এক শিল্পীর শুরু করা দুর্গোৎসব হয়ে উঠল আদিবাসী মানুষদের মিলন-পরব

লালমাটির দেশে, খোয়াইয়ের একপ্রান্তে হচ্ছে দুগ্‌গাপুজো। অনেকেই অবশ্য বলেন পুজোমেলা। তা পুজোর সময় পুজোই যে হবে, তাতে আশ্চর্য কী? কিন্তু ‘হীরালিনী দুর্গোৎসব’ যে মোটেই আর পাঁচটা দুর্গাপুজোর মতো নয়। এই পুজোর প্রধান কুশীলব তথা উদ্যোক্তারা জাতিতে সাঁওতাল। পুজো এখানে নিছক পুজো নয়, তা আসলে যেন একটা চলমান প্রদর্শনী। পুরোনো প্রতিমা বিসর্জন হয় না এই পুজোয়। এক-এক বছর পুরোনো প্রতিমাদের মধ্যে থেকে এক-একটিকে বেছে নিয়েই করা হয় পুজো। জিজ্ঞেস করলেই উত্তরের বদলে একগুচ্ছ প্রশ্ন মেলে, 'বা রে, ফেলা যাবে কেন? বানাতে শ্রম লাগেনি? সৃষ্টিতে মায়া জোড়েনি?' শান্তিনিকেতনে, সোনাঝুরি বনের প্রান্তে, বনেরপুকুরডাঙা আর বল্লভপুরডাঙা গাঁয়ের সংযোগস্থলে এই পুজো ঘিরে কত যে বিস্ময় দানা বাঁধে।

এবারে পুজো অক্টোবরের একদম গোড়ায়। কলকাতার ভ্যাপসা গরমটা শান্তিনিকেতনে সেভাবে নেই। বৃষ্টিও ‘চেলু দুলায়ে’ আসছে মাঝেমাঝে। রাস্তার দুধারে ইউক্যালিপ্টাস গাছে এসে বসছে কুয়াশা। আর এহেন আবহেই কলকাতা শহর থেকে আড়াই-তিন ঘণ্টার সড়কপথ পেরিয়ে দেখে এলাম ‘হীরালিনী দুর্গোৎসব’।

পুজো শুরু করেছিলেন শিল্পী ও গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজের শিক্ষক বাঁধন দাস। সেটা ২০০১ সাল। বাঁধনদার এক দিদির নাম ছিল হীরা আর বাবা ছিলেন নলিনী দাস। এই দুই নাম জুড়েই ‘হীরালিনী’। কিন্তু এমন একটি পারিবারিক নামকরণের ইতিহাস নিয়েই এই পুজো কেমন করে যেন স্থানীয় সাঁওতাল গ্রামবাসীদের নিজের উৎসবে পরিণত হল। তার কারণ বোধহয় পুজোর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা কর্মকাণ্ড। এই পুজোমেলার রূপকাররা আসেন আশপাশের সাঁওতাল গ্রামগুলি থেকেই। ম্যারাপ বাঁধা, প্রতিমা গড়ায় হাত লাগানো থেকে শুরু করে পুজোর জোগাড়, নাচ-গান-যাত্রায় ওঁরাই প্রধান। ১৯৯০ সালেই বাঁধন দাস সোনাঝুরির জঙ্গলে জমি কিনে একটি স্টুডিও খুলেছিলেন। সে যেন ছিল উৎসবের সলতে পাকানো। এরই দশবছর পর প্রতিবেশী গ্রামের সাঁওতাল মানুষজনকে নিয়ে শুরু হয় দুর্গাপুজো। পুজো নিমিত্ত মাত্র, এ আসলে রংচঙে এক উৎসব। পরব বললেও ক্ষতি নেই।

