বিংশ শতকের কলকাতার এখানে সেখানে ঘটে যাচ্ছে নানা ঘটনা। কোথাও বিপ্লবীদের গোপন প্রস্তুতি চলছে, পুলিশের সঙ্গে চলছে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষ; আবার কোথাও চলছে নির্ভেজাল সাহিত্যচর্চা। সেই সময় জোড়াসাঁকোয় হিমালয়ের মতো বসে আছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। কিন্তু বাকিরাও সমানভাবে নিজেদের কাজ বজায় রেখেছেন। আজকের গল্প শুরু হবে উত্তর কলকাতার পাথুরিয়াঘাটা অঞ্চলের একটি বাড়ি থেকে।
সেদিন সেখানে বসেছে মজলিশের আসর। সাহিত্যিক, উস্তাদ, সঙ্গীতকার কে না আসেননি সেখানে! বাড়ির লোকটি ক্ষ্যাপাটে হলে কী হবে, সঙ্গীত আর সাহিত্যের কদর ভালোই বোঝে। নিজেও তো লেখেন। মজলিশ চলতে চলতে একটু বেশিই রাত হয়ে গেল। তাই ওই বাড়িতেই সবাই ঘুমিয়ে পড়লেন। হঠাৎ গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেল সবার। বাড়ির তিনতলা থেকে কীসের যেন শব্দ আসছে! সাহস নিয়ে সবাই গিয়ে দেখেন, বাড়ির কর্তা আর অন্য আরেকজন নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে। কারণ? একই খাটে কেউ কাউকে জায়গা ছেড়ে দেবেন না! এই ‘আরেকজন’টি হলেন কাজী নজরুল ইসলাম; আর বাড়ির কর্তাটির নাম হেমেন্দ্রকুমার রায়।
প্রসাদ রায় থেকে প্রসাদ দাস, তারপর হেমেন্দ্রকুমার, কখনও সখনও মেঘনাদ গুপ্ত— নাম বদলালেও আসল মানুষটি কিন্তু একই থেকে গেছেন। বাংলার কিশোর সাহিত্য নিয়ে যারা গবেষণা করেন, তাঁরা এই মানুষটিকে ফেলে দিতে পারেন না। কী করেই বা অস্বীকার করা যায় ‘যকের ধন’, ‘আবার যকের ধন’-এর লেখককে? রহস্য-রোমাঞ্চ ঘরানার অন্যতম সেরা সাহিত্যিক যে হেমেন্দ্রকুমার রায়, তা তো অস্বীকার করার জায়গা নেই। তবে তাঁর জীবন এতেই আটকে ছিল না। গণ্ডিটা ফড়িংয়ের মতো লাফ দিয়ে দিয়ে উড়ে বেরিয়েছিল অনেকটা দূরে। স্বাধীনভাবে বাঁচতে চেয়েছিলেন, সেইভাবেই জীবন কাটিয়েছেন তিনি।
শুধু লেখক নয়; একটা সময় চুটিয়ে গান লিখেছেন, আর্ট কলেজ থেকে ছবি আঁকাও শিখেছিলেন। স্বয়ং অবনীন্দ্রনাথ তাঁর অঙ্কন প্রতিভা নিয়ে কোনো সংশয় রাখেননি। তাঁর গানের জীবনেও একের পর এক স্মরণীয় ঘটনা ঘটে গেছে। হেমেন্দ্রনাথের কাছের মানুষ ছিলেন কিংবদন্তি গায়ক কৃষ্ণচন্দ্র দে। প্রায়শই বাড়িতে চলত যাতায়াত। হঠাৎই কৃষ্ণচন্দ্র হাজির করালেন এক তরুণকে। রোগা, ছিপছিপে চেহারা। তাঁর জন্য দুটো গানও লিখলেন হেমেন্দ্রকুমার। ১৯৩২ সালে যখন রেকর্ডিং হয়ে বেরোল, তখনই হেমেন্দ্র’র বক্তব্য ছিল এই ছোকরা একদিন সবাইকে ছাপিয়ে যাবে। তরুণটির নাম শচীন দেববর্মণ!
আরও পড়ুন
শক্তি ডাকতেন ‘টর্পেডো’ নামে; ’বিখ্যাত’ বন্ধুদের ভিড়ে খানিক আড়ালেই রইলেন তারাপদ রায়?
