উত্তাল চারের দশক। একদিকে মন্বন্তরের করাল গ্রাসে সর্বস্বান্ত বাংলা, অন্যদিকে ইংরেজ বিরোধিতার আগুন ছড়িয়ে পড়ছে দাউদাউ করে। তারই মাঝে এক নতুন আদর্শ, নতুন বিশ্বাস নিয়ে এল ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। নেপথ্যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি। সঙ্গে একদল তরতাজা মুখ। গ্রামে-শহরে চলছে ‘সর্বহারা’-র সঙ্ঘবদ্ধ লড়াইয়ের প্রচার। কখনও ‘নবান্ন’ নাটক, কখনও-বা গণসংগীত, অগুনতি মানুষের সারি দাঁড়িয়ে পড়ে বহু জায়গায়। তারই মধ্যে উঠে এলেন যুবক। হাজারো মানুষের মুখরিত কলরবের মধ্যে গান ধরলেন, “ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলে আগুন জ্বালো।” সেকি! গণনাট্যের মঞ্চে রবীন্দ্রসঙ্গীত! কিন্তু ততক্ষণে বুঁদ হয়ে গেছে জনতা। মাটি খুঁড়ে চিনে নিতে শিখছে রবীন্দ্রনাথকে, উন্নাসিকতার বেড়াজালে আবদ্ধ এক সহমর্মী মানুষকে। আর সেই শিল্পীর নাম দেবব্রত বিশ্বাস (Debabrata Biswas)। বাংলা গানের ‘জর্জ দা’।
স্বাধীনতার ঠিক পরের কথা। দেশভাগের কাঁটাতার তাঁর থেকে উপড়ে নিয়ে গেছে জন্মভূমিকে। দাঙ্গার অশান্তিতে এক টুকরো আশ্রয় বলতে ছিল রাসবিহারী অ্যাভিনিউয়ে তাঁর ঘরটি। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সহ আরো অনেকের নিয়মিত আড্ডায় বুকের কষ্ট লাঘব করার সামান্য চেষ্টা। কিন্তু সেই আড্ডাও বাধ্য হল উঠে যেতে। ১৯৪৮-এ কমিউনিস্ট পার্টির ‘ঝুটা স্বাধীনতা’-র তত্ত্ব, পার্টি নিষিদ্ধ হওয়া, গ্রেপ্তার, আত্মগোপন, পুলিশি সন্ত্রাস সব চলতে লাগল একের পর এক। হেমাঙ্গ বিশ্বাসের (Hemanga Biswas) গানে কণ্ঠ দিলেন দেবব্রত,
“মাউন্ট বেটন সাহেব ও,
তুমার সাধের বেটন কার হাতে থইয়া গেলায় ও।”
লক্ষ্যটা নেহরু পরিচালিত কংগ্রেস সরকার। আর সেই গান নিয়ে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে পৌঁছে গেলেন দেবব্রত বিশ্বাস ও তাঁর সঙ্গীরা। এর কিছুদিনের মধ্যেই ভেঙে গেল গণনাট্য সংঘ। বাইরের বিপদ তো ছিলই, আসল সমস্যা তৈরি করল ভিতরকার রাজনীতি। আদর্শের দ্বন্দ্বের থেকেও বড়ো হয়ে দেখা দিল ব্যক্তিত্বের দ্বন্দ্ব। বেরিয়ে গেলেন শম্ভু মিত্র, বিজন ভট্টাচার্য, বিনয় রায়-সহ অনেকেই।
আরও পড়ুন
‘তুমার রবীন্দ্রসঙ্গীতটা হইব না’, হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে বললেন দেবব্রত
