কথায় বলে, মানুষকে হাসানো নাকি সবচেয়ে কঠিন কাজ। সবচেয়ে ভালো কাজও বটে। উল্টোদিকের লোকটি ক্রমাগত মুষড়ে পড়ছে; আর সামনে দাঁড়িয়ে থাকা কালো টুপি পরা, মাছি গোঁফের বেঁটেখাটো মানুষটি নানা অঙ্গভঙ্গি করে যাচ্ছেন। একসময় মানুষটি হেসে উঠল। এটিও একপ্রকার ছোঁয়াচেই! একজন থেকে গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল সেই হাসির ঢেউ। একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইলেন সেই কালো টুপির মানুষটি। তিনিও হাসছেন, তাঁর জন্যই তো এমনটা হল! কিন্তু কেউ জানল না, এই মানুষটির ভেতরটা ফেটে চৌচির হয়ে আছেন। নিজেই ভেঙে আছেন প্রবলভাবে; এক একটা ঝড় তাঁকে দুমড়ে মুচড়ে দিয়েছে। তাও তিনি উঠে দাঁড়িয়েছেন হাসার জন্য, হাসানোর জন্য। চার্লি চ্যাপলিন এরকমই! বহু ছোটো থেকে কষ্টকে কাছ থেকে দেখেছেন, নিজে বারবার বিধ্বস্ত হয়েছেন। কিন্তু ‘দ্য শো মাস্ট গো অন’। মঞ্চে নেমেছেন, ঝড় তুলেছেন বিশ্বে। আবার পরাজিত সৈনিকের মতো ঘরে এসে বসেছেন, একা।
একটা দৃশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়েছিল। চ্যাপলিনের অস্কার প্রদানের ভিডিও। দর্শকরা উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়েছিল। আর মঞ্চে, সোনালি মূর্তিটি আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়েছিলেন চার্লস চ্যাপলিন। সারাজীবন পৃথিবীকে হাসি উপহার দিয়েছিলেন যিনি, তিনি ওইদিন মঞ্চে কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। মনে পড়ছিল পুরনো দিনগুলোর কথা? কীভাবে দারিদ্র্য তাঁদেরকে শেষ করে দিচ্ছিল? মনে কি পড়েছিল হেটি কেলি-কে?
চ্যাপলিনের দিকে একবার ফিরে তাকালে, জীবনের নানা রূপই উঠে আসবে আমাদের সামনে। সেখানে যেমন আছে দুঃখ, আনন্দ, সম্মান, বিতর্ক; তেমনই আছে প্রেম। বারবার প্রেমে পড়েছিলেন চ্যাপলিন, বারবার ভেঙেও গিয়েছিল সেইসব সম্পর্ক। একা থেকে আরও একা হওয়ার দিকে হেঁটেছিলেন তিনি। এই প্রেমের জীবনের শুরুর দিকেই এসেছিলেন হেটি কেলি। আসল নাম হেনরিয়েটা কেলি। দুজনেরই আলাপ সেই তরুণ বয়সে। চ্যাপলিন তখনও ‘দ্য গ্রেট’ হননি। তখনও মঞ্চে মঞ্চে অভিনয় করছেন তিনি। সেই সূত্রেই ১৯০৮ সালে স্ট্রেথাম এম্পায়ারে ফ্রেড কার্নো’র অনুষ্ঠানে উপস্থিত হন তিনি। ‘মামিং বার্ডস’ নাটকে একজন মাতালের ভূমিকায় অভিনয় করেন। সেখানেই একটি ডান্স ট্রুপের অংশ ছিলেন হেটি কেলি। খুব বেশি হলে পাঁচবার একে অন্যের মুখোমুখি হয়েছিলেন সেখানে। খুব বেশি হলে ২০ মিনিটের কথাবার্তা হয়েছিল। কিন্তু হেটি’র স্নিগ্ধ, সুন্দর চরিত্রের প্রেমে পড়তে ওই সময়টুকুই চ্যাপলিনের কাছে অনেক ছিল। তখন তাঁর বয়স ১৯, হেটির ১৫…
পরবর্তীতে আত্মজীবনীতে চ্যাপলিন লিখেছেন, হেটি কেলিই তাঁর জীবনের ‘প্রথম সত্যিকারের প্রেম’ ছিল। কোনোদিনও ভুলে পারেননি তাঁকে। এতই পাগল ছিলেন প্রেমে, যে একসময় বিয়েরও প্রস্তাব দেন তাঁকে। কিন্তু হেটি, অর্থাৎ হেনরিয়েটা সেই প্রস্তাব খারিজ করে দেন। তখন চ্যাপলিনের প্রস্তাব ছিল, তাঁরা যেন দুজন দুজনকে আর না দেখেন। সেটাই বোধহয় সবচেয়ে ভালো হবে। এই প্রস্তাবে সাড়া দিয়েছিলেন হেটি। প্রেমের নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তখন থেকেই আলাপ। কিন্তু হেটি’র স্মৃতি আগলে রেখেছেন চিরকাল। পরবর্তীতে তাঁর ভাই আর্থার কেলিকে নিজের সংস্থা ‘ইউনাইটেড আর্টিস্ট’-এ নিয়ে নেন চ্যাপলিন।
কিন্তু হেটি-র কী হল? এখানেই শুরু হবে আরও একটি বিয়োগান্তক দৃশ্য। ২১ বছর বয়সে তিনি বিয়ে করেন লিউট্যানেন্ট অ্যালান এজার হোরনে-কে। কিন্তু জীবন অন্য গল্প লিখে রেখেছিল। লন্ডনেই চলছিল তাঁদের সংসার। এমন সময় এল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। সেসব কেটে যাওয়ার পর, আমেরিকা ও গোটা ইউরোপে থাবা বসাল স্প্যানিশ ইনফ্লুয়েঞ্জা ফ্লু। রীতিমতো মহামারীর আকার নিল এটি। তার কবলে পড়লেন হেনরিয়েটা ‘হেটি’ কেলিও। শেষরক্ষা হয়নি; ১৯১৮ সালে মারা যান তিনি। তখনও যৌবন ভরপুর তাঁর জীবনে।
এই ঘটনার তিন বছর পর চার্লি চ্যাপলিনের কাছে এই খবর এসে পৌঁছয়। এক লহমায় থমকে যান তারপর থেকে, শুধু স্মৃতি ধরে রাখাই ছিল কাজ। চ্যাপলিনরা বোধহয় এভাবেই প্রতিবার ভাঙেন। প্রতিবার একা ঘরে কেঁদে ওঠেন। তারপর সূর্য উঠলে, বাক্স পোঁটলা নিয়ে বেরিয়ে পড়েন হাসির জগতে। ভেতরে তখন রক্ত ঝরছে প্রবল। দ্য শো মাস্ট গো অন…
Powered by Froala Editor