একটি ছোট্ট গ্রাম ভীম কোরগাঁও। গ্রামটা ছোটো, কিন্তু তার ইতিহাস অতি দীর্ঘ। ২০১৮ সালে, সেখানকার এক দলিত আন্দোলনের শতবর্ষ পূর্তির অনুষ্ঠান চলছিল। আয়োজন করা হয়েছিল একটি জনসভার। সেই জনসভা ঘিরেই তৈরি অসন্তোষ। জাতিগত দাঙ্গায় মারা গেলেন ২৮ বছরের এক যুবক। তদন্তে নামল পুলিশ। দায়ী করল জনসভার উদ্যোক্তাদেরই। কয়েকমাস পর, গ্রেপ্তার হলেন রাও। কবি ওয়ারাওয়ারা রাও। আজ অবধি মুক্তি পাননি তিনি। ভারতের ইতিহাসে, দীর্ঘতম বন্দিদশায় কাটানো কবি তিনিই…
আরও পড়ুন
ফয়েজের কবিতা কি হিন্দুত্ব-বিরোধী— বিচারে প্যানেল বসাল আইআইটি কানপুর
ভীম কোরগাঁও-এর সেই ঘটনার পর দুবছর হয়ে গেল। কারাগারে বন্দি ওয়ারাওয়ারা রাও সহ মানবাধিকারকর্মীরা। এই দুবছরে ভারতবর্ষ সাক্ষী থেকেছে অনেক রাজনৈতিক উত্থানপতনের। রাষ্ট্রের নানা নিয়মকানুন নিয়ে জমা হয়েছে অসন্তোষ। তবে এই সমস্তকিছুর মধ্যেও তাঁদের মুক্তির প্রসঙ্গটা চাপা পড়ে যায়নি। এদিকে ভীম কোরগাঁও মামলার আরেকটা পালাবদল ঘটে গেল গত মাসে। তদন্তের ভার স্থানীয় পুলিশের হাত থেকে চলে গেল কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-র হাতে। তাতে অবশ্য পার্থক্য কিছুই ঘটলো না। নিছক সন্দেহের কারণে আজও বন্দি কবি, সাহিত্যিক, বিদ্বজ্জনেরা। আর তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল নাম অবশ্যই তেলেগু সাহিত্যের অন্যতম প্রভাবশালী কবি ওয়ারাওয়ারা রাও।
আরও পড়ুন
তখনও ছাত্রাবস্থা পেরোননি জসীম উদ্দীন, বিশ্ববিদ্যালয়ে কবিতা পড়ানো শুরু হল তাঁর
ওয়ারাওয়ারা রাওয়ের মুক্তির দাবিতে একাধিকবার সোচ্চার হয়েছে দেশের মানুষ। আন্দোলনের আঁচ এসে পড়েছে শহর কলকাতাতেও। প্রেসিডেন্সি-যাদবপুরের পড়ুয়ারা রাজপথে নেমেছে একাধিকবার। আর এবার সেই আন্দোলনের পাশে এসে দাঁড়ালেন বাংলার বিশিষ্ট সাহিত্যিকরা। তাঁর মুক্তির দাবিতে শুরু হয়েছে সই সংগ্রহ। আর সেই তালিকায় প্রথম সইটি করেছেন শঙ্খ ঘোষ। এছাড়াও সই করেছেন কবি সব্যসাচী দেব, দলিত সাহিত্যিক মনোরঞ্জন ব্যাপারী সহ অনেকেই। এমনকি সামাজিক মাধ্যমের সাহায্যে এই বার্তা ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে নাগরিক সমাজের মধ্যেও।
আরও পড়ুন
কবিতাই অস্ত্র তাঁর, বিশ্বের দরবারে আদিবাসী স্বর পৌঁছে দিচ্ছেন ঝাড়খণ্ডের তরুণ কবি
ফিরে যাই দুবছর আগের ঘটনায়। ভীম কোরগাঁও-এর ঘটনা ঘটল ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। সেবছর আগস্টের ২৮ তারিখে গ্রেপ্তার হলেন ওয়ারাওয়ারা রাও। অভিযোগ, মাওবাদী সংগঠনের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ আছে। অবশ্য সরাসরি কোনো অপরাধের অভিযোগ নেই তাঁর বিরুদ্ধে। শুধু সন্দেহের বশে ১০ জন সমাজকর্মীকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। দুবছর ধরে জেলখানায় বন্দি তাঁরা।
আরও পড়ুন
‘দেশ’ পত্রিকায় বাতিল কবিতা, নজরদারি আকাশবাণীতেও – জরুরি অবস্থার শিকার শঙ্খ ঘোষ
পুলিশের খাতায় অবশ্য ওয়ারাওয়ারা রাও নতুন নাম নন। ১৯৭৩ সালে কুখ্যাত মিসা আইনে প্রথমবার গ্রেপ্তার করা হয় তাঁকে। এরপর ১৯৮৫-তে সিকন্দরবাদ ষড়যন্ত্র মামলা, তারপর ২০০৩, ২০০৫ একাধিক গণআন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার অপরাধে কারাগারে গেছেন তিনি। তেলেঙ্গানার স্বাতন্ত্র্যের দাবিতেও রাস্তায় নেমেছেন, পুলিশের হেনস্থার মুখে পড়েছেন। কিন্তু এসবের পরেও তাঁর প্রকৃত পরিচয় তিনি একজন কবি। ১৯৪০ সালে জন্ম ওয়ারাওয়ারা রাওয়ের। ১৯৬০ সালে তাঁর বয়স মাত্র কুড়ি বছর। তখন থেকেই তেলেগু সাহিত্যের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ। তাঁর কবিতার বইয়ের সংখ্যাই পনেরো। সম্পাদনা করেছেন 'বিরসম' পত্রিকা। তাঁর উদ্যোগেই তৈরি হয়েছে তেলেগু 'বিপ্লবী সাহিত্যিক' সংঘ। আর এইসবের মধ্যে দিয়েই তুলে এনেছেন ভারতবর্ষের গণআন্দোলনের ছবি। তাঁর সাহিত্যের জগতে প্রবেশই তো শ্রীকাকুলামের কৃষকদের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের প্রেক্ষাপটে।
আরও পড়ুন
কলকাতায় এলেন গালিব, তর্কে জড়ালেন অন্যান্য কবিদের সঙ্গেও
রাষ্ট্রের দমনমূলক নীতির শিকার তিনি প্রথমবার নন। আর একাও তো নন। দেশে দেশে সমস্তকালে প্রতিবাদী মানুষদের এভাবেই দমন করে এসেছে শাসক। কিন্তু রাজনীতির ঘোলাজলে মাছ ধরতে তো আসেননি ওয়ারাওয়ারা রাও-রা। তাঁদের লেখায় যেমন মানুষের জীবনের প্রতিফলন ঘটে, মানুষও তাঁদের আপন করে নিয়েছেন সবসময়। ওয়ারাওয়ারা রাওয়ের মুক্তির দাবিতে চলমান আন্দোলন সেই ঘটনাই প্রমাণ করে। আর বাংলার সাহিত্যিকদের অংশগ্রহণ এই আন্দোলনে অবশ্যই একটা আলাদা মাত্রা যোগ করে দিয়ে যায়।