সংস্কৃতের সঙ্গে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণীতেই পরিচয় হয়ে যায় বাংলা মাধ্যমের ছাত্র-ছাত্রীদের। তাদের অনেকেরই হিন্দি ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতে সমস্যা হলেও, হিন্দি লেখা পড়তে ততটাও ধাক্কা খেতে হয় না, এ কথা একেবারেই সত্যি। কারণ, হিন্দি (Hindi) ভাষার হরফের সঙ্গে সংস্কৃত ভাষার দেবনাগরী হরফের মিল পাওয়া যায় ভীষণরকম। তবে হিন্দিতে ব্যবহৃত শব্দের দিক দিয়ে দেখতে গেলে, সংস্কৃতের সঙ্গে তেমন কোনো মিল নেই হিন্দির। বরং অভূতপূর্ব সাদৃশ্য রয়েছে উর্দু বা ফারসি ভাষার সঙ্গে। হিন্দি ভাষার এই দ্বৈতচরিত্র অবাক করায় তো বটেই, প্রশ্ন তোলে হিন্দি ভাষার উৎপত্তি নিয়েও। কারণ, দুটি পৃথক ভাষার স্বতন্ত্র সংমিশ্রণে কোনো ভাষা গড়ে উঠলে এমন দ্বৈতচরিত্র থাকা স্বাভাবিক নয় একেবারেই।
উনিশ শতকের শেষের দিকে আইরিশ ভাষাবিদ জর্জ গ্রিয়ারসন তাঁর লেখা ‘দ্য মডার্ন ভার্নাকুলার লিটারেচার অফ হিন্দুস্থান’ গ্রন্থে হিন্দির বিষয়ে তিনি বলেছেন “উনিশ শতকের শুরুতে ভারতে জন্ম নিয়েছিল অতীব সুন্দর একটি সংকর ভাষা। ইউরোপীয়দের হাত ধরে জন্ম নেওয়া এই ভাষা পরিচিত ছিল ‘হিন্দি’ নামে”। এই বইতেই উল্লেখ পাওয়া যায়, ১৮০৩ সালে লাল্লুজি লাল হিন্দি ভাষাতে লিখেছিলেন ‘প্রেম সাগর’, ভাষাবিদ জন গিলখ্রিস্টের তত্ত্বাবধানে। তবে এই গ্রন্থ মূলত লেখা হয়েছিল উর্দু-মিশ্রিত ভাষায়। তবে তার অনুসর্গ, উপসর্গ এবং বিশেষ্যের জায়গায় ব্যবহৃত হয়েছিল ভারতীয় মূল শব্দ।
অর্থাৎ, জর্জ গ্রিয়ারসনের লেখা এই বই থেকে উঠে আসে আধুনিক হিন্দির জন্ম হয়েছিল প্রায় দু’ শতক আগে। তার আগে এই ভাষার অস্তিত্ব ছিল না। হিন্দি প্রকাশনা সংস্থা ‘বাণী প্রকাশন’-এর পেজেও হিন্দির বিষয়ে বিবৃতি দেওয়া রয়েছে, “সমসাময়িক হিন্দি ভাষা জন্ম নিয়েছিল আধুনিক সময়ে।” কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়, কে এই জন গিলখ্রিস্ট? কীভাবেই বা তাঁর হাত ধরে সৃষ্টি হল আধুনিক ভারতের ‘অতি প্রচলিত’ এই ভাষার? আর হিন্দি যদি উনিশ শতকেই সৃষ্টি হয়ে থাকে তবে ভারতীয় ভূখণ্ডে তার আগে কী ভাষাই বা প্রচলিত ছিল?
