বাজারের হইহল্লার মধ্যেই মাথায় বেতের ঝুড়ি নিয়ে হাঁটছেন এক ভদ্রমহিলা। তাতে বোঝাই করা বেশ কিছু বই। অবশ্য বই না বলে তাদের পুস্তিকা বলাই শ্রেয়। আর তাঁর পাশে গান গাইতে গাইতে চলেছেন তাঁর স্বামী। সেই গানের ছন্দে অনুরণিত হচ্ছে ভয়াবহ কোনো অগ্নিকাণ্ডের কথা। তবে সেই গল্পের প্রেক্ষাপট ক্লাইম্যাক্সে পৌঁছাতেই হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেল গান। কিন্তু কী পরিণতি হল শেষ পর্যন্ত? বাকি গল্পটা জানতে গেলে, কিনতে হবে চটি বইটি।
ভাবছেন, এভাবেও আজকাল বই বিক্রি হয় বুঝি! না, এটি সাম্প্রতিক সময়ের দৃশ্য নয়। সময় আর প্রযুক্তির বদলের সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে অস্তিত্ব হারিয়েছে এই ঐতিহ্যবাহী রীতি। ‘গুজিলি পাটু’— এই নামেই পরিচিত এই বিশেষ গানের রেওয়াজ। বিশ শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্তও এই দৃশ্যের দেখা মিলত দক্ষিণের রাজ্য তামিলনাড়ুতে। তবে কি কোনোদিনই আর স্বাদ পাওয়া যাবে না এই সঙ্গীতের? না, এবার খোদ কলকাতাবাসীই শুনতে পাবে গুজিলি গান (Gujili Songs) এবং তার বর্ণময় ইতিহাসের কাহিনি। আগামী ১০-১২ জুন কলকাতায় আয়োজিত হতে চলেছে অনুবাদ কবিতার ও সাহিত্যের মহোৎসব ‘কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’ (Kolkata Poetry Confluence)। আর সেই মঞ্চেই হারিয়ে যাওয়া গুজিলিদের গানে-গল্পে হাজির করবেন শিল্পী মোনালি সান্যাল বালাসুব্রামনিয়ম (মোনালি বালা) এবং ঐতিহাসিক নিবেদিতা লুইস। বছর পর বছর ধরে নিরন্তর গবেষণা এবং অনুশীলনের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া এই শিল্পকে সঞ্জীবনী এনে দিয়েছেন তাঁরাই।
গুজলি যে নিছকই মনোরঞ্জন কিংবা বিনোদনের মাধ্যম ছিল না কোনোদিনই— তা নতুন করে বলে দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। অবশ্য গুজলির বিষয়বস্তু কখনও কখনও নিছকই মজাদায়ক হলেও, আদতে গুজিলির মাধ্যমে উঠে আসত সমাজের ছবি, সাধারণ মানুষ গল্প। বলতে গেলে সংবাদপত্রেরও আগে গুজিলিই ছিল মাদ্রাস প্রেসিডেন্সির অন্যতম সংবাদ মাধ্যম। তবে তার ইতিহাসের শিরা-উপশিরা ছড়িয়ে রয়েছে আরও গভীরে। “স্বাধীনতা সংগ্রামীদেরও কণ্ঠস্বর হয়ে উঠেছিল গুজিলি। সেখানে উঠে আসত জাতীয়তাবাদের কথা”, বলছিলেন শিল্পী মোনালি বালা।
এই কথার সূত্র ধরেই ফিরে যাওয়া গেল গুজিলির জন্মবৃত্তান্তে। চেন্নাই-এর ছাপাখানায় মুদ্রণ শুরু হয়েছিল ষোড়শ শতকের শেষের দিকেই। মূলত সেখানে ছাপা হত খ্রিস্টান ধর্মগ্রন্থ। পরবর্তীতে এই প্রেসগুলিতেই শুরু হয় গুজিলি কবিতা ও পুস্তিকা ছাপার কাজ। তামিল ভাষায় লেখা বেশ কিছু কবিতা এবং গান নিয়েই প্রকাশ পেত ১০-১২ পাতার শীর্ণকায় গ্রন্থগুলি। কিন্তু কারা লিখতেন এসব? না, সেইভাবে প্রকাশ্যে আসত না লেখক, কবিদের নাম। “গানের ভাষা বিশ্লেষণে বোঝা যায়, শিক্ষিত মানুষরাও যেমন গুজিলি লিখতেন, তেমনই সমাজের আর্থিক পিরামিডের নিচুতলার মানুষরাও ছিলেন কবিদের তালিকায়। সেই কারণে হয়তো, কথ্য ভাষা, অপশব্দ কিংবা ইংরাজি শব্দও অনায়াসেই জায়গা করে নিয়েছে গুজিলিতে”, জানালেন মোনালি।
