জয়রামবাটী থেকে দক্ষিণেশ্বর ও কলকাতা যাওয়ার পথে বিষ্ণুপুরে আসতেন সারদা দেবী (Sarada Devi)। বিষ্ণুপুরের গড়দরওয়াজার কাছে কৃষি বিজ্ঞানী বশীশ্বর সেনের (Basiswar Sen) বাড়ি। ভারতে সবুজ বিপ্লবে (Green Revolution) গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়ে ভারতকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করেন তিনি। বশীশ্বর সেন ওরফে 'বশী সেনে'র এই বাড়িতে বেশ কয়েকবার থেকে গিয়েছেন সারদা দেবী। বাড়িটি আজ রক্ষণাবেক্ষণ ও সংস্কারের অপেক্ষায়।
কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএসসি পাশ করেন বশী সেন। কলেজে পড়ার সময় থেকেই বন্ধু বিভূতিভূষণ ঘোষের মাধ্যমে রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যুক্ত হন। ভগিনী নিবেদিতার সঙ্গে পরিচয়ের সূত্রে সংস্পর্শে 'গুপ্ত মহারাজ' নামে পরিচিত স্বামী সদানন্দের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ। স্বামী বিবেকানন্দের প্রথম প্রত্যক্ষ সন্ন্যাসী শিষ্য এ হেন সদানন্দ। সারদা দেবীর ইচ্ছানুসারে, বশী সেন সমাজকল্যাণমূলক কাজের লক্ষ্যে তাঁর বাড়িতে একটি জনহিতকর কেন্দ্র খোলার সিদ্ধান্ত নেন। সেইমতো তিনি একটি দলিল সম্পাদনা করেন। স্ত্রী গারট্রুড এমারসন সেন এবং বিষ্ণুপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধানশিক্ষক গোকুলচন্দ্র ঘোষ-সহ কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে সারদা দেবীর নামে একটি ট্রাস্ট তৈরি করেন বশী সেন। দলিলটি সারদা দেবীর স্মরণে সম্পত্তিটিকে উক্ত ট্রাস্টের সম্পত্তি হিসাবে ঘোষণা করেছে। দলিল অনুযায়ী, নির্বাহক এবং তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর পর বাড়িটি হবে পবিত্র এক নিদর্শন। তখন বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন সংগ্রহে রাখার জন্য স্থায়ী জায়গা হিসাবে ব্যবহৃত হবে এই বাড়ি।
বশী সেনের মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী এমারসন সেন ট্রাস্টের দেখাশোনা করেন। কিন্তু, এমারসন সেনের মৃত্যুর পর বাড়িটির ভাগ্যাকাশে অবহেলা। এই বাড়িকে কেন্দ্র করে ইতিহাস প্রবল কণ্ঠে কথা বলতে পারত। ইতিহাস পড়ুয়াদের কাছেও আদর্শ জায়গা হয়ে ওঠার সম্ভাবনা ছিল বাড়িটিকে ঘিরে। সারদা দেবী যে বারান্দায় মধ্যাহ্নভোজ করেছিলেন, তা নির্জন। ছাদের উপরে পলেস্তরা খসে পড়েছে। বৃষ্টি হলে ফুটো বেয়ে জল পড়ে। শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো প্লাস্টিক আটকে দেওয়া সেখানে। একসময় স্বামী বিবেকানন্দের মূল্যবান জপমালা সিস্টার ক্রিস্টিন দিয়েছিলেন এমারসনকে। ঐতিহাসিক এই নিদর্শন এখন কোথায়, তা কেউ জানে না।
