Powered by Froala Editor
স্বৈরাচার থেকে বর্ণবাদ— বিশ্বকাপের ময়দানই যখন উঠেছে প্রতিবাদের মঞ্চ!
১/১৩
কাতার বিশ্বকাপ নিয়ে নতুন করে বলার নেই কিছুই। নারী ও প্রান্তিক লিঙ্গ-যৌনতার মানুষদের অধিকার, পরিযায়ী শ্রমিকদের ওপর অবিচার, ঘুষ দিয়ে বিশ্বকাপ আয়োজনের ছাড়পত্র আদায়— বিশ্বকাপ শুরুর বহু আগে থেকেই একের পর এক বিতর্কে জড়িয়েছে কাতার। তা নিয়ে প্রতিবাদও কম হয়নি। ইউরোপের অগণিত ফুটবলপ্রেমী কার্যত ‘বয়কট’ করেছেন বিশ্বকাপ। তবে এই প্রথম নয়। আর আগেও বিশ্বকাপের ময়দান প্রতিবাদের মঞ্চ হয়ে উঠেছে বহুবার। একঝলক দেখে নেওয়া যাক সেই ইতিহাস…
২/১৩
২০২২ কাতার বিশ্বকাপের ইংল্যান্ড-ইরান ম্যাচ দিয়েই শুরু করা যাক এই আলোচনা। সেদিন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে খেলতে নেমে, জাতীয় সঙ্গীত গায়নি ইরানের ফুটবলাররা। প্রাথমিকভাবে বিষয়টি নিয়ে চর্চা না চললেও পরবর্তীতে সামনে আসে, ইরানে চলমান হিজাব আন্দোলনের প্রতিবাদেই এমন পদক্ষেপ ফুটবলারদের। বিশ্বকাপের আগেই ইরানের নারী অধিকার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন দলের অন্যতম স্ট্রাইকার সার্দার আজমুন। বিশ্বকাপ দল থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কাও তৈরি হয়েছিল তা নিয়ে। তবে নিজের অবস্থানে অনড় থাকেন তিনি।
৩/১৩
এবার জার্মানি-জাপানের ম্যাচের কথায় আসা যাক। ম্যাচের শুরুতে টিম-ফটো তোলার সময় হাত দিয়ে মুখ চাপা দেন ১১ জন জার্মান খেলোয়াড়ই। ফিফার বিরুদ্ধে এভাবেই নীরব প্রতিবাদে সামিল হলেন তাঁরা। নারী ও এলজিবিটিকিউ অধিকার এবং শ্রমিকদের মৃত্যু নিয়ে এর আগেই সরব হয়েছিল জার্মানরা। সিদ্ধান্ত নিয়েছিল রামধনু আর্মব্যান্ড পরারও। তবে ফিফা শেষ অবধি বাতিল করে দেয় তা। এরপরই মূল্যবোধ নিয়ে প্রশ্ন তোলে জার্মানি। এমনকি ফিফার বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ারও হুমকি দেয় তারা।
৪/১৩
চার বছর আগের কথা। ২০১৮-র রাশিয়া বিশ্বকাপ। পুতিনের দেশকে কেন্দ্র করে সেবারও বিতর্ক কম হয়নি। সালিসবেরি বিষক্রিয়ার পর বিশ্বকাপ বয়কটের দাবি উঠলেও, শেষ অবধি ত্বরান্বিত হয়নি বিষয়টি। তবে হাল ছাড়েননি পুতিন-বিরোধীরা। ফাইনালে ফ্রান্স-ক্রোয়েশিয়ার ম্যাচ শুরুর ২৫ মিনিটের মধ্যেই পিচে ঢুকে পড়েন ৪ মহিলা। নারীবাদী পাঙ্ক গ্রুপ ‘পুসি রায়ট’-এর সদস্যা তাঁরা। রাশিয়ার মানবাধিকার লঙ্ঘনের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে ‘পারফর্মেন্স আর্ট’ উপস্থাপন করেছিলেন তাঁরা। তার জন্য গ্রেপ্তারও হতে হয় তাঁদের।
৫/১৩
