প্রথম পরিচয় ইংরাজি বর্ণমালায়। তারপর বীজগণিতের হাত ধরে জীবনে ঢুকে পড়তে শুরু করল যাবতীয় ‘X’। এমনকি পাটিগণিতেও। এমনই হয়তো দস্তুর। তারপর শিলাজিৎ মজুমদার গাইলেন, ‘ঝিন্টি তুই বৃষ্টি হতে পারতিস!’ অ্যালবামের নাম, ‘X=প্রেম’। হালফিলে ইলন মাস্ক উড়িয়ে দিয়েছেন টুইটারের নীলরঙা পাখিটিকে। লোগোতে জ্বলজ্বল করছে একটি ‘X’। তাঁর স্পেসক্রাফট তৈরির সংস্থাটির নামও, ‘SpaceX’। অথবা হলিডের ‘X-Men’ সিরিজের কথাই যদি বলি! কিংবা, প্রাক্তন প্রেমিকা। যা কিছু অজ্ঞাত, অদ্ভুত আর বুক চিনচিনে—প্রতিক্ষেত্রে অবধারিতভাবে জড়িয়ে আছে—‘X’। এক্সকে এত আমল দেওয়ার কী আছে?
অঙ্কের যে শাখাটি মূলত ‘X’-এর কারবারি করে, তার নাম অ্যালজেব্রা। অ্যালজেব্রা নামটি কিন্তু আদতে ইসলামিক। নয়ের শতকে, ইরাকের একজন অঙ্ক-বিশারদ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী, আল-খোয়ারিজমি একটি বই প্রকাশ করেন। নাম দিয়েছিলেন, ‘আল-জেবর ওয়াল মুকাবালা’। যা হয়ে ওঠে, আধুনিক অ্যালজেব্রার আঁতুড়গ্রন্থ। আশা করি, এতক্ষণে নামকরণের বৃত্তান্ত স্পষ্ট! কিন্তু ‘X’-এর ইতিহাস আরও দীর্ঘ। আরও প্রাচীন।
প্রাচীন মিশরের দিকে চোখ রাখা যাক। এ-কথা সর্বজনবিদিত যে, মিশরীয় গণিতবিদেরা জ্যামিতিতে সর্বেসর্বা। তাঁরা যখন সমাধান করেছেন কোনও বীজগাণিতিক সমস্যা, অজ্ঞাতকে চিহ্নিত করেছেন, ‘aha’—এমন হায়ারোগ্লিফিক ভাষায়। ব্যাবিলনীয়রা আবার ব্যবহার করেছিল অদ্ভুত কিছু শব্দবন্ধ। যেমন ধরুন, প্রথম অজ্ঞাতকে চিহ্নিত করেছিল, ‘প্রথম রুপোর বস্তু’। দ্বিতীয় অজ্ঞাতকে, ‘দ্বিতীয় রুপোর বস্তু’।
এরপরেই, বীজগণিতের দুনিয়ায় আশ্চর্য এক পরিবর্তন ঘটল। বড় বড় শব্দবন্ধের পরিবর্তে এল নির্দিষ্ট কিছু সিম্বল বা প্রতীক—অর্থ্যাৎ সহজলেখ্য, আকারে ছোট কিন্তু অর্থবহ। আলেকজান্দ্রিয়ার গণিতবিদ ‘ডায়োফ্যান্টাস’ করলেন কী, প্রথমবারের জন্য শব্দের বদলে অজ্ঞাতকে প্রকাশ করলেন একটি গ্রিক অক্ষরের মাধ্যমে। দেখতে অনেকটা ‘S’-এর মতো। ডায়াফ্যান্টোসের কীর্তি ‘অ্যারিথমেটিকা’তে তিনি অজ্ঞাতকে ডাকলেন, ‘অ্যারিথমোস’ নামে।
ব্রহ্মগুপ্ত। অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভারতীয় গণিতবিদ। যার বীজগাণিতিক সূত্রাবলি বা কৌশল, যে কোনও দ্বিঘাত সমীকরণ সমাধানেই মোক্ষম অস্ত্র। অজ্ঞাত চলরাশি বা আননোন ভেরিয়েবেলের নাম দিয়েছিলেন, ‘yãvattâvat’। অতিরিক্ত ভেরিয়েবলের প্রয়োজন হলে, তিনি ব্যবহার করতেন—‘ka’। অর্থ্যাৎ ‘kalaka’ (কালো)-র প্রথমাংশটুকু। কখনও ব্যবহার করেছেন—‘ya’। যা এসেছে ‘yavat tava’ (হলুদ) থেকে। কখনও আবার, ‘ni’। অর্থ্যাৎ ‘nilaka’ (নীল)। কী আশ্চর্যভাবে, ব্রহ্মগুপ্ত অঙ্কের শরীরে রং দিয়েছিলেন। যেন কতশত যুগ আগেই বলে দিয়েছিলেন, অঙ্ক আপাদমস্তক রঙিন। আমরা কেবল সাদা-কালো করে রেখেছি।
