লেখক, প্রকাশক ও প্রচ্ছদশিল্পীর বাইরেও অসংখ্য মানুষ জড়িয়ে থাকেন একেকটা বইয়ের সঙ্গে, যাঁরা উপযুক্ত সম্মান-স্বীকৃতি পান না কোনোকালেই। এমনকী মুদ্রকেরও ঠাঁই দ্বিতীয় পাতার ঠাসা-তথ্যের ভিড়েই। অবশ্য এ-রোগ আজকের নয়। ছাপাখানা আসার আগে যে-সমস্ত লিপিকর একের পর এক পুথি নিজে হাতে নকল করে পৌঁছে দিতেন পাঠকদের কাছে, তাঁদেরও কি মনে রেখেছি আমরা?
যে-কোনো পুথির থেকে আমায় বেশি টানে সেই পুথির পুষ্পিকা। ‘পুষ্পিকা’— অর্থাৎ পুথির মূল বিষয় শেষের পরের কয়েকটি পঙক্তি, যেখানে লেখা থাকে লিপিকরের নাম, সাকিন, কত সালে পুথিটি লেখা হল ইত্যাদি। সমান্তরাল এক ইতিহাস উঠে আসে একেকটি পুষ্পিকার হাত ধরে। বাংলার পুষ্পিকা-বৈচিত্র্য কম নয়, সেসব নিয়ে বইপত্রও আছে কিছু। সেখানেও লিপিকররা একপ্রকার অবহেলিতই।
একাধিক কাজের সূত্রে, বিভিন্ন সময় বেশ-কিছু পুথি পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। কখনো সরাসরি, বেশিরভাগই বইপত্রের মাধ্যমে। এখন অবধি সবচেয়ে পুরোনো কোন পুথি হাতে নিয়ে দেখেছি? পুষ্পিকায় লেখা ছিল কাল— ‘সন ১০৮৯ সাল মাহ আষাঢ়।। শকাব্দাহ ১৬০৪।।’ অর্থাৎ, ইংরাজি ১৬৮২ সাল। পুথির মালিক হরিরাম দেবশর্ম্মা। সংস্কৃত পুথি—রামায়ণ, লিপিকরের নাম নেই। আবার, আরেক জায়গায় পেয়েছিলাম ‘সিদ্ধিনাম’ পুথি, লিপিকর জয়ন্তীপুরের লালমোহন অধিকারী। রচনাসাল অনুল্লিখিত। আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহে রয়েছে ১৭০৯ শকাব্দের একটি ‘দশকর্ম্মপদ্ধতি’, বিনোদরামশর্ম্মণ রচিত। পুষ্পিকা না-থাকলে এসব খুঁটিনাটি জানাও যেত না।
বেশিরভাগ পুষ্পিকাতেই শকাব্দের উল্লেখ, যা থেকে সহজে ইংরাজি সাল গণনা করে নিতে পারি আমরা। বাংলা সন থাকলেই-বা অসুবিধা কী! কোনো-কোনো পুষ্পিকায় উল্লেখ থাকে উভয়েরই। রয়েছে শকাব্দ ছাড়া অন্যান্য সালও— ত্রিপুরাব্দ, মল্লাব্দ, গৌরাব্দ, হিজরি ইত্যাদি। উনিশ শতকে পৌঁছে খ্রিস্টাব্দও লেখা হয়েছে কোথাও-কোথাও। সঙ্গে সাং—সাকিন। খেয়াল করলে দেখবেন, আগেকার দিনের প্রায় প্রত্যেক হাতে-লেখা পুথিতেই— বাংলা হোক বা সংস্কৃত— অনুস্বার-টি অর্ধেক লেখা হত। অর্থাৎ, ং-এর শুধুমাত্র মাথার গোল্লাটি লেখা, নিচের ল্যাজটি অনুপস্থিত।
আরও পড়ুন
৫. রামপ্রসাদের বর্ণমালা-চর্চা
এইসব প্যাঁচ-পয়জার ছেড়ে বরং একটি পুষ্পিকায় মন দিই। বাংলা ১২৪৭ সনের ৯ ফাল্গুন অর্থাৎ ১৮৪১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে লেখা এই পুথি। নাম ‘যমসংবাদ’। পুষ্পিকায় রয়েছে—
আরও পড়ুন
৪. দুই যুবকের প্রেম-দোল
