মনে-মনে বলছি—‘নারদ নারদ!’ বলছি, আরেকটুক্ষণ চললে বেশ হয়! পায়ের ওপর পা তুলে উপভোগ করছি ঝগড়া। কেন-না জানি, যতই কথা-কাটাকাটি হোক, এ-সবই সাময়িক। খানিক বাদে, মাথা ঠান্ডা হলে মিটমাট হয়ে যাবে ঠিকই। ওঁরাও কি আর অত রাখঢাক রাখছেন সংসারে! জানলা-দরজা আঁটাই-বা কই!
অতএব উঁকি দিয়েছিলাম ঘরে, থুড়ি কৈলাসে(নাকি শ্মশান?)। আগেই বিয়ে হয়েছে হর-পার্বতীর। শ্বশুরবাড়ির লোকজনদের বাঁকা কথা সয়ে নিয়েছেন বৃদ্ধ শিব। পার্বতীও খুশ, তপস্যা-টপস্যা করে মনের মতো বর পেলেন শেষমেশ। কার্তিক-গণেশ জন্মে গেছে ততদিনে। তাতেও কি সংসারে শান্তি আছে! সামান্য কিছুতেই খিটিমিটি লেগে যায়। কখনো শিবের পৌরুষ আহত হয়, গোঁড়া গৃহকর্তার মতো যা-নয়-তাই বলে বসেন স্ত্রী-কে। পার্বতীও কম যান না। সুযোগমতো দু-কথা শুনিয়ে দেন তিনিও। এইসব কলহের কাহিনি বিস্তৃতভাবে ধরা রয়েছে প্রাগাধুনিক যুগের বিভিন্ন বাংলা কাব্যে-পুথিতে। কবিরাও যেন মনপ্রাণ ঢেলে উপভোগ করেছেন হর-গৌরীর কোন্দল, কিংবা কে জানে, হয়তো নিজেদের অভিজ্ঞতাই মিশিয়ে দিয়েছেন ওঁদের ঝগড়ায়।
এই যেমন দাশরথি রায়ের কাব্যে। একদিন পার্বতী বাপের বাড়ি যেতে চাইলেন। এদিকে বৌ-এর যাওয়া নিয়ে শিবের গোঁসা। বৃদ্ধ স্বামীকে একা বাড়িতে রেখে কে যায়! দীর্ঘ অভিযোগের ডালি নিয়ে হাজির শিব। কথা শোনাতেও ছাড়লেন না—
শঙ্কর কহেন বাণী, জানি হে জানি ভবানি!
চিরকাল পরকাল ভেবেছ!
পতিব্রতা নাম লয়ে সমরে উলঙ্গী হয়ে
পতিবক্ষে পদ দিয়া নেচেছ।।
সিংহ-পৃষ্ঠে আরোহণ গমন যথায় মন,
তব জ্বালায় সদা অঙ্গ জ্বলে।
তোমার জন্যে মান হরে দেবগণে ঘৃণা করে,
রমণির লাথি-খেগো বলে।।
তোমার ব্যভারে, গৌরি! লোকালয় ত্যাজ্য করি
লজ্জা পেয়ে শ্মশানে রয়েছি।
কারে জানাইব তথ্য, বুদ্ধি শুদ্ধি লোপাপত্ত,
ভেবে ভেবে পাগল হয়েছি।।
আরও পড়ুন
৭. প্রথম বাংলা সাংবাদিকতা ১৬৬৫-তেই?