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক ডাক্তার জন ফ্রায়ার ১৬৭৩ সালে লেখেন, “ভারতীয় সম্রাটদের সভা-ভাষা হল পার্সিয়ান। তবে সাধারণ মানুষের যোগাযোগের জন্য ব্যবহৃত হয় ‘ইন্দোস্থানি’ ভাষা। যার লিখিত গঠনটি পরিচিত ছিল ব্যানিয়ান নামে। পার্সিয়ান এবং স্ক্যাভোনিয়ান ভাষার সংমিশ্রণে গঠিত এই ভাষা ভারতের অন্যতম একটি উপভাষা”।
তবে জন ফ্রায়ারেরও আগে ভারতে আগত প্রথম ব্রিটিশ অভিযাত্রী থমাস ক্যারিওটের এই ইন্দোস্থানি ভাষায় দক্ষতা ছিল অপরিসীম। সাধারণের সংযোগের এই ভাষায় তিনি অনায়াসেই মহিলাদের সঙ্গে ঝগড়া চালিয়ে যেতে পারতেন বলেও উল্লেখ পাওয়া যায় জন ফ্রায়ারের লেখায়। আঠারো শতকে এই ভাষাকেই উল্লেখ করা হয়েছে ‘মুরস’ নামে। পরবর্তীকালে যা ‘হিন্দোস্থানী’ ভাষা বলেই খ্যাত ছিল ভারতীয় ভূখণ্ডে।
তবে খেয়াল করলে দেখা যায় জন ফ্রায়ার এবং পরবর্তী সময়ে জর্জ গ্রিয়ারসন দু’জনেই ‘ইন্দোস্থানী’-কে বলেছেন ‘ডায়ালেক্ট’। অর্থাৎ আঞ্চলিক উপভাষা। এই ‘আঞ্চলিক’ বলার কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, ব্রজভাষা এবং অবধি প্রচলিত ছিল উত্তরভারতের বেশ কিছু অংশে। তবে তা সহজবোধ্য ছিল না। দিল্লির পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে প্রচলিত ছিল খড়ীবোলী ভাষা। অন্যদিকে মোঘল শাসকরা ব্যবহার করতেন ফারসি। এই সবগুলি ভাষার সংমিশ্রণে সহজকথ্য শব্দের ব্যবহারেই তৈরি হয়েছিল ‘ইন্দোস্থানি’ ভাষা। ১৬২৩ সালে জটমল কবিশ্বরের গ্রন্থ ‘গোরা বাদল কী কাথা’-তে এই খড়ীবোলী সংমিশ্রণের ব্যবহার ব্যাপকভাবে চোখে পড়ে।
আরও পড়ুন
তাঁর হাত ধরেই হিন্দি নাটকে অভ্যস্ত হয়েছিল বাঙালি, উষার প্রয়াণে শেষ হল একটি অধ্যায়
এবার আসা যাক জন গিলখ্রিস্টের প্রসঙ্গে। একজন স্কটিস সার্জেন এবং স্বঘোষিত ভাষাবিদ ছিলেন জন গিলখ্রিস্ট। রয়্যাল নেভি’র সঙ্গেই তিনি ভারতের মুম্বাইয়ে এসেছিলেন ১৭৮২ সালে। পরবর্তীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিতে অ্যাসিস্ট্যান্ট সার্জেন হিসাবেই কাজ নেন তিনি। কর্মসূত্রে ভারতের বিভিন্ন অংশে ঘুরে বেড়ানোর সময় তিনি আকর্ষিত হন কথিত ‘ইন্দোস্থানি’ বা ‘হিন্দোস্থানী’ ভাষায়। ১৭৮৫ সালে এই ভাষায় পড়াশোনা ও গবেষণা করার জন্য দীর্ঘমেয়াদি ছুটি চেয়ে কোম্পানিকে চিঠিও লিখেছিলেন তিনি। সেই ছুটি মঞ্জুর হয় ১৭৮৭ সালে। তবে তারপর আর চিকিৎসায় ফেরেননি জন গিলখ্রিস্ট।
কলকাতায় ‘স্টুয়ার্ট এন্ড কুপার’ প্রকাশনা থেকে তাঁর প্রথম বই ‘আ ডিকশনারি : ইংলিশ অ্যান্ড হিন্দোস্থানী’ প্রকাশিত হয় ১৭৮৮-৯০ সালের মধ্যে। তখন শুধুমাত্র বাংলার মধ্যেই আটকে নেই ব্রিটিশ শাসন। বিস্তীর্ণ এলাকায় রাজত্বের জন্য একটা কথিত ভাষার দরকার ছিল তো বটেই। গিলখিস্ট তৎকালীন গভর্নর জেনারেল ওয়েলেসলিকে প্রশাসনিক কাজ এবং যোগাযোগের মাধ্যম হিসাবে হিন্দোস্থানী ব্যবহারের পরামর্শ দিয়েছিলেন।
