৫. রামপ্রসাদের বর্ণমালা-চর্চা

যোগীন্দ্রনাথ সরকার মশায়ের ‘হাসিখুসি’ রামপ্রসাদ পড়েননি। পড়া সম্ভবও নয়, কেন-না যোগীন্দ্রনাথের জন্মের প্রায় শতাব্দীকাল আগেই প্রয়াত তিনি। এদিকে বিশ শতকের গোড়া থেকেই, বাঙালি শিশু হাসিখুসি (প্রকাশ ১৮৯৭) পড়ে বর্ণমালার প্রাথমিক পাঠ নিচ্ছে। কেমন হত, যদি রামপ্রসাদ সেনের হাত ধরেই শুরু হত আমাদের পাঠাভ্যাস? ‘ক’— এই ব্যঞ্জনবর্ণ চিনতে ‘কাকতাড়ুয়ার মাথায় ঝুঁটি’ নয়, পড়ানো হত ‘কৃতাঞ্জলি কহে কবি কালি কপালিনি / কালরাত্রি কঙ্কালমালিনি কাত্যায়নি’?

শিশুমস্তিস্কে খুব সুগম যে হত না, বলাই বাহুল্য। যে রামপ্রসাদকে আমরা প্রাঞ্জলতার জন্যে চিনি, ‘ফরমায়েশি’ লেখা লিখতে গেলে তাঁর অসহায় ভাবও চোখ এড়াত না আমাদের। সেভাবে প্রচারিত হয়নি বলেই, রামপ্রসাদের ‘বিদ্যাসুন্দর’ বৃহত্তর পাঠকসমাজের আড়ালেই থেকে গেল। খ্যাতি পেল ভারতচন্দ্রের ‘বিদ্যাসুন্দর’। অথচ দুজনেরই রচনাকাল প্রায় একই সময়ে। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশেই এই কাজে হাত দেওয়া দুজনের। ভারতচন্দ্র যেখানে কাব্যিক সৌন্দর্য, চমক ও ‘রসসিক্ত’ দৃষ্টিভঙ্গি জড়িয়ে রাখলেন কাব্যের সর্বাঙ্গে, সেইসঙ্গে রাজার প্রশস্তিও কিছুটা, রামপ্রসাদের মন সেখানে ভক্তিচর্চাতেই। হয়তো ‘বিশুদ্ধ’ বিদ্যাসুন্দর সেটিই— জনমোহিনী নয় বলে মনঃপূত হল না পাঠকের।

তাতে রামপ্রসাদের অবশ্য কিছু যায়-আসেনি। অসংখ্য শ্যামাসঙ্গীতের মাধ্যমেই স্থান করে নিয়েছেন জনমানসে। ফরমায়েশি বিদ্যাসুন্দরটিকে তিনি নিজেও কি মনে রেখেছিলেন? এদিকে ভারতচন্দ্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িত তাঁর বিদ্যাসুন্দর। চর্চাও কম নয় তা নিয়ে। কাঠামো ও বিষয় বাঁধাধরা হওয়ায়, চলন উভয়ের ক্ষেত্রে কমবেশি একই। তবে আমাদের আলোচনা উভয়ের বিদ্যাসুন্দরের তুলনা নিয়ে নয়, বরং একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য নিয়ে। 

কাব্যের একটি অংশে নায়ক সুন্দর শ্মশানে কালীস্তুতি করছেন। এইবার রামপ্রসাদের কোর্টে বল। তবে ভারতচন্দ্রও কিছু কম যান না। লক্ষণীয়, উভয়েই এই কালীস্তুতি রচনার ক্ষেত্রে বাংলা বর্ণমালা নিয়ে খেলা করেছেন। একেকটি পদ (দুই কিংবা চার বাক্যের) একেক বর্ণমালাকে কেন্দ্র করে লেখা। শব্দগুলির আদ্যাক্ষরে মনোযোগ রাখা হয়েছে ধারাবাহিকভাবে। অন্য আদ্যাক্ষরের শব্দও আছে, কিন্তু তা নিতান্ত বাক্যগঠনের জন্য, খানিক বাধ্য হয়েই। 

