“My Country! In the days of Glory Past
A beauteous halo circled round thy brow
And worshiped as deity thou wast,
Where is that Glory, where is that reverence now?”
এই কবিতাটি যিনি লিখেছিলেন, তিনি আজ ঐতিহাসিক এক ব্যক্তিত্ব হলেও, নিজের সময় বঙ্গসমাজে অত্যন্ত সমালোচিত হয়েছিলেন। হেনরি লুইস ভিভিয়ান ডিরোজিও। তাঁর শিক্ষা, তাঁর কবিতা, লেখা সেই সময়ের বাংলার তরুণ সমাজের একটা অংশকে উদ্দীপিত করেছিল। তৈরি হয়েছিল ‘ইয়ং বেঙ্গল’। মাত্র ২২ বছরের জীবনে পেয়েছেন অনেক অপমান, সম্মান। সেই সঙ্গে পেয়েছেন কৃতিমান কিছু ছাত্র। তাঁর শিষ্যদের সম্পর্কে অনেক দুর্নাম থাকলেও, তাঁরাই পরবর্তীকালে বাঙালি সমাজকে আলোকিত করেছিল। কারা ছিলেন তাঁরা? দেখে নেওয়া যাক —
রেভারেন্ড কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়
ডিরোজিও’র শিষ্যদের মধ্যে রেভ. কৃষ্ণমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামই সবার আগে উঠে আসে। ১৮১৩ সালে এক ব্রাহ্মণ পণ্ডিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। অত্যন্ত মেধাবী হিসেবে পরিচিত কৃষ্ণমোহন প্রথমে হেয়ার স্কুল, পরে হিন্দু কলেজে (অধুনা প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়) পড়াশোনা করেন। হিন্দু কলেজে পড়াকালীনই ডিরোজিও'র সংস্পর্শে আসেন তিনি। তৎকালীন হিন্দু সমাজের বিভিন্ন কুসংস্কার, প্রথা, আচার তাঁকে আহত করত। হিন্দু দর্শন নিয়ে সারাজীবন পড়াশোনা করে গেছেন তিনি। কিন্তু এই অন্ধবিশ্বাসকে কখনই সমর্থন করতে পারেননি। ১৮৩২ সালে তাঁর খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গসমাজে আলোড়ন পড়ে যায়। ব্যক্তিগত জীবনেও চলে টানাপোড়েন। এই সময়ই প্রকাশ করেন তাঁর বিখ্যাত পত্রিকা ‘দ্য ইনকুইরর’। পরবর্তীকালে রেভ. কৃষ্ণমোহন চার্চ মিশনারি সোসাইটির প্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৮৭৮ সালে ভারতসভার সভাপতি হিসেবেও মনোনীত হন তিনি। এরই মধ্যে ধর্ম, দর্শন, বিশেষ করে হিন্দু দর্শন নিয়ে লিখে গেছেন একের পর এক বই।
রামগোপাল ঘোষ
ইয়ং বেঙ্গলদের অন্যতম প্রধান এই সদস্যকে বলা হয় ‘ভারতের ডেমোস্থেনাস’। ১৮১৫ সালে জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। বাবা ছিলেন সামান্য একজন ব্যবসায়ী। নিজের মেধার জোরেই হিন্দু কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন রামগোপাল। পরে ডেভিড হেয়ার তাঁর মনোযোগ ও মেধা দেখে তাঁকে অবৈতনিক ছাত্রদের দলে নিয়ে নেন। স্বভাবতই, এমন ছাত্র যে ডিরোজিও'র নজরে আসবেন না, সেটা কি করে হয়! সেই সময় থেকেই প্রবলভাবে বিদেশি দর্শনের বই পড়া শুরু হল। রাজনীতি বিষয়ে তাঁর অসাধারণ বক্তৃতায় মুগ্ধ হয়েছিলেন সেই সময়ের মান্যগণ্যরা। তবে শুধু এতেই শেষ নয়। নিজের ব্যবসাও শুরু করলেন পরবর্তীকালে। সেখানে সফলও হলেন। বেথুন স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠার শুরুর লগ্ন থেকে তাঁর ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। এই স্কুল তৈরি করতে বেথুন সাহেবকে প্রভূত সাহায্য করেছিলেন।
রসিককৃষ্ণ মল্লিক