বোঝাই যাচ্ছে, পার্বতী বাপের বাড়ি যেতে চাওয়ায়, আজকের ভাষায় ‘ট্রিগারড’ হয়েছেন শিব। ‘মেল ইগো’ আহত হয়েছে তাঁর। চরিত্র নিয়ে খোঁটা দিতেও ছাড়ছেন না— ‘পতিব্রতা নাম লয়ে / সমরে উলঙ্গী হয়ে / পতিবক্ষে পদ দিয়া নেচেছ।।’ (বলা বাহুল্য, এখানে পার্বতী, দুর্গা, গৌরী, কালী সকলেই অভিন্ন)। এই কীর্তি যতই ভক্তদের মনোমুগ্ধকর হোক, অন্যান্য দেবতারা আড়ালে হাসাহাসি করে এই কাণ্ড নিয়ে— ‘রমণির লাথি-খেগো বলে।’ আর এই কথা শুনেই শিব কষ্ট পান। রণোন্মত্তা কালীকে শান্ত করতে পথ আগলে শোয়া শাস্ত্রসম্মত বর্ণনা হলেও, দাশরথি রায় পড়ে মনে হয়, শিব যেন পরিস্থিতির চাপে খানিক বাধ্য হয়েই ও-কাজ করেছিলেন। মনে-মনে পুষেও রেখেছিলেন ক্ষোভ। আজ, পার্বতীর বাপের বাড়ি যাওয়ার কথায় বেরিয়ে এল সেসব গরল।
আরও পড়ুন
৬. ‘এই পুস্তক যে চুরি করিয়া লইবেন...’
শিবের কুকথা শুনে চুপ করে থাকার পাত্রী পার্বতী নন। আর-সব যদি সওয়াও যায়, শেষমেশ কিনা চরিত্র নিয়ে খোঁটা! নিকুচি করেছে অনুমতির। আমার ইচ্ছা, আমি যাব বাপের বাড়িতে। তুমি বারণ করার কে হে!
আরও পড়ুন
৫. রামপ্রসাদের বর্ণমালা-চর্চা
ক্রোধে কন ব্রহ্মময়ী, ধর্ম্মহীনা যদি হই,
তবে কেন ধর্ম্ম পানে চাই।
কে আর অনুমতি লবে, আপন ইচ্ছায় তবে,
পিতা সঙ্গে হিমালয়ে যাই।।
আরও পড়ুন
৪. দুই যুবকের প্রেম-দোল
কার্তিক-গণেশকে ডেকে নিলেন পার্বতী, রওয়ানা দেবেন এক্ষুনি। স্ত্রী-র এই রূপ দেখে সন্ত্রস্ত শিব। একটু আগেই বলা কথাগুলো গিলে নিতে চাইলেন। নরম হয়ে কাকুতি-মিনতি শুরু। ‘মৌখিকে কৌতুক কই’, আমাকে একা ফেলে যেয়ো না! পার্বতীও গলে গেলেন শিবের ওই আচরণে। পরে অবশ্য বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বাপের বাড়ি যাওয়ার অনুমতি আদায় করে নিয়েছিলেন ঠিকই!
আরও পড়ুন
৩. ভারতচন্দ্রের গা-জোয়ারি অথবা এক্সপিরিমেন্ট
রামনারায়ণের কাব্যে আবার এই ঝগড়ারই অন্য রূপ। সেখানে প্রথমে আপারহ্যান্ড নিচ্ছেন পার্বতী। শিবের সাংসারিক অবস্থা, শ্মশানবাস, দৈন্যদশা ইত্যাদি নিয়ে মন-প্রাণ ভরে কথা শোনানো—
আরও পড়ুন
২. রামানন্দের গাঁজার গান
তুমি কোন লাজে দেবের মাঝে বইস্বা পষুপতি।
সদাই পরের নারি সঙ্গে রঙ্গ কর্যা থাক যতি।।
পর বাঘছাল বেড়া কাল কণ্ঠে তো কংকাল।
এমন কোন দেবতা লগ্ন মগ্ন বাজাইঞা গাল।।