আরও পড়ুন
৪. দুই যুবকের প্রেম-দোল

ভারতচন্দ্র ‘অ’ থেকে শুরু করে ‘হ’ হয়ে ‘ক্ষ’ পর্যন্ত সব-কটি বর্ণ নিয়েই যথাসাধ্য পদ বাঁধতে চেষ্টা করেছেন। প্রত্যেকটি পদের বিষয়ই কালীস্তুতি। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরি ঈ নিয়ে ভারতচন্দ্রের মুনশিয়ানা— ‘ঈশ্বরী ঈপতিজায়া ঈষদহাসিনী। / ঈদৃশী তাদৃশী নম ঈশানীঈহিনী।।’ আবার, ঝ নিয়ে লিখছেন— ‘ঝঞ্ঝারূপা ঝড়রূপে ঝাঁক গো ঝটিত। / ঝর ঝর মুণ্ডমালে ঝর্ঝরে শোণিত।।’ প্রত্যেকটি বর্ণের উদাহরণ তুলে ধরা সম্ভব নয়। তবে, আগাগোড়া প্রত্যেকটি বর্ণ নিয়ে এভাবেই দু-পঙক্তির পদ বেঁধেছেন ভারতচন্দ্র।

আরও পড়ুন
৩. ভারতচন্দ্রের গা-জোয়ারি অথবা এক্সপিরিমেন্ট

রামপ্রসাদের কীর্তিও অনেকটা এরকমই। তবে কাব্যের এই অংশে এসে, ভারতচন্দ্রকে ছাপিয়ে গিয়েছেন রামপ্রসাদ। উভয়ের ‘কালীস্তুতি’-র তুলনা করলে, ভারতচন্দ্রের কবিত্বকে খানিকটা তরলই লাগে যেন। বলে রাখা দরকার, রামপ্রসাদ কিন্তু অ থেকে শুরু করেননি। তাঁর কালীস্তুতি ‘ক’ বর্ণ থেকে শুরু। ক-এ কালী— এ-জন্যেই কি এমন নির্বাচন তাঁর?

আরও পড়ুন
২. রামানন্দের গাঁজার গান

ক থেকে হ হয়ে ক্ষ পর্যন্ত প্রত্যেকটি বর্ণ নিয়ে চারটি বাক্য অর্থাৎ দুটি করে পদ রয়েছে রামপ্রসাদের। মাঝে অবশ্য বেশ-কিছু বর্ণ— ঙ, ঞ, ণ, ষ— এড়িয়ে গিয়েছেন। সম্ভবত শব্দের আদ্যাক্ষরে এগুলি নিয়ে কী লিখবেন, ভেবে পাননি তিনি। ভারতচন্দ্র কিন্তু এই বিষয়টিকেও চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়েছিলেন। বাদ দেননি একটি বর্ণও। ‘ঙকার ভৈরব আর বিষয় ঙকার’, ‘ঞকার ঘর্ঘরধ্বনি গায়ন ঞকার’, ‘ণত্ব লয়ে জ্ঞান ণত্ব ণকারে নির্ণয়’, ‘ষড়াননমাতা ষড়রাগবিহারিণী’— ইত্যাদি পঙক্তি থেকেই ভারতচন্দ্রের চেষ্টা স্পষ্ট হয়ে যায়। তিনি বিখ্যাত কবি— কোনো বর্ণ বাদ দিয়ে হাস্যাস্পদ হতে পারেন নাকি!

আরও পড়ুন
১. সৈয়দ মর্তুজার কৃষ্ণপ্রেম

রামপ্রসাদের সেসব দায় নেই। যা স্বতঃস্ফূর্ত, তাতেই আস্থা রেখেছেন তিনি। তাতে কিছু বর্ণ যদি বলি দিতে হয়, হোক। আলোচনার স্বার্থেই, দীর্ঘ হলেও রামপ্রসাদের কালীস্তুতি ওরফে ‘বর্ণমালা-চর্চা’ সম্পূর্ণ উদ্ধৃত করলাম।

