দৃশ্য একঃ পর্দা জুড়ে মনোরম প্রাকৃতিক পরিবেশ, একটি গাছের তলায় নবদম্পতি, স্ত্রীর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছেন স্বামী। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে একটি গান গাইছেন স্ত্রী।
দৃশ্য দুইঃ বিয়ের কিছুদিন পর। স্ত্রী স্বামীর ভুলো মনের ব্যাপারে অনুযোগ করে বলছেন, যদি কখনো ভুল করে তাঁকে ছেড়ে স্বামী অন্য কোথাও চলে যান… আবার আবহে ওই গানটির সুর, যন্ত্রসঙ্গীতে।
দৃশ্য তিনঃ একটি বাচ্চা মেয়ের জন্মদিনের পার্টি। সেখানে ছোটো মেয়েটির অনুরোধে পিয়ানো বাজাচ্ছেন তার গভর্নেস। সুরটা চেনা চেনা…
দৃশ্য চারঃ আবার সেই প্রাকৃতিক পরিবেশ, সেই গাছ, সেই ফুলের ঝাড়, দূর থেকে ভেসে আসা দেহাতি বাঁশির সুর, তারপর আবার স্মৃতির অতল থেকে উঠে আসে গানটি, “তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার…”
আর ‘ক্লু’ দেবার দরকার নেই, সিনেমার নাম ‘হারানো সুর’ (১৯৫৭)। পর্দায় সুচিত্রা-উত্তম, নেপথ্যে গীতা দত্ত আর হেমন্ত মুখোপাধ্যায়-এর ম্যাজিক। বাণিজ্যিক বাংলা সিনেমায় অন্যতম মাইলফলক। কিন্তু এর অসাধারণ জনপ্রিয়তা ও সাফল্যের পাশাপাশি আরও একটা বিষয় মনে রাখার মতো— এই বাংলা সিনেমাতেই পরিপূর্ণ ও সার্থকভাবে ‘থিম সং’-এর গুরুত্ব বোঝা গেল। ব্যাপারটা একটু পরিষ্কার করে বলা দরকার। ছায়াছবির মূল বক্তব্যকে তুলে ধরছে, এমন একটি গান বা বিমূর্ত, আবহ-সুরের প্রয়োগ-ধারণা এর আগে যে একেবারেই ছিল না, তা বলা যায় না। ‘মুক্তি’(১৯৩৭) সিনেমায় মূল বিষয়বস্তু অর্থাৎ নায়কের আত্মিক ‘মুক্তি’র আকাঙ্ক্ষাকে সঙ্গীতে রূপ দেবার জন্যই রবীন্দ্রনাথের ‘খেয়া’ কবিতায় সুর দিয়ে, তাঁর অনুমতি নিয়ে ব্যবহার করেছিলেন পঙ্কজকুমার মল্লিক। সেই ‘দিনের শেষে ঘুমের দেশে’ গানটি নিজেই ইতিহাস, এবং পরবর্তীকালে ‘অনিন্দিতা’ সিনেমায় আবার গানটি ব্যবহার করা হয়। ওঙ্কারনাথ ঠাকুরের ‘নীলাম্বরী’ রাগটি বেহালায় বা সেতারে বাজিয়ে দেওয়া হত কোনো দুঃখের দৃশ্যে, এরকম দেখা গেছে ত্রিশ-চল্লিশের দশকে কিছু বাংলা সিনেমায়। কমল দাশগুপ্তের সঙ্গীত পরিচালনায় ‘ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ (১৯৫৩) সিনেমাতেও ‘জগন্নাথস্বামী নয়নপথগামী’ স্তোত্রটি সুর-সহযোগে বার বার ব্যবহার করা হয়েছে, যা চৈতন্যদেবের মহাজীবনের যাত্রাপথের সঙ্গে কাব্যিক এবং রূপক-অর্থে চমৎকার মানিয়েছিল। কিন্তু আলাদা করে চলচ্চিত্রের ‘টেক্সট’-এর অপরিহার্য অঙ্গ হিসেবে থিম মিউজিক বা থিম সং-এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে ভাবনাচিন্তা—অন্তত পাঁচের দশকের প্রথমদিক পর্যন্ত বেশিরভাগ সিনেমাতেই সেভাবে করা হত না।
