স্ক্রিনে ফুটে উঠছে দুটো হাত। একটার দিকে আরেকটা এগিয়ে যাচ্ছে। যেন ভরসা পেতে চাইছে খানিক। কমিয়ে দিতে চাইছে দূরত্ব। এমনই একটি ছবি পৃথিবীর বড়ো সংখ্যক মানুষের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে। তাঁদের বেড়ে ওঠা, ইয়ার্কি, গল্প, প্রেম— সবকিছুর বন্ধু ছিল এই ‘হাত’। জন্ম নিয়েছিল একটি নস্টালজিয়া। নোকিয়া কি স্রেফ একটা ফোন? অনেকেই স্বীকার করবেন না। সেটাই স্বাভাবিক। একটা আস্ত ব্র্যান্ড কীভাবে যেন আমাদের জীবনের মধ্যেও ঢুকে গেল।
ভারতে নোকিয়ার ফোন আসে নব্বইয়ের দশকে। তারপর আস্তে আস্তে পরিচিতি পাওয়া শুরু হয়। তার আগে বিশ্বের অনেক জায়গায় ছড়িয়ে গেছে এই ব্র্যান্ড। কিন্তু নোকিয়ার পরিচয় থেকে গেছে তার মোবাইলেই। ১৫০ বছরেরও দীর্ঘ এই যাত্রাপথ কিন্তু শুরু হয়েছিল সম্পূর্ণ অন্যভাবে। সালটা ১৮৬৫। ফ্রেডরিক আইডস্ট্যাম নামের এক মাইন ইঞ্জিনিয়ার ফিনল্যান্ডের ট্যাম্পায়ার শহরে একটি কাগজের মিল প্রতিষ্ঠা করেন। সেখান থেকে নিজের ব্যবসা চালাতে থাকেন। তখনও কোম্পানির সেরকমভাবে কোনো নাম ছিল না। তিন বছর পর, ১৮৬৮ সালে আরও একটি জায়গায় কাগজের মিল তৈরি করেন। জায়গাটির নাম ছিল নোকিয়া। যে নদীটির পাশে তৈরি হয়েছিল, তারও নাম ছিল নোকিয়ানভির্তা। সেখান থেকেই উঠে এল কোম্পানির নাম— ‘নোকিয়া এবি’। হ্যাঁ, আমাদের চিরপরিচিত ব্র্যান্ডের শুরুটা হয়েছিল কাগজ দিয়ে।
এরই মধ্যে ফ্রেডরিকের সঙ্গে ব্যবসায় যোগ দেন লিও মেশেলিন। আস্তে আস্তে কাগজের কল থেকে জুতোর ব্যবসায় ঢোকা। বিংশ শতকের শুরু থেকে নোকিয়ার রাবারের জুতোর চাহিদা বেশ ভালোই ছিল বাজারে। এই সময় থেকে আরও একটা দিক ঢুকে পড়ে এখানে। ইলেকট্রিকের জিনিসপত্র। মেশেলিনের একার উদ্যোগেই মূলত এই দিকে চলে আসা নোকিয়ার। এরই মধ্যে চলে আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। এই সময় একদম তলানিতে চলে যায় নোকিয়া। প্রায় দেউলিয়া হয়ে যায়। হয়ত তখনই মুছে যেত এর নাম; যদি না ফিনিশ রাবার ওয়ার্কস বলে একটি কোম্পানি একে অধিগ্রহন করে না নিত।
রাবার কোম্পানিটিও ধীরে ধীরে ইলেকট্রিকের জিনিস তৈরির দিকে ঝুঁকে পড়ে। এর সঙ্গে এসে যুক্ত হয় ফিনিশ কেবল ওয়ার্কস কোম্পানিও। একসঙ্গে টেলিফোন, টেলিগ্রাফ আর ইলেকট্রিকের কেবলের কাজ করতে থাকে এই কোম্পানি। ষাটের দশকে এরই প্রেসিডেন্ট ও টেকনিকাল ডিরেক্টর হয়ে আসেন ভার্নার ওয়েকম্যান; যিনি কিনা একটা সময় কুস্তিগির ছিলেন এবং অলিম্পিকে সোনাও জিতেছেন। এই সময়ই ১৯৬৭ সালে নোকিয়া এবি, ফিনিশ রাবার আর ফিনিশ ইলেকট্রিক একসঙ্গে জুড়ে একটি নতুন কোম্পানি তৈরি হয়। নাম, ‘নোকিয়া কর্পোরেশন’। এখান থেকেই শুরু আমাদের চেনা নোকিয়ার যাত্রা।
আরও পড়ুন
২৫ ছুঁতে-চলা পোকেমন, অ্যাশ-পিকাচুর খুনসুটি এবং ছেলেবেলার পাগলামির দিনগুলো