বনেরপুকুরডাঙা আর বল্লভপুরডাঙার মানুষরা আজও দিব্বি মনে করতে পারেন, সেই প্রথমবার প্রতিমা হয়েছিল পোড়ামাটির। দেখে বিস্ময় আর সরে না। তবে, এই পুজোর বিশেষত্বই তো প্রতিমার গড়ন ও রূপ। এক-এক বছর প্রতিমা হবে এক-এক উপাদানে, মোটামুটি এটাই ছিল শিল্পী বাঁধন দাসের স্বপ্ন। তিনি নিজে টেরাকোটা ও কাঠের প্রতিমা বানিয়েছিলেন প্রথম দু’বছর। তৃতীয় পুজো আর দেখে যেতে পারেননি ষাট ছুঁই-ছুঁই বাঁধন দাস। পুজো অবশ্য বন্ধ হয়নি। তাঁর বোন চিত্রা এবং ভগ্নীপতি আশিষ ঘোষ এই পুজোর দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছেন। বাঁধন দাসের ইচ্ছেকে মর্যাদা দিয়েই এরপর প্রতিমা গড়া হয়েছে যথাক্রমে বাঁশ, মাটি এবং লোহা দিয়ে। আশিষবাবু নিজেও শিল্পী। তিনি ও তাঁর ছাত্ররা মিলেই রূপ দিয়েছেন প্রতিমায়।

বাঁধন দাসের ইচ্ছা ছিল পাঁচবছর পুজো হয়ে গেলে, পরবর্তী বছরগুলোতে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে আগের প্রতিমাতেই পুজোঅর্চনা হবে। এ’বছর পর্যন্ত সে প্রথাই বহাল রয়েছে। নিজের আরণ্যক আবাস তথা স্টুডিওটিকে বড় সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন বাঁধন দাস। পুজোর সময় সেই সৌন্দর্যকে আরো চোখজুড়নো করে তোলেন স্থানীয় মানুষ আর আশিষবাবুর ছাত্ররা মিলে। এই বছর পুজো হচ্ছে লোহার প্রতিমা। গোটা পুজোপ্রাঙ্গণকেই সাজিয়ে ফেলা হয়েছে রং-বেরঙের কাপড় দিয়ে।

এই দুর্গাপুজো যেন মূলনিবাসী, লোকমানুষদের একটি মিলন-উৎসব। প্রত্যেকবছর বিভিন্ন সাঁওতালগোষ্ঠী এমনকি ঝাড়খণ্ড থেকে আসা বিভিন্ন শিল্পীগোষ্ঠী, আঞ্চলিক বাউল সম্প্রদায় এখানে নিজেদের অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন। টাকার বিনিময়ে নয়, এই দলগুলি একদম নিখরচায়, হাসিমুখে, এই অনুষ্ঠান করে। এ যে তাঁদের নিজেদেরই পুজো। ঝাড়খণ্ড থেকে আসা দলটি ঠাঁই নেয় আশিষবাবুর বাড়িতেই। পুজোর কদিন খাওয়া-দাওয়া-আড্ডা-গান-বাজনা-উৎসব। আশিষবাবুর কাছ থেকে জানা গেল, প্রতিবছর পুজোর এই বিপুল আয়োজনের ব্যয়ভারও বহন করে চলেছেন বেশ কিছু শুভানুধ্যায়ী মিলে। গোটা পুজোর গায়ে যে সর্বজনীনতার গন্ধ লেগে তা কলকাতার বারোয়ারি পুজোর চেয়ে অনেকটা আলাদা। জমকের থেকেও এখানে আন্তরিকতা অনেক দামি, অনেক গহীন এই উৎসবের মেজাজ। কোন ম্যাজিকে যে এক শিল্পীর হাতে শুরু হওয়া পুজোকে নিজেদের পুজো বানিয়ে নিলেন আদিবাসী মানুষরা, তা ভাবতে গিয়ে অবাক হন আশিষবাবুও। উত্তর হাতড়ান। কিন্তু, এমন উত্তর কী এতই সহজ দেওয়া!

তথ্যসূত্র: আশিষ ঘোষ।

Latest News See More