ব্রিটিশ প্রশাসকদের এই ভাষার শিক্ষাদানের জন্য তাঁর উদ্যোগেই কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম চত্বরে ১৭৯৯ সালে তৈরি হয় ওরিয়েন্টাল সেমিনারি। তার এক বছরের মধ্যেই যা ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের রূপ নেয়। প্রথম অধ্যক্ষ এবং হিন্দোস্থানী ভাষার প্রধান হিসাবে এই কলেজেই অধ্যাপনা করেন জন গিলখ্রিস্ট। লাল্লুজি লাল ছাড়াও বহু তৎকালীন ভারতীয় সাহিত্যিকদের দিয়ে হিন্দুস্থানী ভাষার পরিবর্তিত রূপ ‘হিন্দি’-তে কাজ করান জন গিলখ্রিস্ট। সদ্যজাত আধুনিক হিন্দি ভাষার সেই রূপই সাহিত্যের হাত ধরে ছড়িয়ে পড়ে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে। হিন্দি ভাষার প্রথম দৈনিক ‘উদন্ত মার্তন্ড’ প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকেই ১৮২৬ সালে। এছাড়াও ১৮১৮ সালে হিন্দি ভাষায় লিখিত বাইবেলও প্রকাশ পেয়েছিল কলকাতায়।
আরও পড়ুন
সত্তরের দশকেও হিন্দি-আধিপত্যে জর্জরিত ছিল কলকাতা, জানান দেয় ‘ধন্যি মেয়ে’র দৃশ্য
গিলখ্রিস্ট নিজেও লিখে গিয়েছিলেন খারীবোলী ভাষা থেকেই হিন্দি এবং উর্দু এই দুই ভাষার জন্ম হয়েছে। তবে ভারতীয় সমাজে বৈষম্য এবং বিভেদ সৃষ্টির জন্যও ব্যবহৃত হয়েছিল হিন্দি। ব্রিটিশরাজ হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক বিতর্ককেই উসকে দেয় হিন্দির মাধ্যমে। হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষেরা দেবনাগরী হরফ ব্যবহারের কারণে হিন্দি ভাষাকেই পরবর্তীতে নিজের ভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেন। অন্যদিকে ফারসি বা আরবি লিপির সঙ্গে উর্দুর মিল থাকায় মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষেরা ব্যবহার শুরু করেন উর্দুর।
আজ ভারতের ২৬ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষাই হল হিন্দি। যদিও তাঁদের কথ্যভাষার গঠন হিন্দি থেকে যথেষ্ট আলাদা। আজও খড়ীবোলী ভাষা, বা প্রাচীন হিন্দোস্থানী ভাষা অবচেতনেই চলে আসে জন্মগত হিন্দিভাষীদের মধ্যেও...
তথ্যসূত্র :
১. Was Hindi Really Created by India's British Colonial Rulers?, Imre Bangha, The Wire
২. Hindi was created by British to divide, isn't common man's language, Markandey Katju, The Week
৩. উইকিপিডিয়া
আরও পড়ুন
হিন্দিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত পরিবেশন বিশ্বভারতীতে, উঠছে বিতর্ক - কতটা যুক্তিযুক্ত?
Powered by Froala Editor