টেলিভিশনের পর্দায় কখনও ভেসে উঠছে ‘স্কুবিডু’, কখনও আবার ‘টম অ্যান্ড জেরি’, ‘পপআই দ্য সেলার’, ‘বেন টেন’, ‘ব্যাটম্যান’ কিংবা ‘ফ্যান্টাস্টিক ফোর’… এ যেন আদি-অনন্ত তালিকা। নব্বই কিংবা শূন্য দশকে যাদের বেড়ে ওঠা, তাদের কাছে এ ছিল এক স্বপ্নরাজ্য। স্কুল থেকে ফিরেই টেলিভিশনে ডুব দিত তারা। বাবা-মায়ের বকুনি হজম করেও পাড়ি দিত এক রূপকথার জগতে। ‘কার্টুন নেটওয়ার্ক’ (Cartoon Network)। স্মার্টফোন, ইন্টারনেটের যুগে আজকের প্রজন্মের অনেকেই হয়তো নাম শোনেনি এই টেলিভিশন চ্যানেলের, যেখানে সারাদিনই চলত কোনো না কোনো কার্টুন, অ্যানিমেশনের শো। এবার হারিয়ে যেতে বসেছে এই নস্টালজিয়াই?
হ্যাঁ, গতকাল আচমকাই নেটদুনিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায় এই খবর। ট্রেন্ডিং-এর শিখরে উঠে আসে ‘রেস্ট ইন পিস কার্টুন নেটওয়ার্ক’। কিন্তু প্রিয় চ্যানেলের ‘মৃত্যু’ নিয়ে হঠাৎ কেন এমন উত্তাল হয়ে উঠল সোশ্যাল মিডিয়া? আদৌ কি এই খবর সত্যি? একাংশের মনে গতকাল থেকেই ঘুরছে এই প্রশ্ন। আসলে কার্টুন নেটওয়ার্কের তরফ থেকে বিশেষ বিবৃতি প্রকাশ করে জানানো হয়েছিল, প্রযোজনা সংস্থা ওয়ার্নার ব্রাদার্সের সঙ্গে বিশেষ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে কার্টুন নেটওয়ার্কের। তারপরই সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয় ‘রেস্ট ইন পিস কার্টুন নেটওয়ার্ক’।
তবে দেখতে গেলে, এই চ্যানেলের সঙ্গে শুরু থেকেই জড়িয়ে রয়েছে ওয়ার্নার ব্রাদার্স। ১৯৮০-র দশকের শেষের দিক সেটা। কেবিল টেলিভিশনের পথিকৃৎ টেড টার্নারের (Ted Turner) সংস্থা ‘টিবিএস’ (TBS) বিপুল অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে অধিগ্রহণ করে এমজিএম ফিল্ম লাইব্রেরির সমস্ত সংরক্ষিত ফিল্ম। যার একটি বড়ো অংশই ছিল অ্যানিমেশন ফিল্ম বা কার্টুন। যেগুলি মুক্তি পেয়েছিল মূলত ওয়ার্নার ব্রাদার্সের প্রযোজনাতেই।
৮০-র দশকের শেষের দিকে বিভিন্ন চ্যানেলে নানান অনুষ্ঠানের মধ্যে ফাঁক পূরণ করতে এই ফিল্ম লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত কার্টুন দেখানো হত অল্পবিস্তর। তবে টেড লক্ষ্য করেন, সাধারণ ধারাবাহিক অনুষ্ঠান কিংবা সিনেমার থেকেও তরুণ প্রজন্মকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষিত করছে মধ্যবর্তী কার্টুন ‘ফিলার’-গুলিই। এখান থেকেই সংবাদ কিংবা খেলার চ্যানেলের মতো সারাদিন-ব্যাপী কার্টুনের চ্যানেল তৈরির পরিকল্পনা করেন টেড।
তবে চাইলেই তো আর এমন চ্যানেল তৈরি করে ফেলা যায় না একদিকে। টেডের সংগ্রহশালায় তখন একচেটিয়ে আধিপত্য ওয়ার্নার ব্রাদার্সের। সারাদিন যদি তাদের কার্টুনই দেখানো হয়, তবে টিবিএস-এর মাহাত্ম্যও খানিক ম্লান হয়ে যায় বৈকি। তাহলে উপায়? ১৯৯১ সালে কার্টুনের সংগ্রহ বাড়াতে অ্যানিমেশন স্টুডিও হান্না-বারবেরা প্রোডাকশনকে কিনে নেন টেড। অধিগ্রহণ করেন তাদের বিশাল লাইব্রেরি। এর বছর খানেক পরই পথ চলা শুরু ‘টোয়েন্টি ফোর সেভেন’ কার্টুন চ্যানেল ‘কার্টুন নেটওয়ার্ক’-এর। ‘টম অ্যান্ড জেরি’, ‘ড্রুপি ডগ’, ‘বাগস বানি’, ‘পপআই দ্য সেলার’, ‘ড্যাফি টুনাইট’— মূলত এই কার্টুনগুলিই দেখানো হত শুরুতে।