‘হারানো সুর’-এ এই প্রয়োগ একেবারে স্পষ্ট, এবং তা সঙ্গীত পরিচালকের গভীর ভাবনার ইঙ্গিত দেয়। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় নিজেও এর আগে এই ধরনের প্রয়োগ করেছেন। মনে পড়ে ‘জিঘাংসা’ (১৯৫১) সিনেমায় সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে একাধিকবার ‘আমি আঁধার আমি ছায়া’ গানটির ব্যবহার এবং তার আগে সেই বিখ্যাত ‘ভৌতিক’ হামিং—‘ও ও ও ও ও’ (যা পরে ‘বিস সাল বাদ’ সিনেমায় লতাজির গলায় ‘কহিঁ দীপ জ্বলে’র প্রিলিউড হিসেবেই বেশি পরিচিত হয়ে গেছে)—তবে জিঘাংসার জন্য খুব বেশি সময় দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। নিজেই বলেছেন, অল্প সময়ের মধ্যেই ‘ধ্যানস্থ হয়ে’ কাজটা তুলতে হয়েছিল। অর্থাৎ যত্ন বা নিষ্ঠার অভাব ছিল না, কিন্তু খুব বেশি ভাবার অবকাশও ছিল না। আলাদা করে থিম মিউজিক নিয়ে ভাবনাচিন্তা করা এবং তাতে নতুন পথের দিশা দেখানো—এই ব্যাপারটি ঘটল ‘নাগিন’(১৯৫৪) সিনেমায়, ক্লে-ভায়োলিন আর হারমোনিয়াম মিলিয়ে সাপুড়ের বীণ-এর আওয়াজ ছড়িয়ে দেবার তাগিদে। হিন্দি সিনেমার জগতে অবিশ্বাস্য সাফল্য; এবং ছবির কাহিনি, চরিত্র, তাদের সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী একটি বিশেষ সুরকে সারা সিনেমায় ব্যবহার করলে তা একঘেয়ে লাগে না, বরং তা হয়ে উঠতে পারে থিম মিউজিক হিসেবে সার্থক—এ কথা হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, অথবা হেমন্ত কুমার প্রমাণ করে দিলেন। এর পর থেকেই এ জাতীয় প্রয়োগকে জনপ্রিয় করে তোলা এবং নান্দনিক উৎকর্ষের জায়গায় নিয়ে যাবার প্রয়াস তাঁর সুরারোপিত সিনেমাগুলিতে বার বার দেখা গেছে।
‘শাপমোচন’(১৯৫৫)-এর প্রতিটি গানই বিপুল জনপ্রিয়, এবং সুরকারের নিজের কথায়—এক্ষেত্রেও হাতে সময় ছিল না, মনে হচ্ছিল যা-ই করছেন, ‘কিচ্ছু হচ্ছে না’! তবু বিশেষ ভাবে কোন একটি গানকে ‘থিম সং’-এর মর্যাদা দিতে হলে ‘ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস’-এর কথাই বলতে হয়। মহেন্দ্র যখন গানটি গাইছে, তখন তার ব্যক্তিগত জীবনেও মেঘ-ঝড়ের আভাস—মাধুরী তাকে ভুল বুঝেছে; অন্যদিকে তার দাদা গ্রামের এক প্রতিবেশীর বাড়িতে রেডিওতে গানটি শুনে অভিশাপের আশঙ্কায় ব্যাকুল হয়ে উঠছেন।