আরও পড়ুন
সারদা দেবীর মা শ্যামসুন্দরীকে দেখা দিলেন রক্তবর্ণা দেবী, জয়রামবাটীতে শুরু হল জগদ্ধাত্রী পুজো
বিষ্ণুপুরের সৌন্দর্য বাড়াতে স্থানীয় প্রশাসন বেশ কয়েকটি স্থানীয় মন্দির সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ গবেষক ও ভক্তরা বশী সেনের ঐতিহাসিক বাড়ির বিষয়টি রাজ্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ এবং রামকৃষ্ণ মিশনের নজরে এনেছেন। ট্রাস্টের সদস্যরা আর নেই। কয়েক বছর আগের রিপোর্ট, সেই কারণেই স্থানীয় প্রশাসনকে ট্রাস্টের অন্তর্গত এই বাড়িটি দখল করে রামকৃষ্ণ মিশনের কাছে হস্তান্তর করতে হত। বাড়িটিকে ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থান হিসেবে গড়ে তুলতে হলে রাস্তা মেরামত জরুরি। তাছাড়াও পর্যাপ্ত বৈদ্যুতিক আলোর ব্যবস্থা করতে হবে।
আরও পড়ুন
বেলুড় মঠে ‘জ্যান্ত দুর্গা’ মা সারদারও পূজা করেছিলেন বিবেকানন্দ
অন্যদিকে, বাড়ির ইতিহাস সংবলিত নোটিশ বোর্ড পর্যটকদের আকৃষ্ট করবে। বশী সেনের বাড়ির কাছাকাছি এক পুরনো মন্দিরে শত শত বছর ধরে দামোদর (ভগবান বিষ্ণু) দেবতা পুজো পান প্রতিদিন। বিষ্ণুপুরের প্রথম রাজা রঘুনাথ সিংহ দেবের আমলে শ্রীদাম দাশগুপ্তের বাড়ির আঙিনা থেকে বৈষ্ণব শাস্ত্রের একটি হাতেলেখা পাণ্ডুলিপি বিতরণ করেছিলেন শ্রীচৈতন্যের ভক্ত শ্রীনিবাস আচার্য। এখন যা শ্রীনিবাস নামে পরিচিত।
জয়রামবাটী-কামারপুকুর থেকে গরুর গাড়ি বা পালকিতে বিষ্ণুপুর স্টেশন এসে পৌঁছতেন মা সারদা। তখন কলকাতার সঙ্গে রেল যোগাযোগ চালু। ট্রেনেই যেতেন বিষ্ণুপুর থেকে কলকাতা। বিষ্ণুপুর স্টেশনে এখনও রয়েছে শতবর্ষ প্রাচীন এক কাঁঠাল গাছ। মা সারদা স্টেশনের সেই গাছতলায় বসে অপেক্ষা করতেন। প্রাচীন এই কাঁঠাল গাছের চারপাশে রেল দফতর গড়ে দিয়েছে একটি ছোট মন্দির। মা সারদা চেয়েছিলেন, বশী সেনের এই বাড়িতে স্থায়ী শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠুক। এই কাজে অনেকটা এগিয়েও গিয়েছিলেন সেন দম্পতি। যদিও সেই কাজ অপূর্ণই রয়ে যায়।
বশী-ভিটার পাশেই যে গোসাইপুকুর, সেখানে স্নান করতেন সারদা দেবী। কিছু মানুষ আজও দেখতে আসেন শ্রীশ্রীমার স্মৃতিবিজড়িত বশী সেনের এই বসতবাড়ি। কিন্তু ওইটুকু বাদ দিয়ে 'গুপ্তবৃন্দাবন' বিষ্ণুপুরের এই বশীশ্বর নিবাসের ইতিহাস আজ বিস্মৃতপ্রায়। ১৯৭১-এর ৩১ আগস্ট দেহান্ত হয় মহান এই কৃষি বিজ্ঞানীর। এ বছর তাঁর ৫৩তম প্রয়াণবার্ষিকী। অথচ বশী সেনের প্রয়াণের অর্ধশতাব্দী পরেও বলতেই হচ্ছে, ইতিহাস রক্ষার ক্ষেত্রে প্রধান রোগ ঔদাসীন্য।
Powered by Froala Editor