নোকিয়ার একদম প্রথম ইলেকট্রনিক ডিভাইস একটি পালস অ্যানালাইজার, যেটা নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টের জন্য বানানো হয়েছিল। পরে সামরিক বাহিনীর জন্য বেতার যন্ত্র তৈরি করা দিয়ে টেলিকমিউনিকেশনের জগতে প্রবেশ এই কোম্পানির। তখনও কোম্পানি থেকে ব্র্যান্ড হয়নি নোকিয়া। কিন্তু গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছিল একটু একটু করে। প্রধান কারণ, এর হার্ডওয়ার। যার প্রশংসা পরেও অনেকবার শোনা যাবে। ১৯৭৯ সালে প্রথমবার ফোন তৈরি করে এরা। ফিনল্যান্ডেরই একটি প্রতিষ্ঠান স্যালোরার সঙ্গে মিলে তৈরি করে বেতার টেলিফোন। আর দু-বছর পরই, বাজারে এল নোকিয়ার আন্তর্জাতিক সেলুলার নেটওয়ার্ক ‘দি নরডিক মোবাইল টেলিফোন’। বিশ্বে প্রথমবার এমন জিনিস আনল কেউ। আজকের রোমিংয়ের কনসেপ্ট তখন থেকেই শুরু করেছিল। এক মুহূর্তে যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব আনল নোকিয়া। হয়ে উঠল ব্র্যান্ড!
আরও পড়ুন
কার্টুনের লড়াই নেমে আসত ময়দানেও, বে-ব্লেড ও আমাদের হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা
আস্তে আস্তে এগোতে থাকে সময়। আর বাজারে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠে নোকিয়া। একের পর এক বিপ্লব ঘটিয়েছিল এই কোম্পানি। ১৯৯৪ সালে বের হয় নোকিয়া ২১০০ মোবাইল। সেখানেই সর্বপ্রথম শোনা যায় একটি সুর। আজ এই সুর চিনবে না, এমন লোক প্রায় নেইই। নোকিয়ার সেই বিখ্যাত টিউনটি নেওয়া হয়েছিল ফ্রান্সিস্কো টারেগা’র করা একটি কম্পোজিশন থেকে। এক কথায় আলোড়ন পড়ে যায় পৃথিবীতে। টার্গেট ছিল ৪ লক্ষ সেট বিক্রির; সেটা ২ কোটি ছাড়িয়ে যায়! আর গেম? মোবাইল গেমের প্রতি নেশা ধরানোর কাজটি করেছে নোকিয়া। ফোনে ‘স্নেকস’, ‘বাবল’ ইত্যাদি গেমগুলোর সঙ্গে তো একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে! তাকে কি এত সহজে ভোলা যায়?
আরও পড়ুন
৮০ বছর অতিক্রান্ত, নির্বাক হয়েও আজও ‘নতুন’ টম অ্যান্ড জেরি
তাই যখন ঘোষণা করা হল যে, নোকিয়া উঠে যাবে; সবার প্রায় কান্না চলে আসার অবস্থা। সবার প্রিয় কোম্পানিটা এভাবে চলে যাবে! বন্ধ হয়ে যাবে! মানতে পারেননি কেউ। কারণো ছিল অবশ্য। অ্যানড্রয়েডের ক্রমবর্ধমান চাহিদা, জনপ্রিয়তা নোকিয়াকে পেছনে ঠেলে দিচ্ছিল। নোকিয়াো ওই বাজারটা তখন বুঝতে পারেনি ভালো করে। ফলস্বরূপ, বাজারে কমতি। পরে অবশ্য স্বমহিমায় ফিরে এসেছে নোকিয়া। মাইক্রোসফট অধিগগ্রহণ করার পর অ্যানড্রয়েডের হাত ধরেই বাজারে আসে প্রিয় নোকিয়া। সেই হাত, সেই গেম, সেই টিউন! নস্টালজিয়া ফিরে পেতে কার না ভালো লাগে! নোকিয়া শুধু একটা কোম্পানি নয় যে…
আরও পড়ুন
কেউ বলেন ‘বুড়ির চুল’, কারোর কাছে ‘হাওয়াই মিঠাই’ - ১১৬ বছরেও অটুট নস্টালজিয়া
Powered by Froala Editor