‘কৃতাঞ্জলি কহে কবি কালি কপালিনি।
কালরাত্রি কঙ্কালমালিনি কাত্যায়নি।।
কাটে কাল কোটাল কর মা প্রতিকার।
কপর্দ্দি-কামিনি কিবা করুণা তোমার।।
খ ভবে ভ্রমহ মাগো হের হর ভয়।
খগেশবাহিনি শক্তি খনিকে প্রলয়।।
খর খড়্গ করে ধরো খল খল হাসি।
খলে বধে খেচরপালিনি রক্ষ আসি।।
গিরিবরসুতা গৌরি গণেশ-জননি।
গগনবাসিনি বিদ্যা গিরিশ গৃহিণি।।
গয়া গঙ্গা গৌতমি গোমতি গোদাবরি।
গুণত্রয় গুণময়ি গোকুল শঙ্করি।।
ঘনাঘনরূপা দেবি ঘননিনাদিনি।
ঘেরিল কোটাল বেটা ঘোর শব্দ শুনি।।
ঘৃণায় ঘরণী কিন্তু ত্যজিবেক দেহ।
ঘরে ঘরে ঘোষণা কুষশ তব এহ।।
চামুন্ডা চন্ডিকা চন্ডমুন্ডবিনাশিনি।
চতুৰ্দ্দল ক্রমে চক্রভয়বিভেদিনি।।
চঞ্চল চরণ ভরে চমকিত ফণি।
চাঁচর চিকুর চারু চুম্বিত ধরণি।।
ছার রিপু ছলেতে নাশ গো শীঘ্র শিবা।
ছাওয়ালেরে ছেড়ে দেহ কর মা গো কিবা।।
ছল ছল চক্ষু ছাতি ফাটে গো বন্ধনে।
ছট্‌ ফট্ করে প্রাণ ছাড়িবে কেমনে।।
জন্মভূমি জননী জনক জনাৰ্দ্দন।
জাহ্নবী জকার পঞ্চ দুর্লভ বচন।।
জন্মিলাম কোথায় জীবনে হেথা মরি।
জয়ঙ্করি রক্ষা কর জগতঈশ্বরি।।
ঝিকিমিকি খড়্গ করে ঝেকে উঠে ঢালী।
ঝাটা পড়ে গায় ঝাট রক্ষা কর কালি।।
ঝাড়া ঝাড়ে কোটালিয়া ঝাড়া লয়্যে হাতে।
ঝিমাইতে মনগো ঝঞ্ঝনা পড়ে মাথে।।
টঙ্কার ধনুক শব্দ টোটাই না বলে।
টল টল কাঁপে দেহ টাঙ্গী মারে গলে।।
টিকী ধরো টানে টন টন করে শির।
টলে পড়ি টাটাইল সকল শরীর।।
ঠগগুলা ঠেসে ধরে ঠোঁটে এল প্রাণ।
ঠাকুরাণি ঠাকুরালি ছাড় কর ত্রাণ।।
ঠাহর না পাই ঠাট ঠাটে কত ধায়।
ঠেটা দায় ঠেকিলাম ঠাই দেহ পায়।।
ডুকরিয়া কান্দি ভয়ে বান্ধা দুটি হাত।
ডরাইয়া উঠি ডাক ছাড়ে নিশিনাথ।।
ডিঙ্গিয়া ডাইন পায় মারা যাই প্রাণে।
ডাকিনী সহিত শীঘ্র উর গো মশানে।।
ঢক্কা বাজে ঢোল বাজে ঢেকা মারে ঢালি।
ঢঙ্গ বেটা ঢেমন বলিয়া দেয় গালি।।
ঢাল খাঁড়া ঘুরিয়া ঢুলিয়া পড়ে গায়।
ঢল ঢল করে আঁখি আড়ে আড়ে চায়।।
তপস্বিনি ত্রিনয়নে তারা ত্রাণকর্ত্রি।
ত্রিপুরারি ত্রিপুরা-তারিণি জগদ্ধাত্রি।।
তব তত্ত্ব ত্রিলোচন সবে মাত্র জ্ঞাত।
তথাপি তাঁহার তরে মায়া কর কত।।
থর থর কাঁপে স্থির কর মহামায়া।
স্থান দেহ স্থলপদ্মপদে শম্ভুজায়া।।
স্থাবরজঙ্গম তোমা ভিন্ন কিছু নহে।
স্থান দিলে মোরে কৃপামই নাম রহে।।
দিগম্বরি দনুজদলনি দাক্ষায়ণি।
দুর্গতিহারিণি দুর্গে দুরিতমোচনি।।
দাসে দুঃখ দেখ মা কিরূপ দয়ামই
দাসীপুত্র দাসীর দয়িত দৈবে হই।।
ধুর্জ্জটিধামনি ধরাধরেশ কুমারি।
ধীমান ধিয়ায় ধাম ধৈর্য্য মানা করি।।
ধরণীভূষণ ধীর ধর্ম্ম কিছু নাই।
ধিক ধিক ধর‍্যে বধে বলিয়া জামাই।।
নমো নিত্য নারায়ণি নৃমুন্ডমালিনি।
নবীননীরদনীলনিন্দিতবরণি।।
নলিননির্জ্জিতে নেত্র কোণে চাও শিবে।
নতুবা নিশ্চয় নরহত্যা মা লাগিবে।।
পতিতপাবনি পরা পর্ব্বত-নন্দিনি।
প্রমথেশ-প্রিয়া পাপপুঞ্জবিনর্দ্দিনি।।
পদ্মযোনি প্রভৃতি পঙ্কজ পদভারে।
পার নাহি মহিমার পামর কি পারে।।
ফাঁপরে ফিরিয়া চাও ফণীন্দ্ররূপিণি।
ফের দিয়া ফান্দে ফেলে বধে গো জননী।।
ফট কর‍্যে কটু কহে ফিক্ ফিক্ হাসে।
ফুৎকারে কোটাল মারে রক্ষ নিজ দাসে।।
বিশ্ববিভুদারা গো বারেক দয়া কর।
বিধির বিধাতা বট বিঘ্নরাশি হর।।
বলিতে বদন এক বাক্য কব কি।
বিবেক বিদরে বুক ব্যস্ত হইয়াছি।।
ভবানি ভৈরবি ভীমা ভবের বনিতা।
ভেশ ভয়ঙ্করা রাজ্ঞি ভূধরদুহিতা।।
ভগবতি ভারতি গো ভনের ভাবিনি।
ভক্তজনবৎসলা মা ভুবনপালিনি।।
মহেশ্বরি মহামায়া মহেশমোহিনি।
মূঢ়মতি মানব মহিমা কিবা জানি।।
মহীপতি মন্দমতি মত্ত ধনমদে।
মহিষমর্দ্দিনি মাগো স্থান দেহি পদে।।
যোগরূপা যশস্বিনি যশোদানন্দিনি।
যোগেন্দ্রযোষিতা যজ্ঞসমূলঘাতিনি।।
যুগলচরণপদ্মে যদি দেহ স্থান।
যশ থাকে যদি মা করগো পরিত্রাণ।।
রণরসে রত রমা রুক্মিণী রোহিণি।
রাক্ষাসসংহারকত্রি রাঘবরমণি।।
রঙ্গিণি রুদ্রাণি রক্ষ দক্ষিণ মশানে।
রাজা করে বধ রাখ আসিয়া আপনে।।
লহ লহ লোলজিহ্ব ললিত বদন।
লীলায় বধিলা যত দুষ্ট দৈত্যগণ।।
লক্ষিতে না পারি মাগো চরিত্র তোমার।
লক্ষ্মীরূপা ক্ষম দোষ সতেক আমার ।।
বিধিমত বিদ্যাবতী বিচারে হারিল।
বাপে না বলিয়া বিদ্যা বিরলে বরিল।।
বিপাকে বিদেশে বধে বীরসিংহ রায়।
বিরহিণী বিনোদিনী কি তার উপায়।।
শিবে শবাসনা সবশিশু শোভে কানে।
শত্রুগণে শিরে ধরি বধে গো শ্মশানে।।
শঙ্করি শরণমাত্র তোমার চরণ।
শীঘ্র শান্ত কর শ্যামা নিকট মরণ।।
সংসার-সাগরে সার সবে মাত্র তুমি।
স্মরণ লয়েছি সরসিজপদে আমি।।
সবে সুখসম্পদদায়িনি সনাতনি।
সমর্পিলা শত্রু হস্তে শিবসীমন্তিনি।।
শঙ্করসুন্দরি সত্য তব ঠাকুরালি।
সুন্দর শ্বশুরপুরে সারা হয় কালি।।
হত্যা হই হুতাশে হিংসার তুমি মূল।
হরপ্রিয়ে হৈমবতি হও অনুকূল।।
হা করিয়া হান হান কাট কাট ডাকে।
হুঙ্কারে হিয়া ফাটে পড়্যেছি বিপাকে।।
ক্ষীণ দেখি ক্ষিতিপতি ক্ষমা নাহি করে।
ক্ষেমঙ্করি ক্ষুদ্র দোষে ক্ষয় করে মোরে।।
ক্ষণে ক্ষণে ক্ষোভ পাই ক্ষুণ্ণ মন সদা।
ক্ষপা দিবা জ্ঞান নাহি ক্ষম মা শারদা।।
শ্রীকবিরঞ্জন কহে কালি কৃপামই।
আমি তুয়া দাসদাস দাসীপুত্র হই।।’

