সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়েছে এক বছর হল। এমনই এক উত্তাল সময়, গমগম করে উঠল ঢাকা শহর। সালটা ১৮৫৮, জানুয়ারি মাস। কিন্তু এত সরগরম হওয়ার কারণ কী? আর কিছুই না, একটি ক্রিকেট ম্যাচ। ‘ঢাকা স্টেশন’ বনাম ‘হার ম্যাজেস্টিস ফিফটি ফোরথ রেজিমেন্ট’-এর ধুন্ধুমার খেলা। সামরিক ইংরেজ বাহিনী আর অসামরিক কর্তাদের মধ্যে এই ম্যাচ দেখার জন্য উত্তেজনা তো ছিলই। তখন তো আর ওয়ান ডে ছিল না; টি-২০ তো স্বপ্নের অতীত! টেস্টই ছিল বনেদিয়ানা। অনেকটা উত্তর কলকাতার মতো। যাই হোক, স্কোরকার্ড দেখলে একটু হতাশই হতে হয়। চার ইনিংসের মধ্যে মাত্র একবারই দলগত রান ১০০ ছাড়িয়েছিল। বাকি তিন ইনিংসের কথা না বলাই ভালো।
কিন্তু এত গৌরচন্দ্রিকা করার দরকারটাই বা কি? আসল কথা হল, ক্রিকেট। ভারত, বাংলাদেশ তো বটেই, ক্রিকেটের মাহাত্ম্য বোধহয় এত সহজে বোঝানো যাবে না। ব্যাটে বলে লাগানোই শুধু নয়; সেখানেও যে জুড়ে আছে নিখাদ শিল্প, না খেললে বা দেখলে কী করে বুঝবে বলুন দিকি! কিন্তু ক্রিকেট তো যাকে বলে, সাহেবসুবোদের খেলা। তাঁদের হাত ধরেই কিনা এখানে প্রবেশ! নয়তো আর কী করে জানতাম লেগ স্পিন, কভার ড্রাইভের জাদু? দাদা লর্ডসের ব্যালকনিতে জামা ওড়াতে পারতেন যদি পূর্বপুরুষরা না শিখতেন? তাহলে!
১৮৫৮ সালের কথার মাহাত্ম্য অনেকরকম হতে পারে। একে তো এক বছর আগেই শুরু হয়ে গেছে সিপাহী বিদ্রোহ। তখনও চলছে যুদ্ধের রেশ। ঢাকা, মানে ভবিষ্যতের ওপার বাংলার রাজধানীতেও যে সেই আন্দোলনের ছোঁয়া আসবে না, তা কি করে হয়! সেইজন্য হাজির হল ইংরেজ সাহেব, সেনারা। শুধু যুদ্ধ করলেই তো হবে না; বিনোদন, খেলাধুলা তো চাই! ব্যস, শুরু হল ক্রিকেট। ওই ১৮৫৮-তেই ঢাকা প্রথম সাক্ষী থাকল ক্রিকেট নামক খেলার, শুরু হল একটা অধ্যায়ের। যা আজও চলছে সমান তালে।
তবে তখনই থেমে যায়নি। ইংরেজ সাহেবরা বেশ জমিয়েই খেলতেন ক্রিকেট। চার্লস স্টুয়ার্টের লেখায় পরবর্তী সময়ের খেলার কথা পাই আমরা। তিনি উল্লেখ করেছেন ১৮৬৬ সালের কথা। তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী, সেই সময় ঢাকায় নাকি একটি আস্ত ক্রিকেট মাঠ ছিল। অন্যান্য সময় তো বটেই, নববর্ষের সময় ইংরেজরা ব্যাট বল নিয়ে নেমে পড়ত সেখানে। একইসঙ্গে আরও একটি ম্যাচের কথাও আসে। এই ম্যাচকে বলা যেতে পারে ইন্টার-সিটি ম্যাচ। কলকাতা বনাম ইস্টার্ন বেঙ্গল। তবে সেই ম্যাচে কলকাতা প্রায় উড়িয়ে দেয় প্রতিপক্ষকে। ৩১৭ রানের বিরুদ্ধে ইস্টার্ন বেঙ্গল করে মাত্র ১৭০!
