১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৬১। সান ফ্রান্সিসকো শহরের বুকে মাত্র এই চার বছরের জন্য অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিল ‘স্পাটসা গ্যালারি’। আর এই চার বছরেই যুক্তরাষ্ট্রের বিট মুভমেন্টের অন্যতম অঙ্গ হয়ে উঠেছিল এই প্রদর্শনশালা। এই গ্যালারির হাত ধরেই আমেরিকায় ভাষা পেয়েছিল বিমূর্ত অভিব্যক্তিবাদ এবং কিউবিজম। তবে আশ্চর্যের বিষয় এই গ্যালারি কোনো বাণিজ্যিক গ্যালারি ছিল না। স্পাটসা গ্যালারি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রিত হত শিল্পীদের দ্বারা। সম্প্রতি চলে গেলেন সেই কিংবদন্তি স্পাটসা গ্যালারির প্রতিষ্ঠাতা এবং চিত্রশিল্পী দিমিত্রি গ্রাচিস।
বার্ধক্যজনিত কারণে দীর্ঘদিন ধরেই ভুগছিলেন তিনি। বিগত কয়েক মাসে ফুসফুসের সমস্যা বেড়ে গিয়েছিল অস্বাভাবিকভাবেই। পাওলো অল্টোর ভিএ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল তাঁকে। গত ৯ জানুয়ারি সেখানেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন কিংবদন্তি এই শিল্পী। মৃত্যু কালে গ্র্যাচিসের বয়স হয়েছিল ৮৮ বছর।
১৯২৩ সালে দিমিত্রি গ্র্যাচিসের জন্ম গ্রিসে। ছোট থেকেই বাড়িতে শিল্পচর্চার পরিবেশ ছিল তাঁর। বাবা ছিলেন একজন বেহালাবাদক এবং বেহালা প্রস্তুতকারক। ১৯৪৭ সালে বিশ্ব যুদ্ধোত্তর সময়ে গ্রিক শরণার্থী হিসাবেই সান ফ্রান্সিসকোতে সপরিবারে চলে আসেন তাঁর বাবা। সেখানেই একটি গ্রিক নাইটক্লাবের ব্যান্ডে বেহালা বাজাতেন তিনি। সান মাতিও-র একটি স্কুলে ভর্তি হলেও খুব বেশিদিন পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারেননি দিমিত্রি গ্রাচিস। পরবর্তীকালে জানা গিয়েছিল সেসময় ডিসলেক্সিয়ায় আক্রান্ত ছিলেন তিনি। আর সেই কারণে যে কোনো লেখাই পড়তে সমস্যা হত তাঁর।
স্কুলে ভর্তি হওয়ার এক বছরের মধ্যেই পড়াশোনার পাঠ শেষ করে গ্রাচিস যোগ দেন মার্কিন নৌবাহিনীতে। কাজ ছিল র্যা ডারের পরিচালনার। র্যা ডারের স্ক্রিনে ভেসে ওঠা জ্যামিতিক আকার এবং কোণের প্রতিকৃতি বিশেষভাবে প্রভাবিত করেছিল তাঁকে। যা পরবর্তীকালে ছাপ ফেলেছিল তাঁর শিল্পকর্মেও।
১৯৫৩ সালে নৌবাহিনীর কাজ ছেড়ে দেন গ্রাচিস। বদলে ক্যালিফোর্নিয়ার স্কুল অফ ফাইন আর্টস, বর্তমান সান ফ্রান্সিসকো আর্ট ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন তিনি। সেখানে পিট মন্ড্রিয়ান এবং অন্যান্য ডাচ চিত্রশিল্পীদের ছবির অনুকরণে আঁকতে থাকেন একের পর এক ছবি। পরিচিত হন পিকাসোর প্রবর্তিত চিত্রশিল্প কর্ম ‘কিউবিজম’-এর সঙ্গে। অনুকরণ করতে করতে তাঁর নিজের শিল্পকর্মেও পরবর্তীকালে স্পষ্টভাবেই ঢুকে পড়ে কিউবিজম। জ্যামিতিক আকারের মাধ্যমে অবয়ব এবং বিমূর্ত চিত্রকলার কাজ শুরু করেন গ্রাচিস। উল্লেখ্য, গ্রাচিসই তৎকালীন সময়ে ক্যালিফোর্নিয়ার একমাত্র শিল্পী, যিনি কাজ করেছেন এই কিউবিজমের ওপরে। যদিও নিউইয়র্কে কিউবিজমের চর্চা ছিল সে সময়ে। তবে তা হাতে গোনা।
আরও পড়ুন
