তখন সদ্য দেশ স্বাধীন হয়েছে। দেশভাগের ক্ষত তাজা, দগদগে। কাঁটাতারের দুই পাড়ে আশ্রয় খোঁজার জন্য জড়ো হয়েছে বহু মানুষ। সেরকমই এক যুবক ভাগ্যের নদীতে চেপে চলে আসেন ব্যারাকপুর। সেখানকার মণিরামপুর সেন্ট্রাল ইনল্যান্ড ফিসারিজ রিসার্চ স্টেশনে চাকরিসূত্রে যোগ দেন। ওপার বাংলায় জন্ম তাঁর, সিলেটে পড়াশোনা; সেখানেই অধ্যাপনা জীবনও শুরু হয়েছিল। মেধাবী ছেলেটির ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউ কোনো প্রশ্ন করেনি। কিন্তু দেশভাগ সেইসবে দাঁড়ি টেনে দিল বোধহয়…
এমনটাই কি ভাবছিলেন তিনি? ব্যারাকপুরে গঙ্গার ধারে বসে হয়তো মনে আসত বাসার কথা। হঠাৎই দেখলেন, কাছের ইটভাটায় ভেসে এসেছে একটি মাছ। জোয়ারের টানেই বোধহয় চলে এসেছে সে। আরেকটু কাছে গিয়ে দেখেন, মাছের পেটটি ফোলা। নির্ঘাত ডিম দেবে এবার! একটু টিপে ধরতেই বেরিয়ে এল কিছু ডিম। একটা পাত্রে কয়েক ঘণ্টা রেখে দিলেন ওই মাছের ডিমগুলো। তারপরই স্পষ্ট দেখা গেল জীবনের স্পন্দন! এরপরেই যুবকটির মাথায় খেলে গেল বিদ্যুৎ। যার ফল কয়েক বছর পরই দেখতে পেল গোটা ভারত। তখন তিনি কটকে গবেষণার জন্য গিয়েছেন। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর আবিষ্কার করলেন ‘ইনডিউসড ব্রিডিং অফ কার্প’। পৃথিবী এর আগে এমন পদ্ধতি দেখেনি। ভারত তো বটেই, বাংলার প্রাণী গবেষণা ও প্রজননের নতুন পথ খুলে গেল। সিলেটের যুবকটির নাম ছড়িয়ে গেল গোটা বিশ্বে— একমেবাদ্বিতীয়ম ডঃ হীরালাল চৌধুরী!
মাছের সঙ্গে বাঙালির সম্পর্ক চিরন্তন। আর কিছু হোক বা না হোক, খাবার পাতে একটু মাছ হলেই অনেকের হয়ে যায়। আর তার সঙ্গে যদি থাকে মাছের ডিমের বড়া, তাহলে তো কথাই নেই! সেটাই হয়ে উঠেছিল আরেক বাঙালির গবেষণার বিষয়। ডঃ হীরালাল চৌধুরী হয়তো আমাদের কাছে বেশি পরিচিত নাম নন, কিন্তু তাঁর কাজকে সম্মান জানিয়েছে গোটা বিশ্ব। ওপার বাংলার ছেলেটাই পরে হয়ে গেল ‘প্রণোদিত প্রজননের জনক’।
এই প্রণোদিত প্রজনন বা ইনডিউসড ব্রিডিং আসলে কী? সহজ ভাষায় বললে, বাইরে থেকে ইনজেকশনের সাহায্যে মাছের দেহে বিশেষ হরমোন প্রয়োগ করা এবং তার সাহায্যে প্রজনন প্রক্রিয়া চালানো। হরমোন বলতে এমন প্রাকৃতিক হরমোন, যা শরীরে গেলে মাছের কোনো ক্ষতি করবে না। বরং ডিম পাড়তে সাহায্য করবে। এমন কাজের প্রয়োজন হল কেন হঠাৎ? মাছ তো দিব্যি প্রাকৃতিক উপায়তেই ডিম উৎপাদন ও বংশবৃদ্ধি করে