পূর্ব মেদিনীপুরের রশুলপুর নদী, তার একপাশে হিজলি ও নিজকসবা গ্রাম আর অন্য পাশে দারিয়াপুর ও দৌলতপুর। তুলনায় বর্ধিষ্ণু হলেও উপেক্ষিত এই অঞ্চলের ইতিহাস কিন্তু উপেক্ষণীয় নয়। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের 'কপালকুণ্ডলা' উপন্যাসের কাহিনিতে অক্ষয় হয়ে থেকে গেছে এই গ্রামগুলির নাম।
১৮৫৮-৫৯ সালে কাঁথির (তৎকালীন নেগুঁয়া) সাব ডিভিশনাল অফিসার হয়ে আসেন বঙ্কিমচন্দ্র। তখনও তিনি বঙ্গসাহিত্যের সম্রাট নন, ব্রিটিশ সরকারের অধীনস্থ সামান্য একজন চাকুরে। মোকদ্দমার সূত্রে বেশ কিছুদিন তাঁকে থাকতে হয় দৌলতপুর গ্রামে। তখনই জন্ম নেয় 'কপালকুণ্ডলা'র কাহিনি। হিজলি গ্রামের প্রাকৃতিক শোভা তাঁকে মোহিত করে। প্রাচীন বন্দরের ভগ্নস্তুপের উপর দাঁড়িয়ে তিনি নিজের মনের কথাই বসিয়ে দেন নবকুমারের মুখে। "আহা! কি দেখলাম! জন্ম জন্মান্তরে ভুলিব না।" সেই সুদর্শন জলরাশির ধারেই আবার দেখলেন নিবিড় নিশ্ছিদ্র অরণ্য। অরণ্যের ভিতর যেন কেউ বলে উঠল, "পথিক, তুমি পথ হারাইছ? আইস।" শুরু হলো উপন্যাসের কাহিনি।
তবে হিজলির ইতিহাস আরও পুরনো। খ্রিস্টীয় সপ্তদশ শতকের পূর্বে এই অঞ্চলে রাজত্ব করতেন উড়িষ্যার গজপতি রাজারা। ১৬২৮ সালে কেলেঘাই আর রশুলপুর নদীকে খাল কেটে যুক্ত করা হয়। তৈরি হয় হিজলি বন্দর। সেই বন্দরকে ঘিরেই গড়ে ওঠে হিজলি রাজ্য। বন্দরে ব্যবসা বাড়তে থাকে, রাজ্যের অর্থনৈতিক শ্রীবৃদ্ধি হয়। দিল্লির সুলতানদের নজরে পড়ে এই রাজ্য। সম্রাট শাজাহানের কাছ থেকে ২৮টি মহল মনসব নিয়ে হিজলির প্রথম ফৌজদার হয়ে আসেন তাজ খাঁ। তাঁর নির্মিত মসজিদ এবং পীরের মাজার এখনও অক্ষত। মাজারকে ঘিরে ফুটে ওঠে হিন্দু-মুসলিম মেলবন্ধনের এক সুন্দর ছবি।
এর কিছু বছর পর আসে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৬৭৯ সালে প্রথম ব্রিটিশ জাহাজ 'ফরণ' এসে থামে হিজলি বন্দরে। কিন্তু বন্দরের দখল নিতে পারে না। ১৬৮৬-৮৭ সালে কিছু সময়ের জন্য বন্দরের দখল নিতে পেরেছিলেন জব চার্ণক। কিন্তু আবার তা চলে যায় মোঘল শাসকদের হাতে। জব চার্ণক তখনও কলিকাতা এসে পৌঁছোননি।
এই হিজলি গ্রামেই ব্রিটিশ সরকার তৈরি করেছিল ডিটেনশন ক্যাম্প (১৯৩০ সাল)। ১৯৩১ সালের ১৬ই সেপ্টেম্বর সেখানে গুলি করে মারা হয় সন্তোষ কুমার মিত্র ও তারকেশ্বর সেনগুপ্ত নামে দুই স্বাধীনতা সংগ্রামীকে। দিনটির কথা মাথায় রেখে 'হিজলি শহীদ দিবস' পালন করেন খড়গপুর আইআইটির পড়ুয়ারা।
তবে এই সমস্ত ইতিহাসের পাশাপাশি, হিজলি গ্রামের কথা মনে করিয়ে দেয় একটি মিথ। কপালকুণ্ডলার মন্দির। যদিও বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাসের তান্ত্রিকের কোনো মন্দির ছিল না। তিনি বালির স্তূপের উপর বসে সাধনা করতেন। কিন্তু গ্রামে গেলেই গ্রামবাসী আপনাকে দেখিয়ে দেবে সেই কিংবদন্তি কালীমন্দির। এমনকি যে মন্দিরে কপালকুণ্ডলা ও নবকুমারের বিবাহ হয়েছিল, এটি সেই মন্দিরও নয়।
তবে মিথ এসব ইতিহাসের পরোয়া করে না। সে জনতার সান্নিধ্য পেয়েই খুশি। এভাবেই ঘটনার ঘটঘটা মিশে রয়েছে মেদিনীপুরের এই জনপদে। শতাব্দীর গণ্ডি তাকে নস্যাৎ করতে পারেনি। পারবেও না…
(তথ্যসূত্র - মেদিনীপুরের ইতিহাস / যোগেশচন্দ্র বসু)