হিন্দুমাত্রেই গঙ্গা নদীকে পবিত্র বলে মনে করে। কিন্তু সেই সময়ের রক্ষণশীল সমাজে দাঁড়িয়ে একজন সদর্পে ঘোষণা করেছিলেন যে, তিনি গঙ্গার পবিত্রতায় বিশ্বাস রাখেন না। রসিককৃষ্ণ মল্লিক। ১৮১০ সালে কলকাতাতেই জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। অল্প বয়সেই রামমোহন রায়ের চিন্তার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন। হিন্দু কলেজে ভর্তি হওয়ার পর, সেই তালিকায় যোগ হলেন আরও একজন। ডিরোজিও। হিন্দু ধর্ম এবং তাঁর কুসংস্কারের প্রতি তখন থেকেই বিদ্রোহ শুরু হয়। রসিককৃষ্ণও সেই দলে ছিলেন। স্বাভাবিকভাবেই, পরিবারের তরফ থেকে তাঁকে ‘শোধরানোর’ নানা চেষ্টা করা হয়। পরবর্তীকালে রসিককৃষ্ণ মল্লিক ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে বর্ধমানে চলে যান।
শিবচন্দ্র দেব
এখনকার কোন্নগর শহরের যাবতীয় শ্রীবৃদ্ধির পেছনে যে মানুষটির অবদান ছিল সবচেয়ে বেশি, তিনি শিবচন্দ্র দেব। ১৮১১ সালে কোন্নগরেই জন্মেছিলেন তিনি। অল্প বয়সেই মেধাবী শিবচন্দ্র চলে আসেন হিন্দু কলেজে। তারপর ডিরোজিও'র সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে তাঁর। একই সময় ব্রাহ্ম ধর্মের প্রতিও আকর্ষণ বাড়ে। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে ১৮৪৩ সালে ব্রাহ্ম সমাজের সঙ্গে যুক্ত হন শিবচন্দ্র। পরবর্তীতে কোন্নগর ও মেদিনীপুরে ব্রাহ্ম সমাজের শাখা তৈরি করেন। তৎকালীন সরকারি কাজে নিযুক্ত প্রথমদিককার ইংরেজি শিক্ষিত বাঙালিদের মধ্যে শিবচন্দ্রও ছিলেন অন্যতম। কোন্নগরে রেল স্টেশন, স্কুল, পোস্ট অফিস মূলত তাঁরই চেষ্টায় তৈরি হয়।
হরচন্দ্র ঘোষ
ডিরোজিও'র শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম প্রথিতযশা ছিলেন হরচন্দ্র ঘোষ। ১৮০৮ সালে সরশুনায় জন্ম নিয়েছিলেন তিনি। ইয়ং বেঙ্গল দলের অন্যতম সদস্য হলেও, নিজের বংশপরিচয় বজায় রেখেছিলেন। কিন্তু সমাজের কুসংস্কারকে কখনই প্রশ্রয় দিতেন না। তবে হরচন্দ্র ঘোষ ইতিহাসে পরিচিত একজন আইনজীবী হিসেবে। কলকাতার ছোট আদালতের প্রথম বাঙালি বিচারক ছিলেন তিনি।
প্যারিচাঁদ মিত্র
রেভ. জেমস লং তাঁকে বলেছিলেন ‘বাংলার ডিকেন্স’। বাংলা সাহিত্য অবশ্য প্যারিচাঁদ মিত্রকে আরও একটি নামে চেনে, ‘টেকচাঁদ ঠাকুর’ নামে। ‘আলালের ঘরে দুলাল’-এর রচয়িতা ১৮১৪ সালে জন্ম নিয়েছিলেন। ক্যালকাটা পাবলিক লাইব্রেরির ডেপুটি লাইব্রেরিয়ান ছিলেন একসময়। পরবর্তীকালে কিউরেটর পদেও উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি ছিলেন সাংবাদিক। তৎকালীন বহু পত্রিকায় তিনি কলম ধরেছিলেন। গ্রেট ইস্টার্ন হোটেলের একজন ডিরেক্টরও ছিলেন প্যারিচাঁদ মিত্র।
রাধানাথ শিকদার
এভারেস্টের উচ্চতা কত? এই প্রশ্নটা এখন সবার কাছেই অনেক সোজা। কিন্তু ইনি না থাকলে বোধহয় সেই গণনার কাজ শুরু হতে আরও দেরি হয়ে যেত। ইয়ং বেঙ্গল দলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন রাধানাথ শিকদার। অঙ্ক নিয়েই ছিল তাঁর যাবতীয় পড়াশোনা। গ্রেট ট্রিগোনোমেট্রিকাল সার্ভেতেও তিনি ছিলেন অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। তাঁর গাণিতিক প্রতিভার কথা শুধু দেশে নয়, বিদেশেও পৌঁছে গিয়েছিল। ১৮৬৪ সালে জার্মান ফিলোজফিকাল সোসাইটি তাঁকে সাম্মানিক সদস্য হিসেবে ঘোষণা করে।
Powered by Froala Editor