রোডের উত্তরে খালের ধারে লাল রঙের এক বিরাট অট্টালিকা ছিল বল্লভ পরিবারের নিবাস। আর সেই পরিবারের সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষ্টি হলেন শ্যামাচরণ বল্লভ। আদি নিবাস শ্বেতপুর গ্রামে। অল্প বয়সে বাবাকে হারিয়ে চলে গেলেন ধান্যকুড়িয়া। সেখানে মামার কাছে বেড়ে ওঠা। তারপর পাটের ব্যবসায় প্রবেশ। ইংরেজদের আনুকূল্যে সে ব্যবসা বেশ জমেও উঠেছিল। দুর্ভিক্ষের সময় দুঃস্থদের আহার ও চিকিৎসার ব্যবস্থাও করেন শ্যামাচরণ বল্লভ। ধান্যকুড়িয়ায় প্রতিষ্ঠা করেন একটি ইংরেজি উচ্চ বিদ্যালয়। তাঁর নামে জন্ম নিয়েছে নানা কিংবদন্তিও। তেমনই এক কিংবদন্তি শ্যামবাজারের নামকরণ। কিন্তু শ্যামাচরণ বল্লভ উনিশ শতকের শেষ দিকের মানুষ। আর শ্যামবাজারের অস্তিত্ব ছিল আঠেরো শতকেই। অতএব এই বক্তব্যও ধোপে টেকে না।
আরও পড়ুন
গির্জা ধ্বংস করলেন সিরাজ, তৈরি হল কলকাতার প্রথম তিনতলা বাড়ি
অন্য আরেকটি মত পাওয়া যায় এই নামকরণের পিছনে। সেটা কিন্তু বেশ ঐতিহসিক তথ্য সমৃদ্ধ। সময়টা সেই আঠেরো শতকের মাঝামাঝি। পলাশির যুদ্ধের কিছু আগে। কলকাতায় তখন বেশ কিছু বাঙালি জমিয়ে ব্যবসা করছেন। তাঁদেরই একজন শোভারাম বসাক। তাঁর নামের সঙ্গে নাকি জড়িয়ে আছে শোভাবাজার অঞ্চলের নামও। উত্তর কলকাতায় তাঁর অনেক জমিজমা ছিল। আর বসাক বাড়ির কুলদেবতা ছিলেন শ্যামরায় বা শ্যামচাঁদ। শোভারামের হাতেই সেই বিগ্রহের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। সেই দেবতার প্রতি শ্রদ্ধাবশতই তিনি নাকি এলাকার নাম রেখেছিলেন শ্যামবাজার। আর নিত্যপূজার জলের জন্য যে পুকুর খনন করেছিলেন, সেটাই শ্যামপুকুর। শ্যামবাজারের বিখ্যাত বাজারটির মালিকও ছিলেন শোভারাম। ‘ক্যালকাটা ওল্ড অ্যান্ড নিউ’ বইতে কটন সাহেবও এই মতটির পক্ষেই সওয়াল করেন। আবার কারোর কারোর মতে, দেবতা নয়; শোভারামের নিকটাত্মীয় শ্যামচাঁদ বসাকের নামেই নামকরণ হয়েছে শ্যামবাজার এবং শ্যামপুকুরের।
আরও পড়ুন
বিলেত থেকে কলকাতায় এল সাইকেল, দেখাদেখি বানালেন সাঁতরাগাছির প্রসন্নকুমারও
এরকম আরও বেশ কিছু তথ্যই পাওয়া যায় শ্যামবাজারের নামকরণ সম্পর্কে। সঠিক যে কোনটা, তা কেউ বলতে পারেন না। প্রাচীনযুগের অনেক নিদর্শনের সাল-তারিখ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিবাদ থেকে যায়। কিন্তু কলকাতার ইতিহাস তো সেই তুলনায় অনেকটাই নতুন। কিন্তু তারও আনাচে কানাচে কতই ‘রহস্য’ ছড়িয়ে আছে। অবশ্য ‘শ্যাম’-এর হদিশ এত সহজে কেই বা পেয়েছে?
তথ্যসূত্রঃ শ্যামবাজার, একটি আঞ্চলিক ইতিহাস, সুদীপ সেন
Powered by Froala Editor