গত মার্চ মাসের কথা। বাংলার ঐতিহাসিক পুরাকীর্তি চর্চার দলিলে সংযোজিত হয়েছিল একটি নতুন গ্রন্থ। ‘বাংলার মন্দির মসজিদ টেরাকোটা ও বর্ধমান’। বাংলার স্থাপত্যে কীভাবে জায়গা করে নিয়েছিল টেরাকোটা শিল্প, হারিয়ে যেতে বসা এইসকল ঐতিহাসিক নিদর্শন বর্তমানে কী অবস্থায় টিকে রয়েছে— এ-বিষয় প্রামাণ্য নথি হিসাবেই ধরে নেওয়া যায় এই গ্রন্থকে।
যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী (Yogeshwar Chowdhury)। আঞ্চলিক ইতিহাস চর্চার অন্যতম প্রাণপুরুষ তিনি। বিগত দু’দশকেরও বেশি সময় ধরে ধারাবাহিকভাবে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তের বিস্মৃতপ্রায় অঞ্চলিক ইতিহাসের কথা তুলে এনেছেন তিনি। অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন তরুণ গবেষকদের। এবার ইতি পড়ল সেই বর্ণময় অধ্যায়ে। গতকাল ৮২ বছর বয়সে চিরঘুমের দেশে পাড়ি দিলেন কিংবদন্তি গবেষক।
১৯৪০ সাল। বর্ধমানের ক্ষীরগ্রামে জন্ম ও বেড়ে ওঠা যজ্ঞেশ্বরবাবুর। পরবর্তীতে কর্মসূত্রে চলে আসেন হুগলির উত্তরপাড়ায়। ছিলেন রাষ্ট্রায়ত্ত একটি ব্যাঙ্কের কর্মী। তবে ব্যাঙ্কের কাজ সামলেই ইতিহাসের অনুসন্ধানে আজীবন ছুটে বেরিয়েছেন বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। তথ্য সংগ্রহের হাতিয়ার করে নিয়েছিলেন ক্ষেত্রসমীক্ষাকে।
আশির দশকেই শুরু হয়েছিল তাঁর এই অভিযান। পৈতৃক ভিটে বর্ধমানে। কাজেই নিজের আদি শিকড়ের ইতিহাস জানার কৌতূহল ছিল আজীবন। তবে আঞ্চলিক ইতিহাসের বই বের করাই দুষ্কর হয়ে ওঠে তাঁর কাছে। খানিক খোঁজাখুঁজির পর, তাঁর হাতে আসে বর্ধমানের ম্যাজিস্ট্রেট জে.সি.কে পিটারসনের একটি গ্রন্থ। প্রথমত, পিটারসন ঐতিহাসিক নন। এমনকি ঐতিহাসিক দৃষ্টিভঙ্গিতেও এই গ্রন্থ রচনা করেননি তিনি। বরং, এই বই ছিল একাধিক সরকারি রিপোর্টের একটি সংকলন। তা থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও নথির সন্ধান মিলেছিল ঠিকই, তবে খিদে মেটেনি যজ্ঞেশ্বরবাবুর।
এরপর জেলার ইতিহাস জানতে গবেষক ও অধ্যাপক সত্যনারায়ণ মুখোপাধ্যায়ের শরণাপন্ন হয়েছিলেন যজ্ঞেশ্বর। ক্ষেত্রসমীক্ষা নির্ভর তথ্যসংগ্রহ, গবেষণা ও বিশ্লেষণের পরামর্শও প্রবীণ এই অধ্যাপকের থেকেই পেয়েছিলেন তিনি। বাংলার বেশ কিছু গ্রাম বেছে নিয়ে শুরু হয় তাঁর কাজ। অবশ্য একা নন, ইতিহাস অনুসন্ধানে তাঁর এই অভিযানের সঙ্গী ছিলেন তাঁর বন্ধু হীতেশ সান্যালও।
এই প্রকল্প চলেছিল টানা ৮-৯ বছর ধরে। ১৯৯০, ১৯৯১ ও ১৯৯৪ সালে— যা ধারাবাহিকভাবে তিন খণ্ডে প্রকাশ পায় তাঁর এই বিস্তারিত গবেষণা। এমনকি শেষ খণ্ডটির কাজ চলাকালীন ভলেন্টিয়ারি রিটায়ারমেন্টও নিয়েছিলেন তিনি। দুঃখের বিষয়, যজ্ঞেশ্বরবাবুর এই কাজ দেখে যেতে পারেননি তাঁর বন্ধু। শেষ বয়সেও আক্ষেপ ছিল, হীতেশ সান্যালকে পাশে পেলে আরও সবিস্তারে লিপিবদ্ধ করতে পারতেন জেলার ইতিহাস।
তবে শুধু বর্ধমানই নয়, পরবর্তীতে শ্রীচৈতন্যদেব এবং নবদ্বীপের ইতিহাস নিয়েও একাধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন যজ্ঞেশ্বর চৌধুরী। অভিযোগ ছিল, চৈতন্যদেব সম্পর্কে একাধিক ভুল তথ্য পরিবেশিত হয় বাজারচলতি গ্রন্থে। বছরের পর বছর ধরে ইতিহাসের সঙ্গে লোককথার মিশ্রণই এই ঘটনার অন্যতম কারণ। চৈতন্যের ভারতদর্শন, নীলাচলযাত্রা, মতাদর্শ এবং বাংলায় বৈষ্ণব চর্চা নিয়ে তাই পৃথকভাবে গবেষণায় নেমেছিলেন যজ্ঞেশ্বরবাবু। যার ফলস্বরূপ সংস্কৃতিমনা বাঙালি উপহার পেয়েছে একাধিক প্রামাণ্য গ্রন্থের। তাছাড়াও তিনি কাজ করেছেন শাক্তপীঠ ও রাঢ়ের সংস্কৃতিচর্চা নিয়ে। জেলা বা রাজ্যস্তর তো বটেই, আন্তর্জাতিক মঞ্চেও রীতিমতো নজর কেড়েছিল তাঁর এইসমস্ত গবেষণা।
১৯৯৮ সালে ‘নবদ্বীপ পুরাতত্ত্ব পরিষদ’ আঞ্চলিক ইতিহাসবিদ উপাধিতে সম্মানিত করেন যগেশ্বরবাবুকে। পেয়েছেন ‘ইতিহাসবেত্তা’, ‘প্রজ্ঞানাচার্য’ উপাধিও। বাংলার আঞ্চলিক পুরাকীর্তি সম্পর্কে বক্তৃতা দিয়েছেন বর্ধমান, কল্যাণী, কলকাতা, মালজাবাজার-সহ একাধিক উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। আশ্চর্যের বিষয় হল, ৮২ বছরে পা দিয়েও এতটুকু ঘাটতি ছিল না তাঁর উদ্যমে। শেষ বয়সেও চলত ইতিহাসচর্চা। সেইসঙ্গে আনাগোনা লেগেই থাকত তরুণ গবেষক, ছাত্র-ছাত্রীদের। না, কাউকেই ফেরাতেন না তিনি। তথ্য সরবরাহ করা তো বটেই, উদ্বুদ্ধ করতেন ইতিহাসচর্চার পথে এগিয়ে যেতে। এমন এক ব্যক্তিত্বের প্রয়াণে যেন ‘পথ-প্রদর্শক’ হারাল পরবর্তী প্রজন্মের ইতিহাস অনুসন্ধানকারীরা…
Powered by Froala Editor