হেনরি বেহরেন্স : ২৯.৫ ইঞ্চির শরীর নিয়েই বিশ্ব ঘুরেছিলেন যিনি

মাস কয়েক আগের কথা। ২০২২-এর ডিসেম্বরে বিশ্বের সবচেয়ে বেঁটে মানুষ হিসাবে গিনেস বুকের পাতায় নাম তুলেছিলেন ইরানের নাগরিক আফসিন ইসমাইল গাদেরজাদেহ। বয়স কুড়ি বছর হলেও, তাঁর উচ্চতা মাত্র ২৬ ইঞ্চি। ওজন মাত্র সাড়ে ৬ কেজি। এক বিরল রোগে আক্রান্ত হওয়ার কারণেই স্বল্পবয়সে দেহের বৃদ্ধি আটকে গেছে আফসিনের। এমনকি তাঁর শরীর এতটাই দুর্বল যে মোবাইলও ব্যবহার করতে পারেন না তিনি। কিন্তু শারীরিক এই প্রতিবন্ধকতাকে জয় করে গোটা বিশ্ব ঘুরে বেড়ানো কি বাস্তবে সম্ভব?

হ্যাঁ, আশ্চর্য লাগলেও সত্যি। আজ থেকে ৭০ বছর আগের কথা। সোশ্যাল মিডিয়া তো দূরের কথা, তখনও বিশ্বজুড়ে সর্বজনীন হয়ে ওঠেনি টেলিভিশনই। এমনকি প্রতিষ্ঠিত হয়নি ‘গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডস’-ও। সেই যুগেই বিশ্বের ক্ষুদ্রতম মানুষ হিসাবে প্রায় গোটা বিশ্ব ঘুরে বেড়িয়ে এক অনন্য নজির গড়েছিলেন তিনি। 

হেনরি বেহরেন্স (Henry Berhens)। তৎকালীন সময়ে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বেঁটে মানুষ’ (Smallest Man in the World) হিসাবেই পরিচিত ছিলেন তিনি। হ্যাঁ, পরিচিত বলাই শ্রেয়। কারণ, সে-যুগে গিনেস বুকের অস্তিত্ব না থাকার জন্য, সবটাই দেখা হত পাশ্চাত্যের দৃষ্টিভঙ্গিতে। সেভাবেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপের একাধিক দেশ হেনরিকে স্বীকৃতি দিয়েছিল বিশ্বের ক্ষুদ্রতম মানুষের। তবে দৈর্ঘ্যে বর্তমানের ক্ষুদ্রতম মানুষ আফসিনের থেকে খুব একটা লম্বা ছিলেন না হেনরি। প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় তাঁর উচ্চতা ছিল সাড়ে ২৯ ইঞ্চি। ওজন ৩২ পাউন্ড, অর্থাৎ প্রায় ১৬ কেজি। আর তার বিশ্বজয়ের কাহিনি?

সে-কথায় ফেরা যাক এবার। শেষমেশ যুক্তরাজ্যে থিতু হলেও, হেনরির জন্ম ব্রাজিলে। বাবা-মা ছিলেন জার্মান। ভূমিষ্ঠ হওয়ার সময় আর পাঁচটা স্বাভাবিক শিশুর মতোই ওজন ছিল হেনরির। তবে হঠাৎ-ই শারীরিক বৃদ্ধি বন্ধ হয়ে যায় তাঁর। হেনরি আটকে পড়েন তাঁর দু’বছর বয়সের শরীরে। অবশ্য এই শারীরিক প্রতিবন্ধকতা চার দেওয়ালের মধ্যে আটকে রাখতে পারেনি তাঁকে।

ব্রাজিলে জন্মানোর কারণে কৈশোর থেকেই পর্তুগিজ ভাষায় দক্ষ ছিলেন হেনরি। পর্তুগিজ সাহিত্যে রীতিমতো দখল ছিল তাঁর। পরবর্তীতে আরও তিনটি ভাষা আয়ত্ত করেছিলেন তিনি। যার মধ্যে রয়েছে ইংরাজি, জার্মান এবং স্প্যানিশ। ফলে, শারীরিক প্রতিবন্ধকতার জন্য প্রথাগত কর্মসূত্রে কাজ না পেলেও, আন্তর্জাতিক সার্কাসে নিজের জায়গা পাকা করে নিতে অসুবিধা হয়নি তাঁর। হেনরি লন্ডনের কিংবদন্তি ‘শোম্যান’ বার্টন লেস্টারের ‘মিডগেট সার্কাস’-এ কাজ শুরু করেন বিশের দশকে। 

এই সার্কাসের সূত্রেই লাতিন আমেরিকা, আমেরিকা, মেক্সিকো, ইউরোপ এবং এশিয়ার বিভিন্ন প্রান্তে খেলা দেখিয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। মঞ্চে অভিনয় করতেন খর্বকায় সেনাপতির ভূমিকায়। চারটি ভাষা হাতের তালুর মতো চেনা হওয়ার কারণে, ‘কর্নেল পিউয়ি’-খ্যাত হেনরির সংলাপ বিশেষভাবে নজর কাড়ত দর্শকদের। হিসেব মতো অস্ট্রেলিয়া এবং আন্টার্কটিকা বাদ দিলে বিশ্বের বাকি পাঁচ মহাদেশই ঘুরে দেখেছেন হেনরি। 

১৯৩২ সালে ‘মিডগেট সার্কাস’-এরই এক কর্মী এমিকে বিবাহ করেন হেনরি। এমি বামন হলেও, হেনরির থেকে ১০ ইঞ্চি লম্বা ছিলেন এমি। এমি ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ায়, সার্কাসজীবন থেকে অবসর গ্রহণের পর ১৯৫৬ সালে ইংল্যান্ডের ওয়ার্থিং শহরে থিতু হন এই তারকা-যুগল। সে-সময় ব্রিটিশ চলচ্চিত্র প্রযোজক সংস্থা ‘পাথে’-ও তাঁকে নিয়ে তৈরি করেছিল তথ্যচিত্র। এমনকি ব্রিটেনের নানান সংবাদমাধ্যমে হামেশাই দেখা যেত হেনরি-এমির আশ্চর্য সব ছবি। কখনও হেনরি নাচছেন তাঁর স্ত্রী-এর সঙ্গে, কখনও আবার খেলা করছেন পোষ্য বিড়াল কিংবা কুকুরের সঙ্গে। ‘ওয়ার্থিং ডেইলি’ পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছিলেন, পোষ্য বিড়ালও তাঁর কাছে বাঘের সমান। 

১৯৬১ সালে ৬৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন বিশ্বের হেনরি। তবে আজও ব্রিটিশ মুলুকের বিভিন্ন সার্কাসে কান পাতলে শোনা যায় এখনও হেনরির কিংবদন্তি। এমনকি কিংবদন্তি হয়ে উঠেছে তাঁর অভিনীত ‘কর্নেল পিউয়ি’ চরিত্রটিও। ব্রিটেনের বহু সার্কাসেও আজ ‘কর্নেল পিউয়ি’ সেজে খেলা দেখেন অন্যান্য খর্বাকৃতি শিল্পীরা…

Powered by Froala Editor