ভিকট্রি স্ট্যান্ডে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দুই অ্যাথলিট। তাঁদের সামনে ট্রে-তে করে পদক নিয়ে হাজির হলেন অলিম্পিকের এক আয়োজক। আর তারপর সেখান থেকে পদক নিয়ে একে অন্যের গলায় পরিয়ে দিলেন দুই অ্যাথলিট। আর মুহূর্তেই দর্শকহীন স্টেডিয়ামও যেন ফেটে পড়ল উচ্ছ্বাসে। আশ্চর্যের বিষয় হল, দুটি পদকই স্বর্ণপদক। অর্থাৎ, একই ইভেন্টে দু’জন চ্যাম্পিয়ন! এও কি সম্ভব? হ্যাঁ, সম্প্রতি এমনই বিরল ঘটনার সাক্ষী থাকল টোকিও শহর। ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ হার মানল ‘বন্ধুত্ব’-এর কাছে।
কাতারের মুতাজ এসা বারশিম এবং ইতালির জিয়ানমার্কো তামবেরি এমনই রূপকথার এক দৃশ্যের জন্ম দিলেন গত পরশু। গোটা ফাইনাল জুড়েই তাঁদের লড়াই চলেছিল সমানে সমানে। দুই হাই-জাম্পারের স্কোরবোর্ডই ফুটে উঠেছিল একই সংখ্যা। ২.৩৭ মিটারের জাম্প। ঠিক হয় ২.৩৯ মিটারের অলিম্পিক রেকর্ড ছুঁতে পারলেই শ্রেষ্ঠ হিসাবে বিবেচিত হবে কোনো একজন অ্যাথলিট। তবে দু’জনেই ব্যর্থ হন সেই রেকর্ড ছুঁতে। পাশাপাশি গোটা টুর্নামেন্টে দু’জনেই নষ্ট করেছেন ৩টি করে সুযোগ। ফলত, সেই নিরিখেও অসম্ভব হয়ে ওঠে বিচার।
ততক্ষণে দু’ঘণ্টা সময় অতিবাহিত হয়েছে ঘড়িতে। স্বাভাবিকভাবেই দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকা পরিশ্রমসাধ্য এই খেলায় ক্লান্ত অ্যাথলিটরাও। কিন্তু তা সত্ত্বেও একপ্রকার বাধ্য হয়েই জাম্প অফের সিদ্ধান্ত নেন আয়োজকরা। অর্থাৎ, একটি করে লাফানোর সুযোগ পাবেন দুই অ্যাথলিট। তাতে যিনি বেশি উচ্চতা দখল করতে পারবেন তিনিই বিজয়ী। এই খেলা চলবে যতক্ষণ না শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণ করতে পারবেন কোনো একজন। ব্যাপারটা অনেকটা ফুটবলের পেনাল্টি-শুটআউটের সাডেন ডেথের মতোই।
না, সেই পর্বে আর গড়াল না খেলা। আয়োজকদের সিদ্ধান্তের পর জাম্প-অফের প্রস্তুতি নেওয়াও শুরু করে দিয়েছিলেন তামবেরি। কিন্তু তারপরেই বদলে যায় ম্যাচের আবহ। ধীর গতিতে বিচারকের কাছে এগিয়ে যান ইসা বারশিম। নিচু গলায় অনুরোধ করেন, যদি পদক ভাগ করে দেওয়া সম্ভব হয় দু’জনের মধ্যে। আশ্চর্যের বিষয় হল, তখনও পর্যন্ত এ ব্যাপারে বিন্দুমাত্রও অবগত নন তামবেরি। খানিক হেসে বিচারক জানান, প্রতিপক্ষের আপত্তি না থাকলে, সম্পূর্ণ সমর্থন রয়েছে তাঁর।
আরও পড়ুন
এ যেন অঘটনেরও অঘটন, প্রথমবার অলিম্পিক সেমিফাইনালে ভারতের মহিলা হকি দল
না, আপত্তি করেননি তামবেরি। কয়েক মুহূর্ত দুই অ্যাথলিটকে শলাপরামর্শ করতে দেখা যায়। তারপরেই দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরে এগিয়ে আসেন ভিকট্রি স্ট্যান্ডের দিক। টোকিও অলিম্পিকে ঘটে যাওয়া এই ঐতিহাসিক ঘটনায় এক কথায় স্তম্ভিত গোটা বিশ্ব। ১৯০৮ সালের পর, দীর্ঘ তার ১১৩ বছরের ব্যবধানে আবার পুনরাবৃত্তি এমন ঘটনার। বিরল বললেও বোধ হয় কম বলা হয় এই ঘটনাকে।
আরও পড়ুন
ছেলেবেলার স্বপ্নপূরণ করতে এসে অলিম্পিকে সোনা গণিতের অধ্যাপকের
২০১৬-র রিও অলিম্পিকে ভয়ঙ্কর চোট পেয়ে ছিটকে গিয়েছিলেন তামবেরি। ভেঙেছিল পায়ের হাড়। এমনকি খেলায় ফেরার সম্ভাবনাও প্রায় ছিল না বললেই চলে। সেখান থেকেই টোকিও অলিম্পিকের ফাইনালে পৌঁছেছিলেন তিনি। আর এই লড়াইয়ের পিছনে ছিল অসম্ভব পরিশ্রম। সেই না বলা কথাটাই হয়তো একজন অ্যাথলিট হওয়ার দরুন বুঝতে পেরেছিলেন এসা। স্বর্ণপদক, শ্রেষ্ঠত্ব ভাগাভাগির সিদ্ধান্ত হয়তো তাই-ই। নিঃশব্দেই জিতে যায় স্পোর্টসম্যান স্পিরিট আর বন্ধুত্ব। আশ্চর্যের বিষয় হল, ক্যালেন্ডারের পাতায় দিনটাও ছিল কিন্তু ১ আগস্ট। আন্তর্জাতিক বন্ধুত্ব দিবস। এ যেন এক অদ্ভুত সমাপতনই বটে!
আরও পড়ুন
অলিম্পিকের সুযোগ হাতছাড়া, তেভাগাই হয়ে উঠেছিল ইলা মিত্রের লড়াইয়ের ময়দান
Powered by Froala Editor