উদ্বোধন করেছিলেন খোদ সুভাষচন্দ্র, ধ্বংসের পথে বাঙালির প্রথম সিনেমা হল ‘মিত্রা’

১৯৩০ সাল। স্বদেশি আন্দোলনে ততদিনে বাংলা উত্তাল। দিকে দিকে স্বদেশি পণ্য উৎপাদনের উদ্যোগ। প্রশস্ত হচ্ছে স্বনির্ভরতার পথ। ঠিক তেমনই একটা সময়ে পথ চলা শুরু হয়েছিল ‘মিত্রা’–র। কলকাতার ঐতিহ্যবাহী সিঙ্গেল স্ক্রিন সিনেমা হল ‘মিত্রা’। যদিও তখন তার নাম ছিল ‘চিত্রা’। বছর দুয়েক হল চিরকালের জন্য বন্ধ হয়ে গেছে মিত্রা সিনেমা। এবার শুরু হয়ে গেল তাঁর ধ্বংসের প্রস্তুতি। ন’দশক পেরিয়ে আসা সেই ঐতিহাসিক থিয়েটারকে গুঁড়িয়ে ফেলে, নতুন করে গড়ে উঠবে মাল্টিপ্লেক্স। হাতে মাত্র আর ক’টা দিন। ২ মে নির্বাচনী ফলাফল ঘোষণা হওয়ার পরই শুরু হয়ে যাবে ধ্বংসযজ্ঞ।

কথা হচ্ছিল স্বদেশি আন্দোলন নিয়ে। তিনের দশকের উত্তর কলকাতা তখন স্বাধীনতা আন্দোলনের পীঠস্থান। বিলেত থেকে সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে দেশে ফিরলেন বীরেন্দ্রনাথ সরকার। সুখের জীবন, মোটা মাইনের চাকরির সুযোগ ফিরিয়ে দিলেন তিনি। মাথার মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে অন্য এক চিন্তা। ব্রিটিশ রাজের ছায়া থেকে বেরিয়ে এসে কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে বাঙালি যুবকদের জন্য। যেমন ভাবনা তেমনই কাজ। নেতাজির অনুগামী বীরেন গাঁটছড়া বাঁধলেন দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে। ঠিক হল, ৮৩ কর্নওয়ালিশ লেনে গড়ে তুলবেন প্রেক্ষাগৃহ। নাম, ‘চিত্রা সিনেমা হল’। সেই মতো লিজে জমিরও বন্দোবস্ত হয়ে গেল। জায়গা দিলেন উত্তর কলকাতার অন্যতম উদ্যোগপতি নীরেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র।

সে প্রেক্ষাগৃহের দরজা খুলে গেল ১৯৩০ সালের ২০ ডিসেম্বর। ইতিহাসের সাক্ষী হল কলকাতা। কারণ তখনও পর্যন্ত কলকাতায় একাধিক সিনেমা হল থাকলেও, তা সবই নিয়ন্ত্রিত ব্রিটিশ সাহেব কিংবা পার্সি-মাড়োয়ারি ব্যবসায়ীদের দ্বারা। এই প্রথম চলচ্চিত্রের ব্যবসায় পা দিল বাঙালিও। 

সেদিন মানুষের ভিড়ে উপচে উঠেছিল কলকাতা। না, শুধু বাঙালি পরিচালিত সিনেমাহল— সে জন্য নয়। প্রেক্ষাগৃহের উদ্বোধন করতে এসেছিলেন খোদ সুভাষচন্দ্র বসু। ফলত ভিড় সামলাতে নাজেহাল হয়ে পড়েছিল বাংলার বাঘা বাঘা পালোয়ান থেকে শুরু করে লেঠেলরাও। প্রথম ছবি হিসাবে দেখানো হয়েছিল ‘শ্রীকান্ত’।

আরও পড়ুন
হারিয়ে যাওয়া সিনেমা হলগুলির ইতিহাস ধরে রাখছেন হেমন্ত

প্রায় তিন দশক এই সিনেমা হলের দায়িত্ব সামলেছেন বীরেন্দ্রনাথ সরকার ও দুর্গাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়। তারপর ভাঙন ধরে এই দুই ব্যক্তিত্বের সম্পর্কে। বাংলা ছবির পাশাপাশি হিন্দি ছবিও প্রদর্শিত হবে এই হলে— তা নিয়েই তৈরি হয় মতবিরোধ। অন্যদিকে তখন ফুরিয়ে গেছে লিজের মেয়াদও। আদালতে জমিটির পুনর্মালিকানার দাবিতে মামলা করলেন উত্তরাধিকারী হেমন্তকৃষ্ণ মিত্র। সে মামলার রায় গেল তাঁর পক্ষেই। বদলে গেল ‘চিত্রা’-র কর্তৃপক্ষ।

আরও পড়ুন
শিশুদের জন্য ছিল শয়নকক্ষের ব্যবস্থাও; উত্তরপাড়ার ‘গৌরী সিনেমা’ ও একটি বাসের গল্প