১৯৫৯ সালে তাঁর সঙ্গীত পরিচালনায় মুক্তি পাওয়া দুটি সিনেমা আবার ইতিহাস সৃষ্টি করল থিম সং এবং মিউজিকের প্রয়োগে। ‘নীল আকাশের নীচে’ সিনেমায় একটি বিশেষ মুহূর্তকে অবিস্মরণীয় করে রাখার পাশাপাশি, ‘নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী’ গানটির সুর যন্ত্রসঙ্গীতেও ব্যবহার করা হয়েছে আবার শেষ দৃশ্যে, যখন ওয়াং লু তার বাঙালি ‘সিস্টার’-এর রাখি হাতে বেঁধে দেশে ফিরে যাচ্ছে। দেশ, জাতি, ভাষা ও স্থানীয় সংস্কৃতির বিভিন্নতার ঊর্ধ্বে এক বিশ্বমানবতার কণ্ঠস্বর হিসেবে এই সুরটি এক অসামান্য মাত্রায় পৌঁছে দেয় ছায়াছবির ব্যতিক্রমী বক্তব্যকে। আর ‘দীপ জ্বেলে যাই’ সিনেমায় পরিচালকের দাবি ছিল, এমন একটা সুর চাই, যা সারা ছবিতে নায়িকার অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের যোগসূত্র হিসেবে কাজ করবে। এই সুর বেজে উঠলেই চেনা যাবে তার স্মৃতি-বিস্মৃতি ও আত্মত্যাগের স্বরূপ। এই ভাবনাকে রূপ দিতেই সুরকার হুইসল আর হামিং-এর মিশেলে তৈরি করেছিলেন সেই কালজয়ী ‘আইডেনটিফিকেশন টিউন’, যা চমক-নিন্দা-প্রশংসা-জনপ্রিয়তা-অপবাদ সবকিছু পেরিয়েও নিজের মাহাত্ম্যেই কালজয়ী।
‘এই পথ যদি না শেষ হয়’ গানটি সম্পর্কে নতুন করে কিছুই বলার নেই, কিন্তু অনেকেই হয়ত মনে রাখেননি, শুধু যে মোটরবাইকে সওয়ার হয়ে উচ্ছল প্রেমের দৃশ্যেই গানটি ব্যবহার করা হয়েছে তা নয়, সিনেমার শেষ অর্ধে রিনা যখন হতাশায়, নেশার ঘোরে ডুবিয়ে দিতে চাইছে নিজেকে, তখনও ধীর লয়ে আবহে ভেসে আসে প্রথম লাইনটি— গানটির অভিব্যক্তিও বদলে যাচ্ছে— যেন রিনাকে সাবধান করছে তার অন্তরাত্মা-- এই ভাবে নিজেকে ধ্বংস করার যে পথে সে এগোচ্ছে, সেই পথের কিন্তু কোনো শেষ নেই! এখন ‘সপ্তপদী’র যে ইউটিউব সংস্করণ দেখতে পাওয়া যায়, সেখানে এই দৃশ্যটি খুঁজে পাওয়া যায় না, সম্ভবত পুরনো প্রিন্ট থেকে কেটে দেওয়া হয়েছে।
‘পলাতক’ সিনেমায় শীর্ষসঙ্গীত হিসেবে ‘জীবনপুরের পথিক’ এক দিক থেকে ঘরছাড়া, বাউল-স্বভাব কেন্দ্রীয় চরিত্রটির জীবনদর্শনকে তুলে ধরে, অন্য দিকে ‘দোষ দিয়ো না আমায় বন্ধু’ গানটি দুবার ব্যবহার করা হয়—একবার, যখন আসরে গাইতে গিয়ে নায়কের ভেতরে বাসা বাঁধা মারণরোগ ধরা পড়ে, আর একবার শেষ দৃশ্যে— তার চিরদিনের মতো নিরুদ্দেশ যাত্রার দৃশ্যে ‘তোমার ঘরে সুখের বাতি… আমি চলে যাই’ অংশটির ব্যবহার, বিলম্বিত লয়ে। এই দুটি গানই একযোগে সামগ্রিক ‘থিম সং’-এর কাজ করে। ‘কুহেলি’ সিনেমায় একাধিকবার রহস্য-আবহে ‘কে জেগে আছো’ গানটির প্রয়োগও অবিস্মরণীয়—এখনও বিভিন্ন বাংলা ধারাবাহিকে ‘ভৌতিক’ বা রহস্যঘেরা কোনো প্লটের নেপথ্যে ‘থিম সং’ হিসেবে এই গানটিই ব্যবহার করা হচ্ছে। ‘অদ্বিতীয়া’ সিনেমায় ‘যাবার বেলা পিছু থেকে ডাক দিয়ে’ গানটির মর্মার্থও কিছুটা থিম সং-এর মতই। আরও পরে, যুগরুচি যখন বদলে যাচ্ছে, তখনও— ভালবাসা ভালবাসা (১৯৮৫) সিনেমায় ক্লাইম্যাক্সের সময় শিবাজী