রামপ্রসাদ যে বানান লিখেছিলেন, তা-ই অবিকৃত রইল এখানে। তবে আমার কৌতূহল অন্য। দুই কবিই কেন কালীস্তুতিতে একই আঙ্গিক অনুসরণ করলেন? কাহিনির বাঁধাধরা গতের মতো, স্তুতিতেও কি নির্দিষ্ট কোনো আঙ্গিক ছিল? আসলে, মধ্যযুগের বাংলা কাব্যের এ এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য। বহু কবিই তাঁদের কাব্যের একটি পরিচ্ছেদ বর্ণমালার আদ্যাক্ষরগুলি দিয়ে রচনা করেছেন। বেশিরভাগ কবি চৌত্রিশটি বর্ণ দিয়ে রচনা করতেন বলে, এই আঙ্গিকটির নাম ছিল ‘চৌত্রিশাক্ষর’ ওরফে চৌতিশা। চণ্ডীমঙ্গলেও এমন চৌতিশার হদিশ পাওয়া যায়। এমনকী, ভারতচন্দ্র-রামপ্রসাদের পূর্ববর্তী কবি কৃষ্ণরাম দাসও সপ্তদশ শতকে তাঁর বিদ্যাসুন্দর(কালিকামঙ্গল)-এ চৌতিশা ব্যবহার করেছেন। রামপ্রসাদও সেই বাঁধাধরা গতেরই অনুসারী; চৌতিশা রচনার লক্ষ্যেই এমন কালীস্তুতি তাঁর। যদিও চৌত্রিশ নয়, তিরিশটি অক্ষর নিয়ে কাজ সেরেছেন তিনি। ভারতচন্দ্র আবার একধাপ এগিয়ে রচনা করেছেন ‘পঞ্চাশাক্ষর’। 