‘ইতি জম শংবাদ শমাপ্ত। জথাদিষ্টং তথা লিখিতং লেখক দোষ নাস্তী ইতি সন ১২৪৭ সাল তারিখ ৯ ফাল্গুন সিব চতুর্দ্দশির দিবস বারে ষুক্রবার বেলা আন্দাজি ডেড় প্রহরের মোধ্যে পুস্তক উত্তরমুখী তাতঘরের পরচালাতে রাস্তার ধারের সরানের নিকটে হাটের দক্ষিণ দিকে এই পুস্তক সমাপ্ত হইল। এই পুস্তক শৌমজুকুর অনেক দুখে বলরাম নাথ যুগীর বাটী হইতে আনিয়া লেখিবেন। এই পুস্তক যে চুরি করিয়া লইবেন...। ইতি সন ১২৪৭ সাল তারিখ ৯ ফাল্গুন সাং রামানন্দ বাটী পরগনে মৌজে সাকিম পাঁচথোপী।’
আরও পড়ুন
৩. ভারতচন্দ্রের গা-জোয়ারি অথবা এক্সপিরিমেন্ট
দীর্ঘ পুস্পিকা-বিবরণীর কারণে, উদাহরণ হিসেবে এটি উদ্ধৃত করলাম। লিপিকরের নাম নেই। দেখা যাচ্ছে, পাঁচথোপী(পাঁচথুপী)-র রামানন্দ বাটীতে লেখা হচ্ছে পুথিটি। রামানন্দই কি লিপিকর? নিশ্চিত হওয়া মুশকিল। সে-আমলে অনেক লিপিকরই আত্মরক্ষার্থে এই বাক্য লিখতেন— ‘যথা দ্রষ্টং তথা লিখিতং লেখক দোষ নাস্তি’ অর্থাৎ যা দেখলাম তা-ই লিখলাম, লেখকের কোনো দোষ নেই বাপু। লিপিকর যে পুথি থেকে নকল করছেন, সেখানে ভুল থাকলে এই পুথিতেও ভুল থাকবে। পুথিটি যেদিন শেষ হয়, সেদিন ছিল শুক্রবার, শিব চতুর্দশী। দেড় প্রহর অর্থাৎ সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ লেখা ফুরোয়। লিপিকর কোথায় বসে লিখেছেন, সে হদিশও দেওয়া রয়েছে— ‘উত্তরমুখী তাতঘরের পরচালাতে রাস্তার ধারের সরানের নিকটে হাটের দক্ষিণ দিকে’। জনৈক বলরাম নাথ যুগীর বাড়ি থেকে যমসংবাদ এনে নকল করা হয়েছিল।
আরও পড়ুন
২. রামানন্দের গাঁজার গান
তবে আমার সবচেয়ে কৌতূহলের বিষয় অনুচ্চারিত সাবধানবাণীটি— ‘এই পুস্তক যে চুরি করিয়া লইবেন...’। কী হবে নইলে? কোনো অভিশাপ নেমে আসবে নাকি! অবশ্য এমন হুমকি-মিশ্রিত বয়ান দেখতে পাওয়া যায় অনেক পুষ্পিকাতেই। আমার ব্যক্তিগত সংগ্রহের একটি পুথির প্রথম পাতায় দেখেছি সংস্কৃতে লেখা হুমকি। বাংলা করলে দাঁড়ায়— ‘অদীক্ষিত কেহ এ-গ্রন্থ স্পর্শ করিলে তাহার মস্তকে সূর্য ভাঙ্গিয়া পড়িবে।’ এই ডিসক্লেমার অবশ্য হাল আমলের বইয়েও সহজলভ্য— লেখক ও প্রকাশকের লিখিত অনুমতি ছাড়া বইয়ের কোনো অংশের পুনর্ব্যবহার বা প্রতিলিপি করলে আইনানুগ ব্যবস্থা... ইত্যাদি ইত্যাদি।
আরও পড়ুন
১. সৈয়দ মর্তুজার কৃষ্ণপ্রেম
যে-কোনো পুথিরই সবচেয়ে মজার অংশ পুষ্পিকার এই ডিসক্লেমারগুলি। সে-আমলে একবার পুথি চুরি হয়ে গেলে, আবার নকল করানো ছাড়া উপায় ছিল না। আজ বই চুরি হলে সেই বইয়ের আরেক কপি কিনে আনা যেতেও পারে। কিংবা হয়তো জেরক্স করে নেওয়া। দুশো বছর আগে পুথির মালিকদের সেই সুবিধে কই! ফলে কখনো মালিকের নির্দেশে, কখনো আবার স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই লিপিকররা লিখে রাখতেন এইসব হুমকি ওরফে সাবধানবাণী। কিছু-কিছু আবার যথেষ্ট আক্রমণাত্মক। এইসব সাবধানবাণী থেকে তৎকালীন সমাজের(সতেরো-আঠেরো-উনিশ শতক) গালি-গালাজ, অভিশাপ, কুসংস্কার ইত্যাদিও চিহ্নিত করা যায়। আবার, মজাও লাগে কোনো-কোনো ক্ষেত্রে।
