পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এক প্রত্যন্ত গ্রাম। অবশ্য ঠিক প্রত্যন্তও বলা যায় না। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এগিয়ে চলেছে জনজীবন। সবুজে ঘেরা এই গ্রামটি আর পাঁচটা গ্রামের মতোই সাবলীল, স্বতঃস্ফূর্ত। গ্রামটির নাম ‘পিছলদা’। আর সাদামাটা এই গ্রামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছেন শ্রীচৈতন্যদেবও।
অবাক হচ্ছেন? হ্যাঁ, কিংবদন্তি এমন কথাই বলে। গ্রামের নামকরণের সঙ্গেও জড়িয়ে রয়েছেন শ্রীচৈতন্য। গ্রামটির ইতিহাস নিয়ে যতই খোঁড়া হয়, ততই মেলে এক-একটা বিস্ময়কর ঘটনার হদিশ। প্রথমেই কৌতূহল জাগে, গ্রামটির নাম এরকম কেন? নামটি এরকম হওয়ার পেছনে কি কোনো কাহিনি আছে?
একটি জনশ্রুতি এলাকার মানুষদের মুখে মুখে ঘোরে। কথিত আছে, মহাপ্রভু শ্রীচৈতন্য যখন পুরী থেকে পদব্রজে ফিরছিলেন, কোনো কারণে এই অঞ্চলে তাঁর পা পিছলে যায়। সেই থেকে এই গ্রামের নাম হয় ‘পিছলদা’। আবার কেউ কেউ বলে থাকেন, চৈতন্য এখান থেকে ফিরে গিয়েছিলেন বলেই এর নাম এমন হয়েছে। জনশ্রুতির কোনো প্রমাণ নেই। তাই তাকে ইতিহাস হওয়ার দিকে চেয়ে থাকতে হয়, কিন্তু ইতিহাস হয়ে ওঠা হয় না। নামকরণের কারণ যাই হোক, চারশো বছর আগেও গ্রামটার নাম যে পিছলদা ছিল তার সম্যক বিবৃতি দেয় চৈতন্য চরিতামৃতের এই চারটি লাইন –
‘জলদস্যু ভয়ে সেই যবন চলিল।
দশ নৌকা ভরি বহু সৈন্য সঙ্গে নিল।।
মন্ত্রেশ্বর দুষ্টনদে পার করাইল।
পিছলদা পর্য্যন্ত সেই যবন আইল।।’
আরও পড়ুন
মাহেশে রথের মেলায় জুয়ার আসর, মাত্র দশ টাকায় বিক্রি করে দিলেন স্ত্রী-কে!
চৈতন্যদেবের এই আগমনকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য এখানে ১৯৫৯ সালে তারিখে স্নান পূর্ণিমার দিন গড়ে উঠেছে গৌড়ীয় মঠ।
আরও পড়ুন
২০০০ বছরেও ‘অক্ষত’ রথ, উদ্ধার ইতালির প্রত্নক্ষেত্রে
মঠরক্ষক শ্রী অরবিন্দ লোচন অধিকারীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ষোড়শ শতকের শুরুর দিকে উড়িষ্যার যবনরাজা মনসুর আলি ভ্যুইঞার রাজ্যের সীমা ছিল এই পিছলদা গ্রাম পর্যন্ত। এই গ্রামের পাশ দিয়ে মন্দ্রেশ্বর নদী নামে এক নদী প্রবাহিত হয়েছিল। আজ সে নদীর কোনো অস্তিত্ব নেই। জলদস্যুদের উপদ্রবের জন্য এই নদী সেকালে দস্যুনদ হিসেবে কুখ্যাত ছিল। অনুমান করা যায়, এই জলদস্যুরা পর্তুগিজ। কারণ পিছলদার প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে নরঘাট (পূর্বের নাম নরহাট) এবং মগরাজপুরে মগ এবং পর্তুগিজদের আগমনের স্বাক্ষর ইতিহাসে মিলেছে। শুধু তাই নয়, ইতিহাস অনুযায়ী পর্তুগিজরা যেখানে গিয়েছে সেখানকার আশেপাশের গ্রামগুলির নামকরণ এবং সেখানে তারা স্থায়ীভাবে থেকেও গিয়েছে কখনো কখনো। পিছলদার পাশেই ডিঃ কাশিমপুর গ্রাম এবং সেই গ্রামের ৭৫% মানুষের পদবি ‘করণ’ - এই দুই নাম থেকে এমন ধারণা করা যায়।
ভাষা-ঐতিহাসিক সুকুমার সেন তাঁর ‘বাংলা স্থাননাম’ বইতে পিছলদা নামকরণের ব্যখ্যায় লিখেছেন - পিচ্ছিল + দহ। আমরা জানি, দহ শব্দের অর্থ হ্রদ। ধ্বনি পরিবর্তনের নিয়মে হ্রদ শব্দের বিপর্যাস ঘটে তার উচ্চারণ হয় দহ। আর বাংলার বহু গ্রামের নামকরণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে দহ শব্দটি। ভূতাত্ত্বিকদের অনুমান, একসময় এইসব অঞ্চল দিয়ে কোনো নদী প্রবাহিত হত। তারপর সেই নদী সরে গিয়ে পড়ে থাকে শুধু অশ্বক্ষুরাকৃতি হ্রদ। তাহলে কি মন্দ্রেশ্বর নদী সরে গিয়েছিল আগেই? পড়ে থাকা হ্রদকে ঘিরেই গড়ে উঠেছিল গ্রাম? চৈতন্যদেব কি সেই হ্রদের পিছল পাড়েই পড়ে গিয়েছিলেন? সুকুমার সেনের অনুমান এমনই নানা প্রশ্ন উস্কে দিয়ে যায়।
ইতিহাসের দায় থাকে না বর্তমানের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠার। বরং বর্তমানই বারবার ছুটে যায় ইতিহাসের উৎস সন্ধানে। আর এই সন্ধানের সঙ্গে মিশে যায় তথ্য এবং কিংবদন্তি। মানুষের মুখে মুখে হারিয়ে যায় অনেক কিছুই। আবার কিছু সম্ভাবনার সূত্র বেঁচে থাকে আগামীর জন্য। পিছলদার ইতিহাসও তার ব্যতিক্রম নয়। ইশারা-ইঙ্গিতে মেশানো এক জনপদ। চৈতন্যস্মৃতি যদি আচ্ছন্ন করেই, ক্ষতি কী!
ছবি ঋণ – সৌমেন করণ
Powered by Froala Editor