এমন কোন দেবতা কেবা কোথা ভস্ম মাখে গায়।
কোন দেবতা কেবা কোথা ভিক্ষা মাগ্যে খায়।।
ষুন সুলি সত্য বলি মিথ্যা কভূ নয়।
এমন ভূতকে লঞা নাংঙট হঞা কেবা কোথা রয়।।
আরও পড়ুন
১. সৈয়দ মর্তুজার কৃষ্ণপ্রেম
এখানে শিবের চরিত্রের দিকে আঙুল তুলছেন পার্বতী। ছাড়ছেন না অঙ্গসজ্জা, দিনযাপনের ভঙ্গিকেও। ‘সদাই পরের নারি সঙ্গে রঙ্গ কর্যাআ থাক।’ এ-অভিযোগ যে মিথ্যে, তা অবশ্য বলা চলে না। বিভিন্ন কাব্যেই আমরা দেখি, মর্ত্যে এসে শিবের চাষবাস, অন্য নারীর প্রতি আসক্তি। বাগদিনীর ছদ্মবেশে শিবকে শায়েস্তা করতে পার্বতীর মর্ত্যে যাওয়া, বাগদিনীর প্রতি শিবের কামভাব ও শেষে পার্বতীর কাছে ধরা পড়ে হেনস্থার একশেষ— শিবের কীর্তিকলাপও কিছু কম নয়। কাজেই পার্বতী যদি অন্য মেয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার অভিযোগ আনেন, ঢোঁক গেলা ছাড়া শিবের গতি নেই।
শুধু তা-ই নয়, হরি ওরফে বিষ্ণুর কথা টেনেও খোঁটা দিতে ছাড়েননি পার্বতী। হরি যে গোপকুমারীদের কাপড়চোপড় গাছের ডালে লুকিয়ে রাখতেন, লুকিয়ে স্নান দেখতেন, সে-কথাও উঠে আসছে। এমনই তো বন্ধুসঙ্গ তোমার, আবার বড়ো বড়ো বুলি মুখে! পার্বতীর এই আক্রমণে শিব খানিক হতচকিত, নরম স্বরে শুরু করলেন নিজের নালিশ। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেই একই কথা— উলঙ্গ হয়ে যুদ্ধ করা, স্বামীর বুকে পা রাখা ইত্যাদি। এর বাইরে পার্বতীকে বিদ্ধ করার মতো কিছু নেই, এটুকুই অস্ত্র শিবের।
আমি সোষানবাসি সঙ্গদুষি সদা রঙ্গভঙ্গ।
কে সে অমর অষুর ভাষুর আগে হঞাছিলা উলঙ্গ।।
তোর রন দেখি দেবতাগোলা সর্গপথে বৈস্যা।
তোমার উদাম কেষ নাংঙটা বেশ দেখ্যা মরে হাস্যা।।
যতই কোন্দল হোক, সংসারে খাবার-দাবারও তো প্রয়োজন! ভাঁড়ারের সঞ্চয় ফুরোচ্ছে একে-একে। শিবের একমাত্র উপার্জন ভিক্ষা। কিন্তু ফরমায়েশে কমতি নেই। এই চাই সেই চাই। পার্বতীই-বা এত সামলান কী করে! কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী গুছিয়ে লিখছেন শিবের সেই দাবিদাওয়া—
আজি গৌরী রান্ধিয়া দিবেন মনোমত।
নিম শিম বেগুনে রান্ধিয়া দিবে তিত।
সুকুতা শীতের কালে বড়ই মধুর।
কুষ্কাণ্ড বার্ত্তাকু দিয়া রান্ধিবে প্রচুর।।
ঘৃতে ভাজি ভজে শক্রাতে ফেলহ ফুলবড়ি।
চোঁয়া চোঁয়া করিয়া ভাজহ পলাকড়ি।।
