কাঙ্গিতেন - জাপানি গণেশ নাকি প্রাচীন বৌদ্ধতন্ত্রের দেবতা?

রাত পোহালেই গণেশ চতুর্থী (Ganesh Chaturthi)। মহারাষ্ট্র তো বটেই, ভারতের অন্যান্য অঞ্চলেও প্রস্তুতি তুঙ্গে। পুরাণমতে গণেশের জন্মবৃত্তান্ত এবং অন্যান্য ঘটনার কথা তো মোটামুটি সকলেই জানি। কিন্তু জানেন কি, ভারতের বাইরেও নানা দেশে সন্ধান পাওয়া যায় গণেশের মতোই অন্যান্য দেবতার হদিশ?

জাপানের টোকিওর আসাকুসা অঞ্চলে প্রাচীন জাপানি বৌদ্ধ ধর্মের একাধিক সুন্দর কাঠের মন্দির রয়েছে, যেগুলি দেখতে সারাবছর স্থানীয় এবং দেশ-বিদেশের দর্শনার্থীদের ভিড় লেগেই থাকে। জাপানের প্রাচীনতম এই মন্দিরগুলির মধ্যে অনেকগুলি মন্দিরই বেশ কয়েক হাজার বছরের পুরনো। এরমধ্যে একটি মন্দির দেখলে স্বভাবতই খটকা জাগবে ওই দর্শনার্থীদের মধ্যে কোনও ভারতীয় দর্শক থাকলে। সেটি হল অষ্টম শতকের মাতশুচিয়ামা শোটেন মন্দির  যেখানে অধিষ্ঠান করেন জাপানি দেবতা কাঙ্গিতেন। এই দেবতার বিগ্রহ দেখলে কোনোভাবেই সেটিকে হিন্দু দেবতা গণেশের জাপানি সংস্করণ ছাড়া আর কিছু মনে হবে না। প্রকৃতপক্ষে এই দেবতাকে উৎসর্গ করেই জাপানে আড়াইশোরও বেশি মন্দির রয়েছে। এই মন্দিরগুলিতে তিনি স্থানীয় ভাবে কাঙ্গিতেন, শোটেন, গণাবাচি অথবা বিনায়কেতন নামে পরিচিত। লক্ষনীয়, এক্ষেত্রেও হিন্দু দেবতা গণপতি নামের সঙ্গে যেন কী ভীষণ মিল জাপানি দেবতা গণাবাচির! গণপতি তো সিদ্ধিতারাও আরেক নাম বটে।

বৌদ্ধ ধর্মের ‘শিঙ্গন’ বা ‘মন্ত্র’ শাখার অংশ হিসেবে দেবতা কাঙ্গিতেনের উপাসনা জাপানে প্রথম শুরু হয় অষ্টম কিংবা নব শতকে। এটি আসলে বৌদ্ধ ধর্মের একটি তান্ত্রিক রূপ যার আসলে উদয় হয়েছিল ভারতবর্ষের ওড়িশাতে। প্রাচীন ওড়িশা থেকেই চিন হয়ে জাপান পৌঁছয় তা। জাপানি পন্ডিত কুকাইয়ের হাত ধরেই এই শিঙ্গন বৌদ্ধ ধর্ম প্রচলিত হয়েছিল জাপানে। ৮০৪ খ্রিস্টাব্দে চিনে গিয়ে এই ব্যাপারে জানতে পেরে তিনি ভারতে চলে আসেন এই তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম শিখতে। নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিখ্যাত বৌদ্ধ পন্ডিত প্রাঞ্জা বা প্রঞ্জার সঙ্গে সাক্ষাৎ হয় তাঁর।

এর পরের দশকটি হল কুকাইয়ের জাপান ফিরে আসা এবং হিন্দু দেবদেবীদের সঙ্গে ভারতে শেখা তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের মিশেল ঘটিয়ে এক নয়া শিক্ষার প্রবর্তন করার সময়। যদিও শিঙ্গন বৌদ্ধধর্মে কাঙ্গিতেনকে প্রাথমিক ভাবে খুব গুরুত্বপূর্ণ দেবতা বলে মানা হত না। কিন্তু পরবর্তীতে জাপানের ‘ধ্রুপদী সুবর্ণযুগ’ হেইয়ান পিরিয়ডে (৭৯৪-১১৩৫ খ্রিস্টাব্দ) কাঙ্গিতান একজন প্রধান দেবতার সম্মান পেয়ে থাকেন। ‘শো কাঙ্গিতেন শিকিহো’ বা ‘কাঙ্গিতেনের আচার’ নাম দিয়ে দেবতার পূজাপাঠ সংক্রান্ত গ্রন্থও রচনা হয়েছিল বলে খোঁজ পাওয়া যায়।

