আমি প্রতিবছর হিমালয়ে যাই। গাড়োয়াল হিমালয়। যে রহস্যময়তা এবং আধ্যাত্মিকতার জন্য গোটা পৃথিবীর কাছে হিমালয় বিখ্যাত, মূলত গাড়োয়াল হল সেই স্থান। গাড়োয়ালের ভূ-প্রকৃতির চরিত্র একটু আলাদা। ভঙ্গুর পাহাড় এবং তার গা বেয়ে উঠে চলা পিচের রাস্তা। দূরে আকাশের গায়ে বরফ-সাদা পর্বত দেখতে পাওয়া গেলেও গাড়োয়াল অঞ্চলের যেসব পাহাড়ের গা বেয়ে রাস্তা গড়ে উঠেছে তা মূলত মাটি আর পাথরের মিশ্রণ। ঝুরো মাটি আর পাথরের তৈরি পাহাড় বলে এখানে গাড়ি চলাচলের টানেল গড়ে ওঠেনি। সমস্ত রাস্তাই এখানে পাহাড়ের গা বেয়ে গড়ে ওঠা।
এবার একটু বোঝার চেষ্টা করা যাক, বেশ কয়েকশো বছর ধরে প্রধানত কারা যান এই গাড়োয়ালে? যান মূলত আধ্যাত্মিক এবং আত্ম-অনুসন্ধানী মানুষেরা। এখানে চার ধাম (কেদারনাথ-বদ্রীনারায়ণ-গঙ্গোত্রী-যমুনোত্রী) ছাড়াও পঞ্চকেদারের বাকি চারটে কেদার, সপ্তবদ্রীর বাকি ছয়টি বদ্রী রয়েছে। এছাড়াও অসংখ্য ছোটো-বড়ো বিখ্যাত-অখ্যাত মন্দির, বুগিয়াল, তাল এবং উপত্যকা রয়েছে। রয়েছে অগুন্তি ট্রেকপথও। ট্রেকের প্রসঙ্গ উঠতেই বলে নিই, এই যে স্থানগুলির কথা উল্লেখ করলাম, সেগুলিতে বিগত কয়েকশো বছর ধরে মানুষ কীভাবে যেতেন? দিনের পর দিন, মাসের পর মাস অত্যন্ত কষ্ট সহ্য করে পায়ে হেঁটে যেতেন তাঁরা। স্থানীয় গাড়োয়ালি মানুষদের সহায়তায়। সঙ্গে করে খাবারদাবারও নিয়ে যেতেন। থাকার হোটেল ছিল না। হাঁটা রাস্তার পাশে বেশ কয়েক কিলোমিটার অন্তর অন্তর চট্টি (পাথরের তৈরি থাকার ঘর) থাকত। সেখানে সঙ্গে করে নিয়ে আসা কম্বল পেতে, গায়ে চাপিয়ে ঘুমোতে হত। রান্না করে খেতে হত। প্রকৃতির ডাক মেটাতে যেতে হত জঙ্গলে। কৃচ্ছ্রসাধন বলতে যা বোঝায়, ঠিক তাইই করতে হত। পথেঘাটে অনেক মানুষের মৃত্যুও হত তাই।
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়। সত্তর আশি বছর আগেও এমন হত। দুর্গম হিমালয়ে প্রাণপাত কষ্ট করে দলে দলে মানুষ পৌঁছে যেতেন ইষ্টদেবতার মন্দিরে। একেই বলা হত - তীর্থযাত্রা। এমনও শোনা যায়, হিমালয়ে যাত্রা করার আগে অনেকে নিজের শ্রাদ্ধশান্তিও করে যেতেন, যদি পথেই মৃত্যু হয় সেই আশঙ্কায়! অনেকক্ষেত্রে হতও তাই। পথশ্রমের ক্লান্তিতে, অসুখের প্রকোপে অথবা হিংস্র পশুর আক্রমণে প্রাণহানি হত। সব মিলিয়ে সে এক রোমাঞ্চকর যাত্রার চল ছিল এই অঞ্চলে। গাড়োয়াল হিমালয়কে যিনি বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন, সেই উমাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের লেখা বইতে বারংবার এরকম কাহিনি পাওয়া যায়। এসব কারণেই এই গাড়োয়ালকে দেবভূমি বলা হয়। দেবতার কাছে যাওয়ার জন্য জীবন বাজি রেখে হেঁটে চলা।
দিন বদলেছে। মানুষের চাহিদা বদলেছে। দেশকাল সমাজের পরিস্থিতিও বদলেছে। আজ থেকে একশো দুশো বছর আগে যে জিনিস চলতো সেটা এখন চলতে পারে না। মানুষের প্রয়োজনেই গাড়ি চলার রাস্তা গড়ে উঠেছে। আগে কেদারনাথ যাওয়ার জন্য হাঁটা শুরু করতে হত হৃষীকেশ থেকে। এখন গাড়ি যায় গৌরীকুণ্ড অবধি। অর্থাৎ দুশো কিলোমিটারেরও বেশি রাস্তা গাড়ি করে চলে যাওয়া যায় অনায়াসে। তারপর হাঁটতে হয় কেদারনাথের দিকে। শুরু হয়েছে হেলিকপ্টার সার্ভিসও। বদ্রীনারায়ণ এবং গঙ্গোত্রী মন্দির অবধি গাড়ি যায় এখন। যমুনোত্রী যাওয়ার পথেও হনুমান চট্টি অবধি রাস্তা রয়েছে। মোটামুটি যতদূর পর্যন্ত গাড়ি চলার রাস্তা বানানো সম্ভব প্রায় ততদূর অবধি