এসব খিটিমিটি আলোচনা থাক। আমি ভাবছি অন্য কথা। রামপ্রসাদ সেন— যাঁর শ্যামাসঙ্গীতের সামনে নত হয়ে রয়েছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম, ফরমায়েশি লেখায় তাঁর ‘অখ্যাতি’ সনাতন এক ভাবনার মুখে দাঁড় করিয়ে দেয় আমাদের। রামপ্রসাদ ও ভারতচন্দ্র— সমসাময়িক দুই কবিই বাংলা সাহিত্যের সম্পদ। রাজ-অনুগ্রহ পেয়েছেন দুজনেই। ভারতচন্দ্র ছিলেন সরাসরি ‘রাজকবি’, রামপ্রসাদ তা নন। ভারতচন্দ্রের মতো রাজার স্তুতিও করেননি তিনি। রামপ্রসাদের গানে যে প্রাণ ও ভক্তির যুগলবন্দি দেখা যায়, তা রয়েছে বিদ্যাসুন্দরেও। কাব্যিকতার দিক থেকেও ফেলনা নয় মোটেই। তবে, কোথাও-কোথাও তা সাধারণের বোধের অতীত। সেই তুলনায় ভারতচন্দ্রের বিদ্যাসুন্দরে ‘রস’-এর প্রাবল্য প্রচুর, ফলে, সাধারণ পাঠকও মাথায় তুলে নিয়েছে সে-লেখা। ভারতচন্দ্রও খ্যাতি পেয়েছেন বিদ্যাসুন্দরের হাত ধরে।

একজন শিল্পীর চরিত্র বোঝার ক্ষেত্রে এ এক অনন্য উদাহরণ, মনে হয়। যে কবি নিজের কবিত্বশক্তির জন্যেই সুপরিচিত, অপরের আদেশে লেখা কবিতা তাঁকে সীমাবদ্ধ করে ফেলে। ভারতচন্দ্রের মতো দক্ষ সবাই নন, যে, সেসবের মধ্যে থেকেও জন্ম দেবেন ‘মন মজানো’ কাব্য। কিংবা রামপ্রসাদ হয়তো তেমনটি চানইনি, রচনা ও বিষয়ের মধ্যেই নিবদ্ধ ছিল তাঁর দৃষ্টি। কৃষ্ণদাস কবিরাজ যেমন লিখেছিলেন— ‘ধন জন নাহি মাঁগো কবিতাসুন্দরী। শুদ্ধ ভক্তি দেহ মোরে কৃষ্ণ কৃপা করি।।’— কবিতাসুন্দরীর কাছে সেই ‘শুদ্ধ ভক্তি’ই চাওয়া রামপ্রসাদের। বাদবাকি যা হওয়ার, আপনা থেকেই হবে। হয়েওছে। ইতিহাসই তার প্রমাণ...

অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই

Powered by Froala Editor