বদলে যাচ্ছে ইতিহাস পাঠ্যক্রম, এনসিইআরটি ও ইউজিসি’র সিদ্ধান্তে সরব ইতিহাসবিদরা

জর্জ অরওয়েলের উপন্যাস ‘১৯৮৪’। চোখে আঙুল তুলে দেখিয়ে দেয়, ইতিহাস আর অতীত— এই শব্দ দুটি কাছাকাছি অর্থ বহন করলেও, সম্পূর্ণ ভিন্ন। ইতিহাস অতীতের বর্ণনামাত্র। আর ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলেই বদলে যায় সেই বর্ণনা। বিকৃতির আড়ালে ঢাকা পড়ে যায় অতীতের বাস্তব ঘটনা। আর তাতে অধিকাংশ সময়েই মিশে থাকে রাজনৈতিক অভিসন্ধি।

সম্প্রতি ইতিহাসের পাঠ্যক্রম বদলের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনসিইআরটি। পুরনো বই বাতিল করে নতুন বই প্রবর্তনের কথাও ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় শিক্ষা সংগঠনটি। শুধু স্কুলস্তরের পাঠ্যই নয়, কলেজেও ইতিহাসের পাঠ্যেও যে আমূল পরিবর্তন আসছে তা এই মাসের শুরুতেই ঘোষণা করেছিল ইউজিসি। আর সেই কারণে টেনে আনা অরওয়েলের উপন্যাসের প্রসঙ্গ। 

জুলাইয়ের শুরুতেই রাজ্যসভার সচিবালয় থেকে প্রকাশ করা হয়েছিল একটি বিশেষ বিজ্ঞপ্তি। তাতে উল্লেখিত হয়েছিল সামঞ্জস্যহীন ও গুরুত্বহীন তথ্য, জাতীয় নায়কদের সম্পর্কিত বিকৃত মতামত ইতিহাসের পাঠক্রম থেকে বাদ দেওয়ার জন্য বিশেষ সংশোধনের পথে হাঁটবে এনসিইআরটি। পাশাপাশি বিভিন্ন সময়ের ইতিহাসে এবং ঐতিহাসিক নারী চরিত্রদের যাতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেই দিকেই নজর দেবে সংসদের শিক্ষা বিভাগীয় স্ট্যান্ডিং কমিটি।

আপাতদৃষ্টিতে এই পদক্ষেপ কিংবা ঘোষণায় আপত্তিজনক নেই কিছুই। পাঠ্যক্রমে বৈষম্যহীন এই ইতিহাস থাকাই তো কাম্য সকলের কাছে। কিন্তু এই সংশোধন যদি পক্ষপাতদুষ্ট হয়? তবে তার আড়ালে যে ধামাচাপা পড়ে যায় আসল অতীতটাই। আর ঠিক সেই দিকেই এগোচ্ছে পরিস্থিতি। না, কোনো সাধারণ নাগরিক নয়; এই অভিযোগ তুলেছে খোদ ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেস। এই পরিবর্তন আনতে যে ন্যূনতম কোনো জাতীয় বা আন্তর্জাতিক ইতিহাসবিদদের পরামর্শ নেওয়া হয়নি। বদলে সেখানে নতুন ইতিহাসের পাঠ্যক্রম তৈরিতে সর্বাঙ্গে প্রাধান্য পেয়েছে রাজনীতিবিদদের মতামত। ভারতীয় ইতিহাস কংগ্রেসের অভিযোগ এমনটাই। 

আরও পড়ুন
গার্হস্থ্য হিংসা রুখতে পাঠ্যপুস্তকে বদল, মহিলাদের জন্য বিশেষ আদালতও গড়ছে কেরালা

সম্প্রতি প্রায় শতাধিক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ঐতিহাসিকই একজোট হয়ে প্রতিবাদ জানালেন রাজ্যসভার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। লিখিত চিঠি পাঠালেন পার্লামেন্টের শিক্ষা বিভাগীয় স্ট্যান্ডিং কমিটির কাছে। দাবি, প্রস্তাবিত পরিবর্তনের অধিকাংশটাই পক্ষাপাতদুষ্ট, বিকৃত এবং অপ্রাসঙ্গিক। পাশাপাশি রোমিলা থাপার, সতীশচন্দ্র কিংবা বিপানচন্দ্রের মতো খ্যাতনামা ইতিহাসবিদদের লেখা বই বাতিল করা একেবারেই যুক্তিসঙ্গত নয়।

আরও পড়ুন
স্কুল-কলেজে এবার এলজিবিটি সংক্রান্ত পাঠ্যও, ঐতিহাসিক রায় মাদ্রাজ হাইকোর্টের

এনসিইআরটির পাশাপাশি বদলেছে ইউজিসি’র ইতিহাসের সিলেবাস। এবং সেই পাঠ্যক্রম রীতিমতো চমকে দেওয়ার মতোই। কারণ, গোটা সিলেবাসে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত করা হয়েছে মোঘল আমলকে। কেবলমাত্র ঔরঙ্গজেবের কথা উল্লেখিত হয়েছে শিবাজির সঙ্গে দ্বন্দ্বের প্রেক্ষিতে। বাবরকে সূচিত করা হয়েছে ‘ইনভেডর’ হিসাবে। বাদ গেছে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, চড়ক সংহিতার মতো বিষয়। বদলে পুরাণ, বেদ এবং উপনিষদে জোর দেওয়া হয়েছে বিশেষভাবে।

আরও পড়ুন
ইতিহাসের পাঠ্যক্রমে হিন্দুত্ববাদের প্রতিফলন? ইউজিসির বিজ্ঞপ্তি ঘিরে বিতর্ক

তবে স্নাতক স্তরের এই সিলেবাসের থেকেও সমাজে আরও ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলতে চলেছে স্কুলের পরিবর্তিত পাঠ্যক্রম। কেন না, প্রথমিক শিক্ষা স্তর থেকে বিকৃত ইতিহাসের পাঠ সম্পূর্ণ ভ্রান্ত ধারণা তৈরি করবে শিশুদের মননে। যুক্তিবোধ তৈরি হওয়ার আগেই শিশুদের ওপর এহেন বিকৃত ইতিহাস চাপিয়ে দেওয়া একরকম ‘মগজ ধোলাই’-ই নয় কি? আর তা যদি সত্যি হয়, তবে জন্মলগ্ন থেকেই গোঁড়া জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ এবং ধর্মীয় বৈষম্যের বীজ রোপণ করে দেওয়া হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মধ্যে। নীরবেই গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে গণতন্ত্রের মূল স্তম্ভকে। সেই দিকেই কি ক্রমশ এগিয়ে যাচ্ছি আমরা? তবে কি অরওয়েলের সেই ডেস্টোপিয়ান উপন্যাসের প্রেক্ষাপট হয়ে উঠছে ভারত? উত্তর জানা নেই…

Powered by Froala Editor

More From Author See More