শুধু এটুকুই নয়, শিবের পেশ করা তালিকা আরও দীর্ঘ। ছোলার ডাল, মসুর ডাল, কাঁঠালবিচি, সরষের শাক, মুগের ডাল, টক ইত্যাদি দশ রকমের ব্যাঞ্জন রাঁধতে বললেন পার্বতীকে, সঙ্গে ক্ষীরের হাঁড়িও চাই। যেন ছুটির সকাল, বাবু আয়েশ করে হেলান দিয়ে বসেছেন তক্তপোশে, আর দুপুরের মেনুর নির্দেশ দিচ্ছেন। এদিকে পার্বতী অসহায়। কোত্থেকে আসবে এতসব জিনিস? ঘরে কানাকড়িও নেই, আর বসে-বসে ফরমায়েশ করছেন উনি! মুখঝামটা দিয়ে উঠলেন পার্বতী। মুকুন্দরাম তাও রেখে-ঢেকে সুমিষ্টভাবে লিখেছেন সে-উত্তর, ভারতচন্দ্রের পার্বতী আক্রমণাত্মক। অবশ্য, সেখানে শিব শুধু খেতে চেয়েই থামেননি, পার্বতীকে আগেই শুনিয়ে দিয়েছেন দু-চার কথা—
সর্ব্বদা কোন্দল বাজে কথায় কথায়।
রস-কথা কহিতে বিরস হয়ে যায়।।
কিবা শুভক্ষণে হৈল অলক্ষণ ঘর।
খাইতে না পানু কভি পুরিয়ে উদর।।
আর আর গৃহীর গৃহিণী আছে যারা।
কতমতে স্বামীর সেবন করে তারা।।
ব্যাস, পার্বতীকে আর পায় কে! কাজের কাজে নেই, বসে-বসে এইসব অভিযোগ! আমাকে রসের কথা বলতে গেলে কিনা বিরস হয়ে যায়! অন্যরা স্বামীর সেবার করে, আর আমি কিনা অবহেলা! অনেক সয়েছি, আর নয়! এবার পার্বতীর পালা—
গুণের না দেখি সীমা রূপ ততোধিক।
বয়সে না দেখি গাছ পাথর বল্মীক।।
সম্পদের সীমা নাই বুড়া গরু পুঁজি।
রসনা কেবল কথা-সিন্দুকের কুঁজি।।
কড়া পড়িয়াছে হাতে অন্ন-বস্ত্র দিয়া।
কেন সব কটুকথা কিসের লাগিয়া।।
......
বুড়া গরু লড়া দাঁত ভাঙ্গা গাছ গাড়ু।
ঝুলি কাঁথা বাঘছাল সাপ সিদ্ধি লাড়ু।।
তখন যে ধন ছিল এখন সে ধন।
তবে মোরে অলক্ষণা কন কি কারণ।।
শিব থতমত খেয়ে যান। আক্রমণ শুরু তো করাই যায়, কিন্তু বিপরীত দিক থেকে আক্রমণ এলে বারবারই গুটিয়ে যাওয়ার পক্ষে তিনি। কী আর করার, গঞ্জনা শুনে নতমুখে বেরোলেন ভিক্ষা করতে। মাথায় উঠল সাধ-আহ্লাদ, ভালোমন্দ খাওয়ার স্বপ্ন।
রামেশ্বর ভট্টাচার্যের পার্বতী অবশ্য তত মুখরা নন। যেন খানিক মনখারাপ করেই বলে ওঠেন—
পুত্র হৈতে পিতার প্রতাপ অতিশয়।
উদর ভরিয়া অন্ন না হইলে নয়।।
নিত্য রান্ধি অন্দ্যাবধি অন্ত নাহি পাই।
বাপে পুতে খাত্যে দিতে কাকে কত চাই।।
এ যেন অভাবের সংসারে প্রত্যেক নারীরই কাহিনি। স্বামী-সন্তান অত ভাঁড়ারের টান বোঝে না। হাজারো বায়নাক্কা তাদের। পেট ভরে না-খেলে চিৎকারে ঘর মাথায় তুলবে। কীভাবে যে সব সামাল দিতে হয়, পার্বতীই জানেন!