ভদ্রসভ্য হুমকি বনাম আক্রমণাত্মক হুমকি— এ নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করা যায়। সম্পূর্ণটাই নির্ভর করে পুথির মালিক ও লিপিকরের রুচির ওপর। কিছু উদাহরণ তুলে ধরা যেতেই পারে। একটি পুথিতে দেখি ‘এই পুস্তক জিনি ছাপা করিবে তাহাকে ইষ্টদেবের দিব্য।’ পুথিটি ১২৬৪ সালের চৈত্রে অর্থাৎ ১৮৫৮ সালে নকল করা। ততদিনে ছাপার প্রযুক্তি চলে এসেছে, বইয়ের ব্যবসাও চলছে রমরমিয়ে। লিপিকর আশঙ্কিত, কেউ যদি এই পুথি ছেপে ফেলেন, তাহলে তাঁর পেটে লাথি পড়বে। বাধ্য হয়ে লিখতে হল— ইষ্টের দিব্যি, এই পুথি ছেপো না কেউ! আবার আরেক পুথিতে লেখা— ‘চারিবেদ সর সাশ্ত্র জেজন পড়িবে। সেই জন এই পুথি হরণ করিবে।।’—এ যেন ঘুরিয়ে চুরি ঠেকানো বা চোরকে আমন্ত্রণ জানানো। তুমি যদি চার বেদ ও ষড় শাস্ত্র পড়ে থাকো, তাহলেই এই পুথি চুরি করার যোগ্য তুমি, নচেৎ নয়? কীসের পুথি? —মহাভারত।
অবশ্য সব পুথির মালিক ও লিপিকর ততটা অসহিষ্ণু নন। অন্যের প্রয়োজনও বোঝেন। ফলে খানিক অনুরোধের সুরেই লেখা থাকে কোথাও-কোথাও— ‘এই পুস্তক জাহার পাট ও শবন করা আবিষ্ক হইবেক তেহ উক্ত সরকারের (লিপিকর তারাচাঁদ সরকার) বাটী হইতে লইয়া জাইয়া পাট ও শ্রবন করিয়া এই পুস্তক আপষ ফিরিয়া দিবেন।’ কেউ আবার শুধুমাত্র সাবধান করেই ছেড়ে দিচ্ছেন— ‘চৌদ্দ পত্রেতে পুস্তক হইল সারা। জত্নেতে রাখিবে জেন না হয় হারা।।’ একটি পুথির পুষ্পিকায় দেখি আশ্চর্য নির্দেশ— ‘আমাদের গামের জে চোরা থাকে তাহাকে ফাড়িতে জব্দ রাখিবে।’ অর্থাৎ আমাদের গ্রামের চোরটিকে পুলিশ ফাঁড়িতে বন্দি করে রাখবে, যাতে পুথির দিকে হাত না-বাড়াতে পারে।
এসব তো গেল ‘ভদ্র’ কিছু উদাহরণ। আক্রমণাত্মক লেখাগুলো পড়লে চোখমুখ লাল হয়ে যেতে পারে। ১৭৭৫ সালের একটা পুথিতে রয়েছে— ‘এই পুস্তক জে চুরি করিবেক পিতা ষুকর মাতা ষুকরি।’— যে এই পুথি চুরি করবে, তার বাবা শূকর ও মা শূকরী। এ-ও কিছুই নয়। আরেক পুথির লিপিকর রাইচরণ নিয়োগী ও মালিক গোপাল গরাই, সন ১৮১৭। পুষ্পিকায় লেখা— ‘এ পুস্তক জে চুরি করিবেক শে আপনার ঘরের মেয়া শর্ম্পক্র্কে জত থাকিবেক শে বেটা গোপাল গোরাঞীকে দিবেক।’ এ কী বিচিত্র হুমকি রে বাবা! যে এই পুথি চুরি করবে, সে তার ঘরের সব মেয়ে গোপাল গরাইকে(পুথির মালিক) দেবে! এমন ‘লোলুপ’ অভিশাপের পর কেউ কি চুরি করার সাহস পেয়েছিল?