তবে শুধু কি আর্কাইভের কার্টুন? ১৯৯৪ সালে হান্না-বারবেরার সঙ্গে বিশেষ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় টেড টার্নারের। কার্টুন নেটওয়ার্কের হয়ে ‘হোয়াট-এ-কার্টুন’-এর সিরিজ বানানো শুরু করে মার্কিন প্রোডাকশান হাউসটি। ১৯৯৫ সাল থেকে যা ধারাবাহিকভাবে দেখানো শুরু হয় কার্টুন নেটওয়ার্কে। ‘স্পেস ঘোস্ট : কোস্ট টু কোস্ট’, ‘দ্য মক্সি শো’, ‘ওহ ইয়া! কার্টুন’-এর মতো অ্যানিমেশন সিরিজের জন্ম এই প্রকল্পের দৌলতেই। লাইব্রেরি থেকে ঐতিহাসিক কার্টুন প্রদর্শনের মাঝে ফিলার হিসাবে ব্যবহৃত হত এইসকল কার্টুন ও শর্টসগুলি। হান্না-বারবেরা ছাড়াও এই প্রকল্পের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন কিংবদন্তি অ্যানিমেটর জন ক্রিকফালুসি এবং ফ্রেড সিবার্ট।
তবে ১৯৯৬ সালে, ‘টার্নার ব্রডকাস্টিং’ বা ‘টিবিএস’ কেবল সংস্থার হাতবদল হয়। সংশ্লিষ্ট টিভি সংস্থাটি চলে আসে টিম ওয়ার্নারের (Time Warner) হাতে। স্বাভাবিকভাবেই কার্টুন নেটওয়ার্কের মালিকানাও পান তিনি। হান্না-বারবেরার ওপর নির্ভরতা কমিয়ে স্বতন্ত্র স্টুডিও তৈরির দিকে জোর দেন টিম। কার্টুন নেটওয়ার্কের এই ‘নিজস্ব’ স্টুডিও-তেই তৈরি হয় ‘কাউ অ্যান্ড চিকেন’, ‘জনি ব্র্যাভো’, ‘দ্য পাওয়ারপাফ গার্ল’, ‘ডেক্সটার’স ল্যাবরেটরি’, ‘কিডস নেক্সট ডোর’ কিংবা ‘ক্যাম্প লাজলো’-এর মতো কার্টুন।
চলতি শতকের প্রথম দশকে একাধিক বদল এসেছে ‘কার্টুন নেটওয়ার্ক’-এ। একদিকে যেমন কার্টুন নেটওয়ার্কের নাম বদলে রাখা হয়েছে ‘সিএন’, তেমনই পাল্টেছে লোগোও। এবার সেই বদলের ধারা মেনেই ফের চিরকালীন সঙ্গী ‘ওয়ার্নার ব্রাদার্স’-এর সঙ্গে বিশেষ গাঁটছড়া বাঁধতে চলেছে ‘কার্টুন নেটওয়ার্ক’। তবে কি ‘ওয়ার্নার ব্রাদার্স’-ই এবার কিনে নিতে চলেছে এই কার্টুন চ্যানেলকে? সে-ব্যাপারে এখনও কিছু জানানো হয়নি পাকাপাকিভাবে। তবে এটা নিশ্চিত, বন্ধ হচ্ছে না এই চ্যানেল। গতকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় শোকের ঝড় ওঠার পর, শেষ পর্যন্ত আজ সকালেই বিশেষ বিবৃতি দিয়ে সংস্থাটি জানিয়েছে, শেষ হয়ে যাচ্ছে না কার্টুনের স্বর্ণযুগ। বরং, ৩০ বছরে পা দেওয়ায়, ওয়ার্নার ব্রাদার্সের সঙ্গে জুটি বেঁধে নতুন চেহারায় মাঠে নামবে এই সংস্থা। বর্তমানে নিয়মিত দর্শক না হলেও, নব্বই-এর দশকের কার্টুনপ্রেমীরা যে খানিক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে এই ঘোষণায়, তাতে সন্দেহ নেই কোনো…
Powered by Froala Editor