তবে যা-ই বলুন না কেন, শিব যা মুখ করেন, পার্বতীর ক্রোধ সেই তুলনায় নস্যি। পার্বতী সংসারের খুঁটিনাটি-ভালোমন্দের খোঁজ রাখেন, হালহকিকত জানেন। শিবের অত ভাবার দায়ই নেই। একবার রাগ মাথায় চাপল তো স্ত্রী-সন্তান কাউকে কথা শোনাতে ছাড়েন না। জীবন মৈত্রেয়-র লেখায় তেমনই চণ্ড শিবের দেখা পাই আমরা—
তোমাকে বিভা করি আমার কোন দিন নাই সুখ।
আদি কথা কহিলে পাইবা বড় দুঃখ।।
যে দিন সম্বন্ধ হইল তত্ত্ব পাইনু মুই।
সে দিন হারাইল আমার ঝুলি সিয়া সুঁই।।
নিরীক্ষণ পত্র হইল যেহি দিন।
আচম্বিত হারাইল পরনের কৌপীন।।
যে দিন তোক বিভা করিয়া লইয়া আইনু ঘরে।
চৌদ্দ আটি ভাঙ্গ সেহি দিন নিল চোরে।।
যে দিন বৌভাত খাইনু নিৰ্ব্বংশিয়ার বিটি।
সে দিন হারাইনু মোর ভাঙ্গ ঘোঁটা লাঠি।।
কুড়া গেল মুখারি গেল গেল ভাঙ্গের ঝুলি।
তোর কারণে ভিক্ষা করিয়া বেড়াই খুলি খুলি।।
আর ইহার দুইটা বেটা তারা হইয়াছে মোর কাল।
কে জানিবে মোর দুঃখ গৃহের জঞ্জাল।।
গণেশের ইন্দুর আমার নিত্য কাটে ঝুলি।
প্রাতঃকালে উঠিয়া নিত্য সিয়া ফোড়া করি।।
কার্ত্তিকের ময়ূরে আমার সর্প ধরিয়া খায়।
কহ দেখি এত দুঃখ কার প্রাণে সয়।।
এই লেখায় দেখতে পাই, অভিযোগের তালিকা সাজিয়ে বসেছেন শিব। টান দিয়েছেন একেবারে গোড়া ধরে। যেদিন বিয়ের সম্বন্ধ এল, সেদিনই তাঁর ঝুলি সেলাই-এর সূচ হারায়। নতুন বউ ঘরে আনার দিন চোর এসে ভাঙ চুরি করে নেয়। বৌভাতের দিনও ঘটেছে অনর্থ। ফলে, স্ত্রী-কে ‘নির্ব্বংশিয়ার বিটি’ বলে গাল দিতেও ছাড়ছেন না। বিরক্তি উপচে পড়ছে সন্তানদের ওপরেও। বাবারা যেমন সন্তানের কোনো দোষ হলে মায়ের দিকে দায় ঠেলে দেন, শিবের আচরণও খানিকটা সেরকমই। ‘আর ইহার দুইটা বেটা তারা হইয়াছে মোর কাল।’ যেন পার্বতীরই সন্তান তারা, তাঁরই লাই পেয়ে মাথায় উঠেছে।
এদিকে, অশান্তির অন্যান্য কারণও আছে বইকি! এই যেমন, শিব মাথার জটায় গঙ্গাকে ধরে রেখেছেন। গঙ্গা তো অপর এক নারী; শিবের সঙ্গে তাঁর বসবাস দেখে ঈর্ষা ও ক্রোধে ফুঁসছেন পার্বতী। কখনো গঙ্গার সঙ্গে, কখনো আবার শিবের সঙ্গেই জড়িয়ে পড়ছেন কলহে। আমি থাকতে অন্য নারীকে জীবনে ঠাঁই দাও কীভাবে! আমার মুখটা একটুও মনে পড়লনি কো! রামকৃষ্ণ কবিচন্দ্র বড়ো সুন্দর ফুটিয়ে তুলেছেন পার্বতীর সে-অভিমান—
তুমি ভাল ব্রহ্মচারী জটার ভিতরে নারী
জানিলাঙ তোমার যতিত্ব।
স্ত্রী হইয়া গুপ্তবেশে থাকে পুরুষের কেশে
জানিলাঙ গঙ্গার সতীত্ব।।
এইসব শুনে গঙ্গাও কি আর চুপ করে থাকার পাত্রী! তিনিও শুনিয়ে দিলেন—
উত্তর করিল এই পার্ব্বতীর প্রতি।