তবে তার থেকেও বেশি অবাক করা এই গানের নাম। ‘গুজিলি’ শব্দটি শুনলেই বোঝা যায় তার সঙ্গে তামিলের থেকেও বেশি যোগ রয়েছে গুরজালি বা গুজরাটের। হেসে এই প্রশ্নের উত্তর দিলেন মোনালি, “গুজিলি বাজার থেকেই জন্ম এই গানের। মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজের কাছেই ছিল চেন্নাইয়ের এই প্রাচীন চোরা বাজার। মূলত গুজরাটি বণিকরাই ব্যবসা করতেন এই অঞ্চলে। সেখান থেকেই এহেন নামকরণ অঞ্চলটির। আর এই বাজারই ছিল গুজিলি-র আঁতুড়ঘর। তবে চেন্নাই-এর বাইরেও তিরুচিরাপল্লি, পাদুকোট্টাই-সহ চেন্নাই প্রেসিডেন্সির প্রায় সমস্ত অঞ্চলেই দেখা মিলত গুজিলির প্রভাব।”
উনিশ কিংবা বিশ শতকের শুরুতে মাদ্রাজ প্রেসিডেন্সি ছিল দক্ষিণ ভারতের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ভারতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল তার। প্রশ্ন থেকে যায়, তা সত্ত্বেও কেন চেন্নাই-এর গণ্ডির মধ্যেই বন্দি থেকে গেল এই জনপ্রিয় শিল্প? উত্তর খুঁজতে ফিরে যেতে হবে গুজিলির বিষয়বস্তুতে। সেই স্বাধীনতার কথা, জাতীয়তাবাদ— গুজিলির ওপর প্রথম আঘাতটা এনেছিল ব্রিটিশ সরকার। নিষিদ্ধ করেছিল এই বিশেষ গানের ধারাটিকে। তবে তারপরেও মুছে যায়নি অস্তিত্ব। বিশ শতকের শুরুর দিক থেকে ধীরে ধীরে সংবাদপত্রের দাপট এবং রেডিও-র আগমন ধীরে ধীরে সংকীর্ণ করে দেয় তাঁর সীমারেখা।
এক দশকেরও বেশি সময় আগে হারিয়ে যাওয়া এই শিল্পটির অনুসন্ধানে নেমেছিলেন ঐতিহাসিক নিবেদিতা লুইস। তামিলনাড়ুর বিভিন্ন অঞ্চল থেকে তিনি সংগ্রহ করেন বহু শতাব্দীপ্রাচীন গুজিলি গ্রন্থ। বছর ছয়েক আগে তাঁর এই সংরক্ষণ প্রকল্পে যোগ দেন মোনালি। গুজিলিকে গানের মোড়কে পরিবেশন করার নেপথ্যে রয়েছেন তিনিই। পাশাপাশি মঞ্চে তাঁদের সঙ্গ দেন যন্ত্রবাদক দীপন এন। তবে খুব কিছু সহজ ছিল না এই কাজ। মোনালির কথায়, “অনেকক্ষেত্রে কবিতা বা গানের সঙ্গেই তার সুর, তাল, ছন্দ এবং রাগের উল্লেখ করে রাখতেন গুজিলিস্রষ্টারা। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে শুধুমাত্র উদ্ধারকৃত কবিতাটিই আমাদের সম্বল। সেক্ষেত্রে তার বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ করে যুতসই সুর ও তাল তৈরি করতে হয়েছে আমাদেরই।” জানা গেল, বিস্তর পরীক্ষানিরীক্ষা, সঙ্গীত বিশেষজ্ঞদের অভিমতের ওপর ভিত্তি করেই গানের রূপ দেওয়া হয় সুর-হারিয়ে যাওয়া কবিতাদের।
মজার বিষয় হল, দীর্ঘ তিরিশ বছর তামিলনাড়ুতে থাকলেও, মোনালি বাঙালি। কাজেই ইংরাজি সরিয়ে রেখে আদ্যোপান্ত কথা চলল বাংলাতেই। উচ্ছ্বসিত মোনালি জানালেন, নিজের মাতৃভাষার মাটিতে, নিজের শহরে অন্য একটি ভাষার হয়ে, হারিয়ে যাওয়া এক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করার অনুভূতি। তাঁর কণ্ঠস্বরেও স্পষ্টভাবেই ধরা পড়ছিল সেই উচ্ছ্বাসের প্রতিফলন।
এর আগে ইউনেস্কোর মঞ্চেও মোনালি এবং নিবেদিতা উপস্থাপন করেছেন এই প্রাচীন শিল্পকলাটির। এবার হারিয়ে যাওয়া এই প্রাচীন লোকশিল্পের স্বাদের ভাগীদার হতে চলেছে কলকাতাও। গান-গল্প মিলিয়ে ‘কলকাতা পোয়েট্রি কনফ্লুয়েন্স’-এর মঞ্চ এক অজানা ইতিহাস তুলে আনবে বাঙালি সংস্কৃতিমনাদের সামনে, তা বলা যায় নিঃসন্দেহেই…
Powered by Froala Editor