নিজের দাড়ির চুল দিয়ে তৈরি তুলিতেই আঁকা ছবি, আন্তর্জাতিক সম্মান হিমাচলের শিল্পীর
মূলত নিজের আঁকা ছবি এবং তৎকালীন তরুণ চিত্রশিল্পীদের শিল্পকর্ম প্রদর্শনের জন্যই তিনি তৈরি করে ফেলেছিলেন সম্পূর্ণ একটা গ্যালারি— স্পাটসা গ্যালারি। যা হয়ে উঠেছিল ১৯৫০-এর দশকে বিট মুভমেন্টের সঙ্গে জড়িত উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের অন্যতম ভরসার জায়গা। তাঁদের মধ্যে অনেকেরই কেরিয়ার শুরু হয়েছিল এই গ্যালারির হাত ধরেই। আর তাই হয়তো গ্রাচিসের ব্যক্তিগত এই দর্শন না থাকলে জন্মলগ্নেই মারা যেত বিট মুভমেন্ট।
স্পাটসা গ্যালারিতেই হয়েছিল খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী ব্রুশ কনারের প্রথম একক প্রদর্শনী। তাছাড়া নিয়মিত এই গ্যালারিতে প্রদর্শনী হত জোন ব্রাউন, ম্যানুয়েল নেড়ি, রায় ডিফরেস্ট, মাইকেল ম্যাকলিউর, জে ডেফির মতো শিল্পীদের ছবি। তবে শুধু প্রদর্শনীই নয়, শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে ছবি প্রদর্শনীর জন্য আদর্শ পরিবেশও তৈরি করে দিতেন উদারমনা গ্রাচিস। চলত শৈল্পিক উন্মত্ততা। এমনকি শেষকৃত্যের ওপর আঁকা একটি ছবির প্রদর্শনী করানোর জন্য গ্যালারিতে আস্ত কফিন এনে উপস্থিত করেছিলেন গ্রাচিস।
আরও পড়ুন
নিজের আঁকা ছবিকে চালালেন ‘অরিজিনাল ভেরমিয়ার’ বলে; শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ প্রবঞ্চক মীগরে?
তবে আজ যে বিট মুভমেন্ট ইতিহাসের অন্যতম এক অধ্যায়, যাকে নিয়ে আগ্রহের শেষ নেই চিত্রশিল্পপ্রেমীদের— সেই আর্ট ফর্ম তখনও জনপ্রিয়তা পায়নি সেভাবে। কাজেই সঙ্গী হয়ে উঠেছিল আর্থিক অনটন। পাশাপাশি গ্যালারি চালাতে গিয়ে বন্ধ হতে বসেছিল নিজের শিল্পকর্মও। সেখান থেকেই এই গ্যালারি ১৯৬১ সালে বন্ধ করে দেন গ্রাচিস।
তারপর শহত ছেড়ে কাজ নেন রেডউড সিটির একটি গ্যাস স্টেশনে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পরে নিজেকে শিল্পের কাছে সঁপে দিতেন গ্রাচিস। কাঠের ব্লকের কাটিং হোক কিংবা সাদা ক্যানভাস— ফুটিয়ে তুলতেন কিউবিজম। বিষয় বস্তু হয়ে ধরা দিত রাজনৈতিক পরিস্থিতি কিংবা সমাজের ভঙ্গুর মেরুদণ্ড। শেষ বয়স পর্যন্ত সেই বোহেমিয়ান সত্তাকেই আঁকড়ে বেঁচেছিলেন গ্রাচিস। করেননি বিবাহও। কাছের মানুষ বলতে ছিল শুধু ছোটো বোনের পরিবার। সপ্তাহান্তে সেখানেই ছুটে যেতেন এই মার্কিন শিল্পী।
বর্তমানে বিট যুগের চিত্রশিল্পীদের মধ্যে একমাত্র জীবিত চিত্রশিল্পী ছিলেন তিনিই। এই ‘শিল্প বিপ্লব’-এর শুধু সৈনিকই নন, গ্রাচিস ছিলেন জীবন্ত ইতিহাসও। কিংবদন্তির মৃত্যুতে খানিকটা ফিকে হয়ে গেল সেই অধ্যায়। তবে বিপ্লবের রং সত্যিই কি ফিকে হয়? বোধ হয় না…
আরও পড়ুন
পথের ধারে ছবির পসরা, নিজের শিল্পকে আঁকড়েই সংসার চলে গোলপার্কের 'ছবি-বুড়ো'র
তথ্যসূত্র—
১. Dimitri Grachis, artist and gallerist who showed work of the Beats, dies at 88, Sam Whiting, Datebook Of Chronicle
২. Cubism, Wikipedia
৩. The Beat Movement, Wikipedia
৪. dimitigrachis.com
Powered by Froala Editor