আমি দ্বিচারিণী দুর্গা তুমি বড় সতী।
আমার সাক্ষাতে আর না বাখান কুল।
কল্পে কল্পে জানি আমি তোমার আদ্য মূল।।
ব্যাস, লেগে গেল ঝগড়া। পার্বতী বললেন, তুমিও তো ব্রহ্মার সাক্ষাতে কামুকী হয়েছ, অগ্নির সঙ্গে সঙ্গম করে গর্ভবতী! স্বামীর ঠিক নেই, আমার ঘরে এসে আমাকেই কথা শোনায়! গঙ্গার উত্তর— আর তুমি যে যক্ষের পাড়ায় নিত্য মধু পান করে বেড়াও, তার বেলা? পাড়ায়-পাড়ায় রূপ দেখিয়ে ঘোরো, সেসবও কি ভুলে গেছি! এভাবে দীর্ঘ কোন্দল চলে দুই নারীর। গঙ্গার ওপর হাতও তোলেন পার্বতী। শেষে শিব বিরক্ত হয়ে অন্যত্র চলে যান, গঙ্গারও অন্তর্ধান ঘটে। পার্বতীও অভিমানে ফুলে রওয়ানা দেন বাপের বাড়িতে।
বিজয় গুপ্ত লিখেছেন মনসার(পদ্মা) সঙ্গে পার্বতীর ঝামেলার কাহিনি। সে অবশ্য ভুল বোঝাবুঝির সূত্রেই। শিবের ঘরে ঢুকে পার্বতী দেখেন, সেখানে একটি মেয়ে বসে আছে। ব্যাস, রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে গেল পার্বতীর। তারপর—
বুকে পৃষ্ঠে মারে দেবী বজ্র চাপড়।
মারনের ঘায়ে পদ্মা করে থরথর।।
মনসা যতই বোঝান যে তিনি শিবের কন্যা, কোনো প্রণয়িনী নন, পার্বতীর বিশ্বাস হয় না কিছুতেই। বলেন— ‘মোর স্বামী নিবা তাই পাতিয়াছ ছলা।’ অনেকক্ষণ ধৈর্য ধরে রাখার পর মনসারও মাথা গেল গরম হয়ে। রেগেমেগে পার্বতীকে ছোবল দিয়ে বসলেন তিনি। অচেতন পার্বতী— মৃত্যুপথযাত্রী। খবর পেয়ে দৌড়ে এলেন শিব। অচৈতন্য স্ত্রী-কে দেখে বিলাপ। তারপর, ধীরে ধীরে, বিষের প্রভাব কেটে জ্ঞান ফিরল তাঁর।
পনেরো শতক থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত দীর্ঘ চারশো-পাঁচশো বছর ধরে বিভিন্ন কবিরা এইসব ছবি এঁকেছেন নিজের-নিজের মতো করে। এই শিব বাঙালির নিজস্ব, পার্বতীও তা-ই। অচেনা পাঠক বিস্মিত হতে পারেন, ক্রুদ্ধও; তাতে এইসব সাহিত্যের গরিমা ম্লান হয় না একটুও। বরং আমরা গর্ব করতে পারি এই ভেবে যে, দেবত্বের সুউচ্চ আসন থেকে নামিয়ে, আমাদের পাশের বাড়ির— হয়তো-বা নিজেদের ঘরেরই একজন করে নিয়েছি তাঁদের। এইসব কলহদৃশ্য থেকে তৎকালীন সমাজ, গার্হস্থ্যজীবন, রুচি ইত্যাদি সম্পর্কে অনেক তাত্ত্বিক আলোচনা চলতে পারে, সে-প্রসঙ্গ ভিন্ন। আমরা শুধু দৃশ্যগুলি উপভোগ করি বরং। দু-পক্ষেই কুকথা-মান-অভিমান-ছেড়ে যাওয়া ইত্যাদি রয়েছে, তবে সবচেয়ে বড়ো কথা, ঝগড়াঝাঁটি শেষে আবার মিলেও গেছেন দুজন। কতদিন আর গোঁসা করে থাকা যায়! হাজার হোক, ভালোবাসা তো মরেনি রে বাবা!
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই
Powered by Froala Editor