কাঙ্গিতেনের রূপটি এক্ষেত্রে উল্লেখের দাবি রাখে। জাপানি আইকনোগ্রাফিতে সবসময় কাঙ্গিতেনকে দেখা যায় একটি স্ত্রী হাতিকে জড়িয়ে থাকতে। হস্তিনীটিকে দেবতার ‘শক্তি’ বা ‘নারী শক্তি’ বলে উল্লেখ করা হয়ছে। তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মে দেব-দেবীদের এমন মিলনরত মূর্তি দেখাই যায়, যেটিকে নারী ও পুরুষ শক্তির মিলন বলে ব্যাখ্যা করা হয়েছে। কাঙ্গিতেনের এই ইরোটিক মূর্তির জন্যই অনেকসময়ই এটিকে কাঠের বাক্সে রাখা হয়।

অনেকটা ভারতীয় গণপতির মতোই, কাঙ্গিতেনকেও শুরুতে বাধা সৃষ্টিকারী দেবতা হিসেবে গণ্য করা হত, ঝামেলা এড়াতে উপাসনা করতেই হত যাঁর। কিন্তু ধীরে ধীরে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের দেবতা হিসেবে মানা হতে থাকে। আমাদের সিদ্ধিদাতা গণেশের মতোই ব্যবসায়ীরা ধন এবং আর্থিক সাফল্যের জন্য প্রার্থনা করে থাকতেন কাঙ্গিতেনের।

আরও পড়ুন
রাধাবিনোদ পালের চরিত্রে অভিনয় ইরফানের, যে বাঙালির কাছে আজও কৃতজ্ঞ জাপানিরা

আরও একটি মতে, কাঙ্গিতেন আসলে একটি যুগল মূর্তির নাম। গনেশের অপর নাম ‘বিনায়ক’ ছিল, কারণ নিরীহের কাজে বিঘ্ন ঘটিয়েই তিনি আনন্দ পেতেন। বিনায়কের এই ধ্বংসাত্মক রূপ দেখে তাঁর ভাই, যিনিও অলৌকিক শক্তির অধিকারী ছিলেন, উপায় নিলেন অন্য একটি পন্থার। নারীর রূপ ধরে বিনায়ককে যৌনক্রীড়ায় প্রলোভিত করেন তিনি। আলিঙ্গনে ধরা দিতেই বিনায়কের শরীর এবং মন শান্ত হয়ে আসে। এর মাধ্যমে হয়তো বৌদ্ধ ধর্মের শান্তিকামী কল্যাণকর দিকটিকেই স্বীকার করে নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সেই থেকেই এই যুগল মূর্তিকে পুজো করা হয় কাঙ্গিতেন নামে।

কাঙ্গিতেন দেবতার সবথেকে সক্রিয় কেন্দ্র হল দক্ষিণ জাপানের ওসাকা শহরের বাইরে ইকোমা পর্বতমালার পূর্ব ধাপে অবস্থিত হোজানজি মন্দির। বলা হয় যে, ১৭ শতকে বিখ্যাত জাপানি সন্ন্যাসী টংকাইয়ের অপর নাম ছিল হোজান। অনেক উপাসনার পরেও কিছুতেই অতিপ্রাকৃত শক্তির সিদ্ধি লাভ হচ্ছিল না তাঁর। দেবতা কাঙ্গিতেন বারংবার বাঁধা সৃষ্টি করেছিলেন তাঁর সিদ্ধিলাভের পথে। কথিত আছে যে, অবশেষে ১৬৭৮ সাল নাগাদ তাঁর গুরু তাঁকে বলেন যে, ইকোমা পর্বতের গায়ে কোথাও এরকম একটি ‘অলৌকিক’ জায়গা আছে যা হল ‘না স্বপ্ন না বাস্তব’। এই সময় গুরুর কথা অনুযায়ী হাতির দেবতাকে প্রসন্ন করতে টংকাই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, তিনি একটি হাতির মাথা যুক্ত দেবতার মূর্তি তৈরি করবেন এবং তাঁকে এই পার্বত্য অঞ্চলের রক্ষাকর্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করবেন। বদলে তিনি চেয়ে নিয়েছিলেন তাঁর সিদ্ধির পথে সকল বাধা যেন দূর হয়ে যায়।

আরও পড়ুন
মহামারী ছড়িয়েই বিশ্বযুদ্ধে বাজিমাত, আমেরিকা ধ্বংসের ভয়ঙ্কর পরিকল্পনা জাপানের

শিষ্যদের নিয়ে ১৬৮০ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরটি গড়ে ওঠে। ওসাকা শহরের ব্যবসায়ীরা সিদ্ধি লাভের জন্য এই মন্দিরে ভিড় জমাতে শুরু করলে, প্রসিদ্ধি বাড়তে থাকে মন্দিরটির। এতটাই জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এই মন্দির, যে যাতায়াতের সুবিধার জন্য প্রথম ১৯১৮ সালে এখানে জাপানি কেবল কার চালু করা হয়। দু’টি ভিন্ন দেশে একই রকম দেখতে দুই দেবতাকে ঘিরে এমন উন্মাদনা আশ্চর্য করে বইকি!

Powered by Froala Editor

More From Author See More