দেবব্রত বিশ্বাস কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য ছিলেন না, ফলে তাঁকে সরাসরি স্পর্শ করেনি সেই আঁচ। যদিও গণনাট্যের অন্তর্দ্বন্দ্বে আহত হয়েছিলেন মারাত্মকভাবে। তৈরি হয় দূরত্ব। ছয়ের দশক থেকে ছেড়ে দিলেন গণসংগীত গাওয়া। কোনো অনুষ্ঠানে শত অনুরোধেও গাইতেন না গণসংগীত। বলতেন, “গান গাইয়া দেশের জনগণের কী হইল? ত্রিশ বছর গান গাইয়া হেরার মধ্যে আধ ইঞ্চিও পেনিট্রেট করতাম পারছি না।” একসময়ে আশ্রয় নিলেন রবীন্দ্রসংগীতে। পুরনো সঙ্গীদের অনেকেরই মনে হল, তিনি গণআন্দোলনের রাস্তা ছেড়ে বেছে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথের শান্তির আশ্রয়। সেখানেও আসে একের পর বাধা। বিদেশের বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রায়ই অনেকে আসতেন তাঁর সমর্থন সংগ্রহের আশায়। আপত্তি জানাতেন তিনি। দেশের জন্যই তো কিছু করতে পারলেন না, প্রয়োজন ছিল গ্রামে-গ্রামে যাওয়া। তার বদলে কলকাতা আর মুম্বইয়ের সাজানো মঞ্চে গান গেয়ে কি গণচেতনা তৈরি করা যায়? পার্টির সঙ্গ ছেড়েছেন ঠিকই কিন্তু, তিনি তো কোনোদিন সত্যিই সরে আসেননি জনতার থেকে। বলতেন, “বাঁয়ে হাইল্ছিলাম, অভ্যাস অইয়া গেছে, ডাইনে আর হাইলতে পারলাম না।”
আরও পড়ুন
শহরজুড়ে দাঙ্গা; কলিম শরাফীকে লুকিয়ে রাখলেন দেবব্রত বিশ্বাস, জানতে দেননি হেমন্তকেও
বন্ধু হেমাঙ্গ বিশ্বাসও তাঁকে ভুল বুঝেছিলেন কিছু ক্ষেত্রে। বিজন ভট্টাচার্যের স্মরণসভায় বলে বসলেন, ‘জর্জ’ দা বর্তমানে ‘সিনিক’। যে মানুষ মোটর সাইকেলে দৌড়ে শ্রমিকদের রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনাতেন, তিনি কিনা এখন গণনাট্যের নাম শুনলেই ‘খেইপ্যা’ ওঠেন। কথাটা কানে উঠতেই ‘অভিমান’ হল দেবব্রত বিশ্বাসের। দীর্ঘ চিঠিতে হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে নিজের অবস্থানের ব্যাখ্যা দিলেন তিনি। এত কিছু ভেবে অবশ্য বলেননি হেমাঙ্গ। খানিকটা আবেগতাড়িত ভাবেই বলা। জানতেনও না যে কথাটা রেকর্ড করা হচ্ছে। বন্ধুর মান ভাঙাতে ‘সিনিক’ শব্দটার বহুরকম অর্থ বোঝালেন। আর তার সঙ্গে ‘খুচার জ্বালায়’ বাঁধলেন একটি গান,
“বন্ধু জর্জ বিনোদিয়া
কি বাঁশী বাজাইলায় বন্ধু বিন্ধাইয়া বিন্ধাইয়া
তুমি রসিকো কালিয়া
কি মধু ঝরাইতে পার হুল ফুটাইয়া”
বন্ধুকে ভালো মতোই চিনতেন তিনি। জানতেন, পুরো ব্যাপারটাই ঘটেছে মজার ছলে। দুজনেই তো একই পথের পথিক। সংগীত তাঁদের ব্রহ্মাস্ত্র, জনতার আশীর্বাদ অমরত্ব। মৃত্যুর কিছুদিন আগেও দেবব্রত বিশ্বাস বলেছিলেন তাঁকে, “আমি কিচ্ছু কমু না, জনতাই আমারে ভালবাসে, তারাই আমার কথা কইব।” তার কাছে তুচ্ছ ব্যক্তিজীবনের নিঃসঙ্গতা, দেশভাগের ব্যথা, কণ্ঠরোধ করার শত প্রচেষ্টা কিংবা আদর্শের ভেঙে পড়া। দেবব্রত বিশেষ মানে কোনো বিতর্ক নয়, বরং তিনি ‘তর্কাতীত’।
ঋণস্বীকার :
গণনাট্য পঞ্চাশ
ব্রাত্যজনের রুদ্ধসংগীত, দেবব্রত বিশ্বাস
উজান গাঙ বাইয়া, হেমাঙ্গ বিশ্বাস
Powered by Froala Editor