বিতর্ক ও দুর্নীতির প্রসঙ্গ উঠলে ব্রাজিলের কথাই বা বাদ যায় কেন? ২০১৪ সালে বিশ্বকাপ আয়োজন নিয়ে উত্তাল হয়ে উঠেছিল ব্রাজিলের পরিস্থিতি। প্রায় প্রতিটি আয়োজন শহরেই পথে নেমেছিলেন হাজার হাজার বিক্ষোভকারী। স্লোগান উঠেছিল ‘ফিফা গো হোম’। কারণ, এই বিশ্বকাপের জন্য ঢেকে ফেলা হয়েছিল দারিদ্রকে। বাস্তুচ্যুত করা হয়েছিল হাজার হাজার গরিব মানুষকে। সরকারি নথি অনুযায়ী ২৩৪ জন বিক্ষোভকারী গ্রেপ্তার হলেও বেসরকারি সংস্থার অভিমত, সংখ্যাটা সহস্রাধিক।
৬/১৩
২০১০ বিশ্বকাপেও দেখা গিয়েছিল এক অদ্ভুত প্রতিবাদ। না, সেটা অবশ্য আয়োজক দেশের বিরুদ্ধে নয়। এই প্রতিবাদ ছিল ফরাসি দলের অন্তর্দ্বন্দ্ব এবং কোচের বিরুদ্ধে। ফরাসি স্ট্রাইকার নিকোলাস অ্যানেলকা এবং কোচ রেমন্ড ডোমেনেচের মধ্যে কথা কাটাকাটি দিয়েই শুরু হয় এই বিতর্কের। অ্যানেলকাকে আফ্রিকা থেকে সোজা দেশে পাঠিয়ে দেন রেমন্ড। এরপরই ওঠে প্রতিবাদের ঝড়। রেমন্ডের অধীনে প্রশিক্ষণ নিতে অস্বীকার করে ফরাসি দল। গ্রুপ পর্ব থেকেই সেবার ছিটকে যাওয়ায়, ফ্রান্সের এই প্রতিবাদ ধামা চাপা পড়ে যায় লাইমলাইট থেকে।
৭/১৩
ঠিক তার আগের বিশ্বকাপের কথা। ২০০৬ সাল। আরও এক বৃহত্তর প্রতিবাদের মুখোমুখী সমগ্র ইরানের দল। বিশ্বকাপ শুরুর আগে তৎকালীন ইরানি রাষ্ট্রপতি মাহমুদ আহমাদিনেজাদ মন্তব্য করেন, ‘হলোকাস্ট’ আসলে একটা মিথ। তাছাড়া নাকি ইজরায়েল দেশটির অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার কোনো মানেই হয়নি। এই ঘটনার প্রতিবাদেই নুরেমবার্গের রাস্তায় নামেছিলেন প্রায় ১২০০ ইহুদি এবং স্থানীয় জার্মানরা। উঠেছিল ইরান বয়কটের দাবি। সরব হয়েছিলেন প্রাক্তন জার্মান চান্সেলর অ্যাঞ্জেলা মার্কেলও।
৮/১৩
১৯৮৬-র মেক্সিকো বিশ্বকাপ। মারাদোনার বিশ্বজয়ের বিশ্বকাপ। সেই বছরই বিতর্ক ঘনিয়েছিল ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর দেশকে নিয়ে। বিশ্বকাপে যাওয়ার আগেই ডোপিং টেস্ট পজিটিভ আসে পর্তুগালের অন্যতম খেলোয়াড় ড্যানি কেনেডির। তবে পরবর্তীতে দেখা যায়, সেই রিপোর্ট আদতে ভুল। পর্তুগিজ খেলোয়াড়দের বিজ্ঞাপনের জন্য অর্থ প্রদান করা হয়নি মেক্সিকোয়। তাছাড়াও একাধিক অভিযোগ তোলেন তাঁরা। হুমকি দেন স্ট্রাইকের। ‘সাল্টিলো এফেয়ার্স’ নামে পরিচিত ফুটবল ইতিহাসের এই অন্ধকার অধ্যায়।
৯/১৩
১৯৭৮-এর বিশ্বকাপ। সেবার ‘স্পোর্টসওয়াশিং’-এর অভিযোগ উঠেছিল খোদ ফিফার বিরুদ্ধে। আর্জেন্টিনায় তখন স্বৈরশাসক হোর্হে ভিদেলার রাজত্ব। খুনি সামরিক সর্বাধিনায়কের বিরুদ্ধে সেবার প্রতিবাদে সামিল হয়েছিল বহু ফুটবলার এবং সমর্থক। প্রতিযোগিতা বয়কটের দাবি উঠলেও, শেষ পর্যন্ত আয়োজিত হয় বিশ্বকাপ। কাপ জেতে আর্জেন্টিনাই।
