ভেঙেছেন গো-মাংস, রামমন্দির নিয়ে প্রচলিত ধারণাও; প্রয়াত ঐতিহাসিক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝাঁ

চলে গেলেন গবেষক, অধ্যাপক এবং স্বনামধন্য ঐতিহাসিক দ্বিজেন্দ্র নারায়ণ ঝাঁ। বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। গত বৃহস্পতিবার ৪ ফেব্রুয়ারি রাজধানী দিল্লিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। গত দু’-এক বছর ধরেই বার্ধক্যজনিত সমস্যায় ভুগছিলেন প্রখ্যাত ঐতিহাসিক। অবশেষে বিদায় জানালেন তিনি। শেষ হল প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাস অনুসন্ধানের এক অধ্যায়।

যে-কোনো সভ্যতার ভিত্তিপ্রস্তর হল ইতিহাস। নিজের শিকড়কে না চিনলে, না জানলে এগোতে পারে না কোনো জাতি। আর সেই কাজটাই করেছিলেন তিনি। পরিচয় করিয়েছিলেন প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় ভারতের সঙ্গে। তার আচার, রীতিনীতি, যাপনচিত্র, শিক্ষাব্যবস্থার ‘অভিনবত্ব’কেই তুলে এনেছিলেন সকলের সামনে। যার পিছনে ছিল নিরলস গবেষণা।

জন্ম ১৯৪০ সালে। তাঁর প্রাথমিক ইতিহাস চর্চা শুরু হয়েছিল এই কলকাতা শহর থেকেই। প্রেসিডেন্সি কলেজে স্নাতকতা সম্পূর্ণ করার পর পাটনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং গবেষণা করেছেন দ্বিজেন্দ্র ঝাঁ। প্রাচীন ভারতের ঐতিহ্য-শিক্ষা-সংস্কৃতি-সমাজের ব্যাপারে তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তাঁর অধ্যাপক ও গবেষক আর.এস. শর্মা। ১৯৭৫ সালে পি.এইচ.ডি সম্পূর্ণ করার পরই তিনি অধ্যাপক হিসাবে যোগদান করেন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে। দীর্ঘ অধ্যাপনা জীবনের পর সেখান থেকেই অবসর নিয়েছিলেন ঐতিহাসিক দ্বিজেন্দ্র ঝাঁ।

ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রে চিরকালই ধর্ম-নিরপেক্ষ, যুক্তিনির্ভর ও তথ্যভিত্তিক পন্থাকেই বেছে নিয়ে পথ হেঁটেছেন তিনি। প্রচলিত চিন্তাধারাকে ভেঙে, তথ্য এবং প্রমাণের ভিত্তিতেই প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন আসল সত্যিকে। আর এই কারণেই বারবার বিতর্ক, কটূক্তি কিংবা হিংস্রতার সম্মুখীন হতে হয়েছে ভারতের অন্যতম এই ইতিহাস-গবেষক।

প্রাচীন ভারতে প্রচলিত ছিল গোমাংস ভক্ষণের রীতি। এই বিষয়ে আলোকপাত করে বিস্তারিত গবেষণা করেছেন দ্বিজেন্দ্র ঝাঁ। তুলে এনেছিলেন ঋকবেদের জীবন্ত প্রমাণও। তাঁর ‘মিথ অফ হোলি কাউ’ গবেষণামূলক গ্রন্থটির কারণে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছিলেন তিনি। এমনকি ব্যক্তিগত আক্রমণের পর্যায়ে চলে যায় অসহিষ্ণুতা। ভারতের ইতিহাসকে বিকৃত করছেন তিনি, অভিযোগ উঠেছিল এমনটাই। 

এই অসহিষ্ণুতার কথাও বার বার উঠে এসেছে তাঁর গবেষণা, বক্তব্যেও। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের ইতিহাসকে বিবেচনা করার সামাজিক মানসিকতাকেও বারবার সমালোচনায় বিঁধেছেন তিনি। মূলত প্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পার উপরে গবেষণা করলেও চিরকাল অখণ্ড ভারতের বিভিন্ন সংস্কৃতির সংমিশ্রণকেই প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন তিনি। সেখানে ইসলামিক সংস্কৃতি হোক কিংবা দক্ষিণের সমাজ— এসেছে সবটাই। অভিমতে প্রকাশ পেয়েছে বিবিধের কথা, সাধারণের কথা। আর সাধারণের কথা বলতে গিয়েই কোথাও যেন তিনি লিখে ফেলেন কঠিন বাস্তবকে। ‘ইতিহাসে উচ্চশ্রেণির কাছে সব যুগই স্বর্ণযুগ। তবে সাধারণের কাছে কোনো যুগই সোনায় মোড়া নয়।’

আরও পড়ুন
মঙ্গলে হেলিকপ্টার ওড়াবেন বাঙালি-সহ তিন ভারতীয়, ইতিহাসে প্রথম

১৯৯১ সালে যখন সারা ভারত উত্তাল বাবরি মসজিদ প্রসঙ্গে, তখন মাত্র যে তিনজন ঐতিহাসিক এগিয়ে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম একজন ছিলেন তিনি। বাবরি মসজিদের জায়গায় পূর্বে যে রামমন্দিরের কোনো নির্মাণ থাকার ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই, সেই বিষয়েই একটি বিশেষ নথি প্রস্তুত করেছিলেন তিনি। তার জন্য যথেষ্ট কটূক্তিও শুনতে হয়েছিল তাঁকে। তবে নিজের সিদ্ধান্ত এবং গবেষণাতেই স্থির ছিলেন দ্বিজেন্দ্র ঝাঁ।

জীবনের শেষ বয়স পর্যন্তও ‘সত্যি’ অনুসন্ধানের এই নেশা এতটুকু কমেনি তাঁর মধ্যে। অসুস্থতা সত্ত্বেও ভারতের বৌদ্ধ ইতিহাসের ওপর গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ রচনা করেছিলেন গত ২০১৮ সালেই। লকডাউনের মধ্যে একাধিক ওয়েবিনারে অংশগ্রহণ করতেও দেখা গিয়েছিল তাঁকে। ইতিহাসের প্রতি এই খিদে নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে আরও কোনো ঐতিহাসিকের উঠে আসতে এখনও বহু সময় লাগবে হয়তো। তবে এই ডামাডোলের সময়ে দাঁড়িয়ে শুধু ইতিহাস অনুসন্ধানের প্রকৃত পথটাই দেখিয়ে দিয়ে গেলেন তিনি। এক্ষেত্রে তিনিই তো স্বয়ং অভিভাবক…

Powered by Froala Editor

আরও পড়ুন
এ-বছরের মতো বাতিল রঞ্জি ট্রফি, ৮৭ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম

Latest News See More