আধুনিক বীজগণিতের আরও একটি তত্ত্ব, ইসলামিক দুনিয়াকেই নির্দেশ করে। ইংরাজিতে যা ‘something’, বাংলায় ‘যে-কোনো কিছু’, আরবিতে তা-ই ‘আল-শায়ুন’। মজাটা হল, বীজগণিতের অজ্ঞাত রাশিকে ‘sh’-এর মাধ্যমেও চিহ্নিত করা হয়েছিল সে-সময়। ‘sh’—শায়ুনের প্রথম দুটো অক্ষর। সংক্ষিপ্তাকার। স্প্যানিশ পণ্ডিতরা যখন আরবি গাণিতিক গ্রন্থ অনুবাদ করেছিলেন, তখন তাদের ‘sh’ ধ্বনির জন্য কোনও উপযুক্ত অক্ষর খুঁজে পাচ্ছিলেন না। অগত্যা বেছে নিয়েছিলেন, ‘k’। এই অক্ষরকে, গ্রিক অক্ষর ‘χ’ দ্বারা উপস্থাপন করেছিল, যা পরে ল্যাটিনে হয়ে দাঁড়ায়, ‘X’।
অঙ্কের ইতিহাসে এহেন জটিল অনুবাদ থাকতে পারে, ভেবেছিলেন কখনও? ত্রিকোণমিতিক শব্দ ‘সাইন’-ও কিন্তু, ল্যাটিন শব্দ ‘সাইনাস’-এর বহু অনুবাদের ফলাফল। কাজেই, ‘X’-এর আদিতম সূত্র খুঁজতে খুঁজতে, অনুবাদের দৃষ্টিকোণটিও গুরুত্বপূর্ণ।
স্প্যানিশ বর্ণমালায় ‘X’ অক্ষর রয়েছে। প্রারম্ভিক কাতালোনিয়ানে বেশ কয়েকটি উচ্চারণে প্রভূত সাদৃশ্য রয়েছে আধুনিক ‘sh’-এর সঙ্গে। যদিও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শব্দের উচ্চারণ পরিবর্তিত হয়েছে। তবুও পর্তুগিজ ভাষায় ‘X’-এর জন্য ‘sh’ শব্দের নিদর্শন আছে। যদিও ‘X’ অক্ষরটি মধ্যযুগে বিক্ষিপ্তভাবে গণিতে ব্যবহৃত হয়েছিল। তবে তার কোনও ধারাবাহিকতা নেই। পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে পশ্চিমের গাণিতিক পাঠ্যগুলি অজ্ঞাত রাশিকে চিহ্নিত করেছে বিভিন্ন শব্দ, সংক্ষিপ্ত রূপ এবং অক্ষরের দ্বারাই।
১৫৫৬ সাল। মেক্সিকোয় প্রকাশিত হয়েছিল হুয়ান ডিয়েজের একটি বই। নাম, ‘Sumario Compendioso of Juan Diez’। তিনি অজ্ঞাত রাশিকে বলেছিলেন, ‘cosa’। অর্থাৎ ‘সামগ্রী’ বা ‘বিষয়’। তবে অজ্ঞাত চলরাশি ‘X’-এর আরও আরও আধুনিক এবং সবচেয়ে যুক্তিসঙ্গত ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন ফরাসি গণিতবিদ ও দার্শনিক—‘রেনে দেকার্ত’। সতেরো শতকে দেকার্তের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি ‘Discourse’-এর একটি পরিশিষ্টে, দেকার্তে, বিশ্লেষণাত্মক জ্যামিতি বা অ্যানালিটিক্যাল জিওমেট্রির একটি নতুন ধারার কথা বলেন। যেখানে জ্যামিতিক সমস্যা সমাধানের জন্য বীজগণিত ব্যবহার করা হয়। ধ্রুবকরাশির জন্য তিনি বর্ণমালার প্রথম কয়েকটি অক্ষর বেছে নিয়েছিলেন। চলরাশির জন্য তিনি বিপরীত ক্রমে শেষ অক্ষরগুলি বেছে নিয়েছিলেন।
তবুও বীজগণিতে ‘X’-এর উৎপত্তি অনিশ্চিত। অথচ এমন কিছু উদাহরণ উপস্থিত, যেখানে ইতিহাসবিদরা জানেন কেন ব্যবহার করা হয়েছিল ‘X’। ক্রিসমাসের সংক্ষিপ্ত রূপ হিসেবে যেমন ‘X-mas’, যা আদতে গ্রিক অক্ষর ‘χ’ থেকে এসেছে। গ্রিক ভাষায়, ‘Christ’-কে বলা হয়, ‘Christos’। লেখা হয়, ‘χριστοσ’-এমন ঢঙে। অর্থ ‘অভিষিক্ত’। ‘χ’ মনোগ্রামটি ষোলো শতক পর্যন্ত রোমান ক্যাথলিক এবং ইস্টার্ন অর্থোডক্স—উভয় লেখাতেই খ্রিস্টের সংক্ষিপ্ত অংশ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছিল।
১৮৯৫। ক্যাথোড রশ্মি পরীক্ষাকালে, জার্মান পদার্থবিদ উইলহেম রন্টজেন, আকস্মিকভাবেই আবিষ্কার করে ফেলেছিল, ‘X-ray’। মানবশরীরের মাংস ভেদ করে চলে যায়, এমন সে রশ্মির ক্ষমতা।
পৃথিবীতে যা কিছু অজানা, আকস্মিকতা মিশে আছে যার জন্মে, তারাই কোনো না কোনোভাবে জুড়ে গেছে ‘X’। শুরুতে যেমনটা বলেছিলাম, আমার আপনার সঙ্গেও।
Powered by Froala Editor