একটি পুথিতে আবার মাকে ধরে টানাটানি— ‘এ পুস্তক জে চুরি করে কিংবা ছাপায়্যা রাখে তাহার মা এর উপর তাল্যাক এই দিব্যি।’—আবার সেই ছাপার প্রসঙ্গ। কোথাও আবার বোনকে কেন্দ্র করে হুমকি— ‘এ পুস্তক যে চুরি করিবেক এবং করাইবেক সে আপনার ভগ্নীকে হরণ করিবেক।’ ‘এই পুস্তক জদি হে চুরি করে মাতৃ গমন সুরাপান গুরুদারা হবে এই দিব্য থাকিল’— এমন দিব্যিও দিয়েছেন কেউ-কেউ। গো-বধ, ব্রাহ্মণবধের পাপ লাগবে কিংবা চোদ্দপুরুষ নরকগামী হবে— এসব ‘ভালোমানুষি’ অভিশাপও নেহাত কম নয়। ১৮০৯ সালের একটি পুথির পুষ্পিকায় ফের মা-কে নিয়ে কুকথা— ‘কেহএ জাদি ছড়ি করে এই পুস্তক খানি জাহার গর্ব্বে জর্ন্ম হএ সে তার রমণি।’ বোঝো ঠ্যালা!
সংস্কৃত হুমকিরও কমতি নেই। ‘জত্নেন লিখিতং গ্রন্থ তৎ চোরেতি পন্ডিত মাতা চ শূকরী স্তস্য পিতা তস্যচ গর্ধ্বব।।’— চোরের মা শূকরী ও বাবা গাধা। আরেকটি পুষ্পিকা বেশ মজার। সেখানে চোরের প্রতি হুমকি নেই, বরং অভিভাবকের মতো শাসন— ‘চুরি করি জিনি নিবেন তাহার এই বেবথা—এই গঙ্গার বন্দনা পুথি জেনি নিবে তিনি মসাএর স্থানে বেত খাবে—আর আমিহ কান মলিএ দিব এবং তাহার মাতা ধরে কিল হারিতে মারিবে।’ ১৮২৫ সালের এই পুথিতে লিপিকর যেন শাসন করছেন ‘শিশু’ চোরকে। এই পুথি যে নেবে, সে গুরুমশাই-এর কাছে বেত খাবে। আমিও তার কান মুলে দেব এবং তার মা কিল মারবে।
এতক্ষণে লিপিকরদের বানান-জ্ঞান সম্পর্কে নিশ্চয়ই ধারণা করতে পেরেছেন আপনারা! অশুদ্ধ বানানের ছড়াছড়ি সর্বত্র। শুধু পুষ্পিকা নয়, পুথির টেক্সটের মধ্যেও দেখা যায় সেসব হদিশ। এক লিপিকর পুষ্পিকায় রোয়াবের সঙ্গে আত্মরক্ষা করছেন নিজের— ‘অক্ষর দেখিয়া যেবা করে রোষ / নিশ্চয় জানিবা তার শাশুড়ীর দোষ।’ সবাই অবশ্য এমন ‘মিচকে শয়তান’ নন। কেউ-কেউ অনুরোধ করেন— ‘খণ্ড বাক্যে পাইল জে মন্দ ন বুলিবা। পণ্ডিত সকলে তায়ে সুদ্ধ করি দিবা।।’ সরাসরি আত্মসমর্পণের নজিরও দেখা যায় কোথাও— ‘এই পর্ব্ব জেকেহু পাঠ করিবেন ভুলভ্রান্তি দোষ লইবেন না কারণ আরষ চলচি আছে এবং সিক্ষ্যা নবিসের লেখা বটে—ইহা জানিআ ষুধরে পড়িবেন।’ এই বাক্যেও একাধিক শোধনের প্রয়োজন, বলাই বাহুল্য!
দেখুন দেখি, পুষ্পিকা নিয়ে সামগ্রিক আলোচনা করতে গিয়ে শেষমেষ ‘সাবধানবাণী’র খপ্পরে পড়লাম! ভালোই হল একদিক দিয়ে, কেন-না এই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বিশেষ চোখে পড়েনি। এসব পড়ার পর লিপিকরদের ‘রিগ্রেসিভ’ লাগতে পারে, কিন্তু তাঁদেরই-বা দোষ দিই কী করে! কোনো কপিরাইট-আইন ছিল না তাঁদের জন্য, তদুপরি পুথি চুরি করার জন্য থানা-পুলিশ করাও বাড়াবাড়ি। অতএব এইসব দিব্যি দেওয়াই সম্বল।
এদিকে গোড়া থেকেই যে প্রশ্ন আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে— চোরেরা কি চুরি করতে এসে শেষ পাতার পুষ্পিকা পড়ে দেখত এবং না-নিয়েই চলে যেত? নাকি নিয়ে গিয়ে পড়ার পর ফেরত দিয়ে যেত চুপিচুপি? এই মোক্ষম বিষয়টি নিয়ে কেউ আলোকপাত করেননি কেন আজ অবধি?
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই
Powered by Froala Editor