চট্টোপাধ্যায়ের গলায় দীর্ঘ, আখ্যানভিত্তিক একটি গান ব্যবহার করা ছিল রীতিমতো সাহসের কাজ, ওই মুহূর্তে দর্শকরা বসে বসে ‘অভাগা যেদিকে চায়’-এর মত লম্বা একটি গান শুনবেন কিনা, এ এক রকমের চ্যালেঞ্জ ছিল পরিচালক এবং সুরকার— দুজনের কাছেই। এক্ষেত্রেও তাঁরা সফল, আর গানটি তো নায়কের সামগ্রিক জীবনসংগ্রামকেই তুলে ধরে। ‘দাদার কীর্তি’ সিনেমায় ‘চরণ ধরিতে’ গানটির নির্বাচন ছিল পরিচালক তরুণ মজুমদারের; কিন্তু দুটি ভিন্ন দৃশ্যের মর্মবস্তু এবং ভাবগত গভীরতার মাত্রা আলাদা, দৃষ্টিভঙ্গি আলাদা—সেই অনুযায়ী পুরুষ এবং নারীকণ্ঠে আলাদাভাবে গানটির পরিবেশন, আর সে জন্য দুই ধরনের অভিব্যক্তি এবং আলাদা শব্দ-আবহের ব্যবহার—এর কৃতিত্ব তো সঙ্গীত পরিচালকেরই।
‘দেশ’ পত্রিকায় ‘কান পেতে রই’ (১৬ আগস্ট, ১৯৮৬) নামে একটি নিবন্ধে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় খুব সংক্ষেপে লিখেছিলেন তাঁর সঙ্গীত-ভাবনার কথা— ছায়াছবির ক্ষেত্রে কাহিনি-প্রবাহের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বোধের জায়গাকে সুরে সুরে ফুটিয়ে তুলতে কথা-সঙ্গীত এবং আবহ-সঙ্গীত—দুটিই যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, এবং সঙ্গীত পরিচালকের দায়িত্ব শুধু গানগুলো রেকর্ড করিয়ে দেওয়া নয়, চিত্রনাট্য পড়া, বোঝা এবং সেই কথাবস্তু অনুযায়ী সুর রচনার জন্য তাঁরও যে কতখানি দায়িত্ব নেওয়া উচিত, সে কথাই তিনি লিখেছিলেন। প্রথম জীবনে সাহিত্যিক হবার পথ বদলে যিনি সুরশিল্পী হয়ে উঠেছেন, এই ভাবনা তাঁর নিজস্ব নান্দনিক ও জীবন-কেন্দ্রিক দর্শন বলেই বুঝে নিতে হয়। সমসাময়িক অন্য সুরকাররাও অনেক সময় সিনেমার অন্তর্নিহিত, গভীর বক্তব্যবাহী গান বা মূল চরিত্রের জীবনবোধমূলক গান পরিবেশনের জন্য নির্ভর করতেন তাঁর কণ্ঠেই— ‘সন্ন্যাসী রাজা’ সিনেমায় ‘কা তব কান্তা’ স্তোত্রগানের জন্য নচিকেতা ঘোষ হেমন্তকেই ডাকেন; ‘ধনরাজ তামাং একটি শুধু নাম’ বা ‘তনয়া’ সিনেমায় ‘আমি আঁধারের রঙ নিয়ে’ গাইবার জন্যও তাঁর কথাই মনে পড়ে।
আত্মজীবনীতে লিখেছিলেন হেমন্ত, ‘...সব জিনিসের মধ্যে একটা সুর আছে। সুখ, দুঃখ, আনন্দ, বেদনা, হতাশা— এর কোনোটাই সুরের আওতার বাইরে নয়। প্রচণ্ড আনন্দ, প্রকাশটা ঠিক সুরে না হলে সেটা মিষ্টি না লেগে তেতো লাগবে। তেমনি দুঃখের কান্নাটাও বীভৎস ঠেকবে যদি না বিলাপটা সুরে সুরে বেরিয়ে আসে।... সেই সুরের সন্ধানেই আজও এগিয়ে চলেছি’। সুর যাঁর কাছে জীবনের ‘থিম’ হিসেবে ধরা দেয়, বিচিত্র ধারার ছায়াছবিতে তাঁর সুরসৃষ্টি বোধহয় সামগ্রিক ভাবে এই জীবনবোধেরই প্রতিফলন।
Powered by Froala Editor