১০/১৩
১৯৭৪-এর বিশ্বকাপ আয়োজিত হবে জার্মানিতে। তার মাস কয়েক আগের কথা। সোভিয়েত ইউনিয়নের প্লে-অফ রাউন্ডের খেলা পড়ে চিলির সঙ্গে। সে-সময় চিলিতে রাজত্ব স্বৈরশাসক অগাস্টো পিনোচেটের। ম্যাচের আয়োজকও চিলি। যে-স্টেডিয়াম গণহত্যা চালান পিনোচেট, যে স্টেডিয়ামে হত্যা গান গেয়ে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ভিক্টর হারা— সেখানেই এই প্লে-অফ ম্যাচ। এই স্টেডিয়ামে খেলা তো দূরের কথা, বিশ্বকাপ বয়কটের ডাক দিয়ে সেদিন মাঠে নামেননি সোভিয়েতের খেলোয়াড়রা। অন্যদিকে ফাঁকা মাঠে হাজির থেকে, রক্ষকশূন্য জালে বল ঠেলে দেয় চিলি। ১-০ গোলে তাদের জয়ী ঘোষণাও করে ফিফা। যোগ্যতা অর্জন অধরাই থেকে যায় রুশিদের।
১১/১৩
১৯৬৪ সাল। ফিফা জানায়, আফ্রিকান জোন থেকে কোয়ালিফাইং রাইন্ডের পর তিনটি সেরা দেশকে দ্বিতীয় রাউন্ডের প্লে-অফ খেলত হবে এশিয়ার দেশের বিরুদ্ধে। তবেই পাওয়া যাবে বিশ্বকাপ খেলার যোগ্যতা। অর্থাৎ, এককথায় মহাদেশীয় প্লে-অফের যোগ্যতা নির্ণায়ক ম্যাচের কোনো গুরুত্বই নেই। স্বাভাবিকভাবেই এক্ষেত্রে উঠে আসে বর্ণবাদের প্রসঙ্গ। এই ঘটনার প্রতিবাদে সরব হয় গোটা আফ্রিকান ফুটবল ফেডারেশন। ১৯৭০ সালের ফিফা বিশ্বকাপকে সেবার বয়কট করেছিল ৩১টি আফ্রিকান দেশ।
১২/১৩
এবার ফিরে যাওয়া যাক বিশ্বযুদ্ধোত্তর পর্বে। ১৯৩৮-এর বিশ্বকাপ। ১৯৩৬-এ হিটলার যেভাবে বার্লিক অলিম্পিককে ব্যবহার করেছিলেন শক্তিপ্রদর্শনের জন্য, সেই পথেই হাঁটেন ইতালির স্বৈরশাসক বেনিটো মুসোলিনি। ফ্রান্সে আয়োজিত হলেও, রাজনৈতিকভাবে তা ব্যবহার করেন তিনি। সম্পূর্ণু কালো পোশাক পরেই সেবার বিশ্বকাপ খেলে ইতালি। যা মুসোলিনির শাসনের সামরিকবাদী চিন্তাধারার প্রতীক। তার জন্য ফ্যাসিবাদবিরোধী প্রতিবাদের শিকার হতে হয় তাঁদের। অভিযোগ উঠেছিল রেফারিং নিয়েও। তবে শেষ পর্যন্ত বিশ্বকাপ জেতে তারাই। অন্যদিকে ইতালির এই স্বৈর-মানসিকতাকে প্রতিবাদ জানিয়ে বিশ্বকাপে সেবার অংশ নেয়নি আর্জেন্টিনা।
১৩/১৩
তবে এই প্রথম নয়। ইতালির বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হয়েছিল উরুগুয়েও। সেটা ১৯৩৪ সালের বিশ্বকাপের সময়। তার কারণ, ইতালিতে খেলতে যেতে অনীহা প্রকাশ করে তারা। এর জন্য অবশ্য আখেরে লোকসান হয় তাদেরই। সেবার ফেভারিট দল ছিল উরুগুয়েই। দু-বার পর পর বিশ্বজয়ের হাতছানিও ছিল তাদের সামনে। তবে প্রতিযোগিতা বয়কট করায়, শেষ পর্যন্ত চ্যাম্পিয়ন হয় স্বাগতিক দেশ ইতালি।