সম্পত্তির হাতবদল হলেও নাম বদলাতে তখনও দেরি মাস কয়েক। ১৯৬৩ সাল সেটা। চিত্রা-য় তখন দেখানো হচ্ছে ‘উদয়ের পথে’। সদ্য সিনেমাহলের মালিকানা পাওয়া হেমন্ত মিত্র ঠিক করলেন সপরিবারে দেখতে যাবেন সেই বায়োস্কোপ। ‘ল্যান্ড লর্ড বক্স’-এর বন্দোবস্ত তো রয়েইছে। তবে সিনেমা হলের দোরগোড়ায় পৌঁছে ফিরে আসতে হবে তাঁকে, ভাবতে পারেননি হেমন্ত। দর্শকদের চাহিদা মেটাতে ‘ল্যান্ড লর্ড বক্স’-এর টিকিটও বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল সেদিন।

আরও পড়ুন
নির্জন লাইটহাউসে ৭ দিন ও ৬০টি সিনেমা, একমাত্র দর্শকের অপেক্ষায় গথেনবার্গ চলচ্চিত্র উৎসব

তখনও জীবিত রয়েছেন নীরেন্দ্রকৃষ্ণ মিত্র। শেষ বয়সে এসে এমন অপমান সহ্য করতে পারলেন না। ঠিক করলেন বাড়ির কোনো সদস্যই আর পা রাখবে না ‘চিত্রা’-তে। তবে উপস্থিত থেকে তদারকি না করলে কি ব্যবসা চলতে পারে? সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, বদলে দেওয়া হবে সিনেমা হলের নাম। 

মাস ঘুরতে না ঘুরতেই পুরো ভোল পাল্টে গেল প্রেক্ষাগৃহের। বদলে দেওয়া হল সিনেমাহলের সমস্ত সজ্জা। মুছে দেওয়া হল নিউ থিয়েটার্সের বীজমন্ত্র ‘জীবতাং জ্যোতিরেতু ছায়াং’। মালিকের উপাধি অনুকরণ করে নতুন নামে জন্ম নিল ‘মিত্রা’। দিনটা ছিল ১৯৬৩-র ১৫ এপ্রিল। পয়লা বৈশাখ। সেদিন নিমন্ত্রিত হয়েছিলেন বিএন সরকারও।

তবে বদল থেমে থাকেনি সেখানেই। ১৯৬৩ সালের পর থেকে ক্রমাগত যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে একটু একটু করে নিজেকে পাল্টে নিয়েছে মিত্রা। একদিকে যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল দর্শকাসনের সংখ্যা; তেমনই হার্কনেস স্ক্রিন, ডলবি সাউন্ড, পুশ-ব্যাক সিট— সবক্ষেত্রেই আধুনিকরণের পথে হেঁটেছিল মিত্রা সিনেমা। বসেছিল শীততাপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রও। এমনকি কলকাতায় ডিজিটাল প্রোজেক্টারের ব্যবহার শুরু হয়েছিল মিত্রার হাত ধরেই। অন্য সকল সিনেমা হলে তখনও আর্কল্যাম্প প্রোজেক্টর। 

তবে এসবের পরেও মানিয়ে নেওয়া সম্ভব হল না দ্রুত পাল্টে যাওয়া পরিপার্শ্বের সঙ্গে। দিন দিন কমছিল সিঙ্গেল স্ক্রিনের জনপ্রিয়তা। কমছিল দর্শকদের আনাগোনাও। তলানিতে এসে ঠেকা উপার্জন নিয়ে তো আর ৪০ জন কর্মচারীর বেতন দেওয়া যায় না। কাজেই ২০১৯ সালে দরজা বন্ধ করেছিলেন বর্তমান মালিক দীপেন মিত্র। আশা ছিল আবার একদিন মাথা তুলে দাঁড়াবে ঐতিহ্যবাহী সিনেমা হলটি। সঞ্জীবনী এনে দেবেন কোনো না কোনো উদ্যোগপতি। তবে তা আর হয়ে উঠল না। বরং, কফিনে শেষ পেরেকটি পুঁতে দিল করোনা ভাইরাসের মহামারী। 

ভোট পর্ব শেষ হলেই এবার মুছে যাবে তার অস্তিত্ব। যে মিত্রায় দেখানো হয়েছিল ভারতের সর্বপ্রথম কার্টুন চিত্র ‘পি, ব্রাদার্স’, যেখানে আনাগোনা লেগে থাকত সত্যজিৎ থেকে শুরু করে উত্তমকুমারের মতো তারকাদের— সেখানেই গড়ে উঠবে মাল্টিপ্লেক্স। তবে নতুন উদ্যোগপতি আশ্বাস দিয়েছেন, মাল্টিপ্লেক্সের বাইরের আদলটি রাখা হবে মিত্রা’র মতোই। কিন্তু এভাবেই কি সম্ভব ইতিহাসের সংরক্ষণ? জানা নেই…

তথ্যসূত্র
১. অর্ক ভাদুড়ী।
২. কলকাতার সিনেমা হল পটভূমি ও ইতিবৃত্তান্ত, সুজয় ঘোষ

Powered by Froala Editor

More From Author See More