তবে এইসব জীবনের বাইরেও তাঁর নিজস্ব একটি জীবন ছিল। আর সে সব বড়ো মনোরম ছিল না। হেমেন্দ্রকুমার যেমন গোয়েন্দা, রোমাঞ্চকর গল্প লিখতেন, তেমনভাবেই জীবন কাটাতেন। তখনকার দিনের আর পাঁচজন শিল্পী সেটা করতে পারতেন কিনা সন্দেহ। মনে মনে জয়ন্ত-মানিক, ইন্সপেক্টর সুন্দরবাবু, বিমল-কুমারকে নিয়েই বেরিয়ে পড়তেন একেকটা জায়গায়। কখনও মাঝরাতে শ্মশানে, কখনও গণিকালয়ে। একেকটা রাত যেন অ্যাডভেঞ্চারের একেকটা অধ্যায়। কখন কোথায় কী হবে কেউ জানে না। শুধু গল্প, চরিত্র ও জীবনের নেশায় ছুটে চলা। একবার এক যৌনপল্লিতে ঢুকেছেন হেমেন্দ্রকুমার। দলবল নিয়ে মদ্যপান করে আশ্রয় খুঁজছেন। হঠাৎ দেখেন একটা বাড়ির ছাদ থেকে একটি মেয়ে ডাকছে। ঢোকা গেল সেই বাড়িতে। তাঁদের বসিয়ে সেই মহিলা বাইরে বেরিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে চলে গেল। হেমেন্দ্রকুমাররা হতবাক! একটু ঘোর কাটতেই দেখলেন, ঘরের কোণেই একটা গলাকাটা লাশ! এবার কী হবে! কোনোরকমে পিছনের দরজা ভেঙে ছাদ টপকিয়ে পালালেন তাঁরা।
এমন সব রাতের কথাই লেখার পরতে পরতে মিশে আছে। খাস বড়লোক, উস্তাদ থেকে শুরু করে পাড়ার গুন্ডা, খুনি— সবার সঙ্গেই পরিচয় হেমেন্দ্রকুমারের। এঁদের মধ্যে থেকেই নিজের লেখাকে বের করে আনেন তিনি। অবশ্য ভালোভাবে দেখলে, গোটা পরিবারটাই তো শিল্পের সমঝদার ছিল। বাবা ছিলেন এসরাজবাদক। আর ছেলের গুণ তো দেখলেনই। এমনকি লিখবেন বলে চাকরি করা শুরু করেও ছেড়ে দিয়েছিলেন। তারপর ওইরকম বীভৎস নৈশযাপন। হ্যাঁ, ঠিক এটাই চেয়েছিলেন হেমেন্দ্রনাথ রায়। কারোর অধীনে না থেকে স্বাধীনভাবে বাঁচতে। পরবর্তীকালে কোনো কবি লিখে যাবেন- “মধ্যরাতে কলকাতা শাসন করে চারজন যুবক।” তার বাস্তবিক প্রয়োগ আগেই করেছিলেন হেমেন্দ্রকুমার। লিখেও গেছেন, গানও তৈরি করেছেন; মনটিও ছিল দিলদরিয়া। দুঃখ কি আসেনি? হাজার হোক, মনুষ্যজীবন তো! পেটের দায়ও অনেক সময় অনিচ্ছা সত্তেও লিখতে হয়েছে, অনেকের সঙ্গে মনমালিন্য হয়েছে। হেমেন্দ্রকুমারের সংগ্রহে থাকা জিনিসগুলো তাঁর বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে সরিয়ে ফেলেছিলেন অনেকে। এইভাবেই দেখেছিলেন কলকাতাকে। একটু একটু করে ছড়িয়েছিলেন অক্ষরের রেখায়…
আরও পড়ুন
আমার লেখক হওয়ার ইচ্ছে শুনেই হেসেছিলেন মা : রাস্কিন বন্ড
তথ্যসূত্র-
১) আনন্দবাজার পত্রিকা, ‘জনজীবনের ভাষ্যকার হেমেন্দ্রকুমার’
২) বঙ্গদর্শন, ‘গণিকাপল্লি থেকে শ্মশান- রাতের কলকাতা শাসন করতেন সাহিত্যিক হেমেন্দ্রকুমার’
Powered by Froala Editor
আরও পড়ুন
ফেলুদার শহরে শার্লক হোমসের ঠেক; ঢুঁ মারতেন সুকুমার সেন, প্রেমেন্দ্র মিত্র, নীরেন্দ্রনাথ, সমরেশ বসুরা