তবে এ তো গেল সাহেবদের মাঠে নামার কথা। আর দেশীয় লোকেরা? ইংরেজরা পাত্তা না দিলেও, তাঁরাও মাঠে নেমেছিল ১৮৭৬ সালে। সেটাই ছিল ঢাকায় প্রথমবার নেটিভদের ক্রিকেট খেলা। ইউরোপীয় বনাম নেটিভ— একেবারে আন্তর্জাতিক ম্যাচ! কিন্তু এমন খেলা খেলতে নেমে প্রথমবারেই বিপদে পড়ে আমাদের দেশের লোকেরা। মোট ৬৯ রান তোলেন তাঁরা। কে জিতেছিল, সেটা তো সহজেই অনুমেয়। তবে এর ফল যেটা হল, ঢাকা ও পূর্ববঙ্গের অন্যত্র ক্রিকেট ছড়াতে লাগল মারাত্মকভাবে। কলেজগুলো শুরু করতে লাগল ক্রিকেট ম্যাচ। আন্তঃ কলেজ ম্যাচও আয়োজিত হতে থাকে। ঢাকা কলেজে রাতারাতি তৈরি হল নতুন ক্লাব। ক্রিকেট শিখতে শুরু করল সবাই।
তবে মেগা কাউন্টডাউন ছিল ১৮৮৭ সালের কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ বনাম ঢাকা কলেজের খেলা। ইডেন গার্ডেনসে অনুষ্ঠিত হয়েছিল এই ম্যাচ। ঢাকার ক্যাপ্টেন ছিলেন সারদারঞ্জন; যিনি সম্পর্কে উপেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরীর বড়ো ভাই ও সত্যজিৎ রায়ের বড়ো দাদু। খেলার আগে এবং পরে সবসময়ই হাওয়া গরম ছিল। আর তা জিইয়ে রেখেছিল সংবাদপত্রগুলি। এই ম্যাচ দেখতে লেফটেন্যান্ট গভর্নরও এসেছিলেন। আর এই ম্যাচেই কেল্লা ফতে ঢাকার। প্রেসিডেন্সিকে হারিয়ে দেয় তাঁরা। আর এরপর যে জিনিসটা হয়, তার সঙ্গে আমরা খুব পরিচিত। দুই শহরের খবরের কাগজের মধ্যে বাকযুদ্ধ। বিতর্কের জলও গড়ায় অনেকদূর। তারপর আপোসের মাধ্যমে জয়ী ঘোষণা করা হয় ঢাকার দলটিকেই। তবে যাই হোক, দিনের শেষে যে ক্রিকেটের জয় হয়েছিল তা বলাই বাহুল্য। আর আজ উপমহাদেশে এই খেলা কোন জায়গায়, তা আর বলে দিতে হবে না।
আরও পড়ুন
সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে ‘দিন্দা অ্যাকাডেমি’-র ট্রোল, ক্রিকেট কি এই স্পোর্টিং স্পিরিটই শেখাচ্ছে আমাদের?
আজকের ক্রিকেট খেলার সঙ্গে জুড়ে গেছে নানা পরিভাষা। হাজার হোক, খেলারও তো একটা ব্যাকরণ আছে। ওই জিনিসটা একমাত্র ভাষারই একচেটিয়া সম্পত্তি নয়। যাই হোক, এবার কয়েকটি শব্দ একটু মন দিয়ে দেখুন। ‘ব্যাক স্টপ’, ‘ব্যাটার’, ‘দৌড়’, ‘বাজি’। কী বুঝলেন? এখন যদি কেউ বলে, এই শব্দগুলোর সঙ্গে ক্রিকেটের গভীর যোগ আছে, তাহলে কী করবেন? পাগল ভাবতেই পারেন, সে স্বাধীনতা আপনার আছে। কিন্তু এই শব্দগুলোর সঙ্গে যে ইতিহাস জড়িয়ে আছে, তার বেলা? এসবের সৌজন্যে উনিশ শতকের ক্রীড়া সাংবাদিকরা। আলোচনার সময় এগুলিই তাঁদের প্রধান জিনিস ছিল। একটু পরিষ্কার করা যাক? শট নেওয়ার পর ক্রিজের মধ্যে রান নেওয়াকে ‘দৌড়’ বলা হত। আর এক একটি ইনিংস এক একটি ‘বাজি’। স্পট ফিক্সিং ভেবে বসবেন না আবার!
খেলা হবে, সব হবে; আর রেষারেষি হবে না তা কখনও হয়! এ যে সনাতন ধর্ম! সংবাদপত্র থেকে শুরু করে দর্শক, খেলোয়াড়— সুযোগ পেলে কেউ কাউকে ছেড়ে কথা বলত না। ঢাকা কলেজ আর প্রেসিডেন্সির ম্যাচ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তবে এইসঙ্গে আরও একটি চিরাচরিত অভিযোগও উঠে এসেছিল। ছাত্ররা, যাদের এখন পড়াশোনা করার সময়, তারা কিনা এইসব ক্রিকেট খেলে সময় নষ্ট করছে? ঝগড়া, বাকবিতণ্ডার বাইরেও এটা আরও একটা জিনিস, যা অনন্তকাল ধরে একই থেকে গেছে। তবে একটি পত্রিকায় খেলাধুলার সমর্থনে বলা হয়েছিল যে, “ছাত্ররা সারাদিন পড়াশোনা করে ‘অকর্মণ্য’ হয়ে যাচ্ছে। সুতরাং তাঁরা যেন একটু খেলাধুলার প্রতি মনোযোগ বিশেষ করে ক্রিকেট ক্রীড়া উহার অন্যতর।” এর আরেকটা কারণও হতে পারে দৈহিক শ্রম ও ব্যায়ামের কাজ। এবং অবশ্যই, সাহেবদের সঙ্গে একভাবে লড়ে যাওয়া। ফুটবলে যে জিনিসটা করে দেখিয়েছিল মোহনবাগান ক্লাব। যে করেই হোক, ওদের সমান হতে হবে; পরে ওদেরকেই ছাপিয়ে যেতে হবে। এটাও তো একধরণের স্বাধীনতার লড়াই! আর ক্রিকেট বা খেলা নিজেই তো সেই স্বাধীনতারই বাণী দেয়। ভারত বা বাংলাদেশের ম্যাচ দেখতে দেখতে সেই পুরনো দিনগুলোর কথা একবার ভেবে দেখুন তো!
ঋণ- ঢাকা সমগ্র ২/ মুনতাসীর মামুন
আরও পড়ুন
ক্রিকেট বলকেও হতে হবে ‘নিরামিষ’! ভেগানদের দাবিতে হাসি-ঠাট্টা সোশ্যাল মিডিয়ায়
Powered by Froala Editor