থাকে। এখানেই ডঃ হীরালাল চৌধুরী একটি বিশেষ দিকের প্রতি দৃষ্টি আকৃষ্ট করেছেন। এখন বিশ্ব জুড়ে মাছ চাষ করা অত্যন্ত সাধারণ একটি বিষয়। তাদের স্বাস্থ্যের খেয়াল রাখা, বংশবৃদ্ধির দিকে লক্ষ রাখা— এইসবও প্রক্রিয়ার অংশ। দুই বাংলার মতো নদীমাতৃক জায়গায় এর প্রচলন আরও বেশি হবে সেটাই স্বাভাবিক। এইসব জায়গায় অন্যান্য মাছের সঙ্গে কার্প জাতীয় মাছও (যেমন- রুই, কাতলা, মৃগেল, বাটা ইত্যাদি মাছ) থাকে। কিন্তু তাদের প্রজননের ক্ষেত্রে একটা সমস্যা শুরুতে দেখা যায়। বদ্ধ জায়গায় কার্প জাতীয় মাছেরা প্রজনন করে না। পরে পরীক্ষা করে দেখা গেছে, বদ্ধ জলাশয়ে এই হরমোনজনিত কারণেই ডিম উৎপাদন করে না এই মাছেরা।
তাহলে উপায়? উপায় সেই ব্যারাকপুরের গঙ্গার ঘাটেই মাথায় এসেছিল ডঃ হীরালাল চৌধুরীর। বাইরে থেকে হরমোন প্রয়োগ করে, একটি নির্দিষ্ট বিজ্ঞানভিত্তিক নিয়মে মাছ চাষ করলে একসঙ্গে অনেক সুস্থ সবল মাছ পাওয়া সম্ভব। ফলে অনেক মাছের সঙ্গে এক জায়গায় রাখতেও হবে না, আবার প্রজননও সম্পন্ন হবে। এই নিয়ে চলল বিস্তর পরীক্ষা নিরীক্ষা। ১৯৫৭ সালের ১০ জুলাই কটকেই প্রথমবার এই প্রণোদিত প্রজনন বা ইনডিউসড ব্রিডিং পদ্ধতিটির সাফল্য প্রমাণ করেন হীরালালবাবু। তারপর বহু দেশে এই প্রক্রিয়া নিয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। আজ স্কুলপাঠ্য হিসেবেও তাঁর এই আবিষ্কার পড়ানো হয়। মাছ চাষের গোটা ছবিটাই বদলে দিলেন তিনি। তকমা পেলেন ‘Father of Induced Breeding’-এর।
জীবনের নানা সময় নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকেছেন। দেশভাগের পর ব্যারাকপুরের যে কেন্দ্রীয় গবেষণা সংস্থা থেকে যাত্রা শুরু করেছিলেন, পরে সেখানকারই অধিকর্তা হন। জাতিসংঘের হয়ে বিশ্বের নানা দেশে কাজ করেছেন। ১০ জুলাই তিনি প্রণোদিত প্রজনন পদ্ধতির আবিষ্কার করেছিলেন বলে এই দিনটিকে ভারত সরকার চিহ্নিত করেছেন ‘জাতীয় মৎস্যজীবী দিবস’ হিসেবে। মৃত্যুর ছয় বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরও ডঃ হীরালাল চৌধুরীর অবদানকে অস্বীকার করতে পারি কি আমরা? অথচ ক’জন মনে রেখেছি? মাছে-ভাতে বাঙালির সঙ্গেই তিনি বেড়ে উঠবেন আজীবন ধরে। সেই সঙ্গে অনুপ্রাণিত করে যাবেন আরও অসংখ্য বিজ্ঞানীকে।
আরও পড়ুন
যোগ্যতা সত্ত্বেও সুযোগ পাননি টেস্ট দলে, বাঙালি-বঞ্চনার শিকার ছিলেন গোপাল বসু?
Powered by Froala Editor