রাস্তা বানিয়ে দিয়েছে সরকার। যাত্রীদের স্বাছন্দ্যের দিকে তাকিয়েই এসব করা হয়েছে। এছাড়াও আর একটি কারণ রয়েছে। সেটি হলো সীমান্ত-সুরক্ষা। যেহেতু গাড়োয়াল হিমালয়ের সীমানায় আন্তর্জাতিক বর্ডার রয়েছে, তাই সেনাবাহিনীর যাতায়াতের প্রয়োজনে রাস্তাঘাটসহ পরিকাঠামোর উন্নয়ন করতে হয়েছে সরকারকে। সুবিধে হয়েছে দুর্গম পাহাড়ের কোলে থাকা গ্রামগুলিরও। এগুলি সবই প্রয়োজনের দিক, অস্বীকার করার উপায় নেই। এই গাড়ি চলার রাস্তা গড়ে ওঠার সত্যিই প্রয়োজন ছিল।
আরও পড়ুন
নন্দাদেবীতে ভাঙন, ভয়াবহ তুষারধস উত্তরাখণ্ডে, নিখোঁজ ১৫০
কিন্তু আধ্যাত্মিক যাত্রী এবং ট্রেকিংপ্রিয় মানুষদের পাশাপাশি এখন সারা বছর ধরে ভিড় করছেন আরামপ্রিয় টুরিস্টরা। সেই বেড়ে চলা পর্যটকদের পরিষেবা দিতে গোটা গাড়োয়ালে গড়ে উঠেছে অসংখ্য ছোটো-বড়ো থাকার হোটেল, হোমস্টে ইত্যাদি। আধুনিক জীবনের স্বাদ পেতে শুরু করেছেন স্থানীয়রাও। কিন্তু প্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ কোথা থেকে পাওয়া যাবে? শুরু হয়েছে একের পর এক নদীতে বাঁধ দিয়ে সেখান থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের কাজ। শ্রীনগর অথবা তেহরির মতো কয়েকটি ড্যামের বাস্তবিক প্রয়োজন থাকলেও এখন যেখানে সেখানে বাঁধ দিয়ে বিভিন্ন নদীর গতিকে আটকে দেওয়া হচ্ছে। চলছে ঋষিকেশ থেকে কর্ণপ্রয়াগ অবধি রেল প্রজেক্টের কাজ। গাড়িতে করে গেলেই বোঝা যায় পাহাড় কতটা ভঙ্গুর, সেখানে রেলওয়ের চাপ পাহাড় কীভাবে নেবে জানা নেই। শুরু হয়েছে পর্যটকদের সুবিধার্থে চারধাম অল-ওয়েদার রোড বানানোর কাজ। এমন এক চওড়া রাস্তা বানানো হচ্ছে যা দিয়ে সারাবছর চলাচল করা যাবে।
এইসব বিভিন্ন প্রজেক্টের জন্য বিস্ফোরক দিয়ে পাহাড় ফাটানো হচ্ছে। ড্রিল করে পাহাড় কেটে রাস্তা চওড়া করা হচ্ছে। ঝুরো মাটি পাথর আটকানোর জন্য রাস্তার পাশে পাহাড়ের গায়ে লোহার তারের জাল লাগানো হচ্ছে। এত চাপ পড়ছে পাহাড়ে যে সেই লোহার জালসহ ধসও নামছে জায়গায় জায়গায়। অথচ এসব করা হচ্ছে মূলত পর্যটনের প্রয়োজনে, কিন্তু দুর্বল হচ্ছে পাহাড়। ইন্টারনেট জেনারেশনের সুখী পর্যটকদের গাড়ির ভিড়ও বাড়ছে। জ্যাম হচ্ছে। কী পরিমাণ চাপ পড়ছে পাহাড়ে, তা ভাবলেই ভয় লাগে। কিন্তু এসব চাপ কমালেই কি বিপর্যয় আসবে না? অবশ্যই আসবে। হিমালয়ে মেঘ ভাঙা বৃষ্টি, হড়কা বান, তুষারধস, বন্যা এসব খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এগুলো হয়। পাহাড় নিজের মতো করে আবার সব গড়েপিটে নেয়। হাজার হাজার বছর ধরে এসব হয়ে এসেছে। কিন্তু প্রাণহানি কম হত মানুষের এত ভিড় থাকত না বলে।
আরও পড়ুন
উচ্চতা বাড়ল এভারেস্টের, হিমালয়ের কৈশোরই কারণ?
একজন হিমালয় অন্তপ্রাণ হিসেবে একটু অনুভব করেছি, সুখী পর্যটকের ভিড়, অত্যাধুনিক পরিকাঠামো একেবারেই পছন্দ করে না দেবভূমি গাড়োয়াল হিমালয়। দুর্গম প্রাচীনত্বময় প্রকৃতির নিজস্ব আশ্রয়ই এই উচ্চ হিমালয়ের বৈশিষ্ট্য। আধুনিকতার বাড়াবাড়ি দিয়ে একে খর্ব করার চেষ্টা করা হলেই হিমালয় ফুঁসে উঠে সব ধ্বংস করে দেবে। যার ঝলক দেখা গেল গতকালই। ভবিষ্যতে যে আরও বড়ো বিপদ অপেক্ষা করে নেই, সেই নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারে?
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
হিমালয়ের জায়গায় সমুদ্র; তালপাতার জীবাশ্ম আবিষ্কার ভারতীয় ভূতাত্ত্বিকের