মনে পড়ছে ‘বসন্তবিলাপ’-এর সেই দৃশ্য? মেসবাড়ির কন্যেরা গান ধরেছে দোলের দিনে। ‘দুহাতে মনের সুখে/মাখাব আবির মুখে/আজকে এই খেলাতে হারব না।’ আরতি মুখোপাধ্যায়ের অবিস্মরণীয় কণ্ঠ। ওদিকে চিন্ময় রায়-রবি ঘোষ-অনুপকুমাররা ঘুরঘুর করছেন মেসের আশেপাশে।
‘দাদার কীর্তি’র দৃশ্যটিও কি মনে পড়ে না? দোল উপলক্ষে প্রবাস থেকে ফিরেছেন শমিত ভঞ্জ— দরজায় দাঁড়িয়ে তিনি— সন্ধ্যা রায়ের লজ্জা-আনন্দ--তৃপ্তিমেশা শরীরী ভঙ্গি— শুধুমাত্র এই একটা দৃশ্যের জন্যেই তরুণ মজুমদারকে বারবার স্যালুট জানাতে পারি আমি। খানিক আগেই গানে-গানে পাড়া-প্রদক্ষিণ সারা— ‘আজ রং পিচকারি-রং দাও ছড়িয়ে/লালে লাল আবিরে মন দাও ভরিয়ে/এল রে এল রে এল হোলি এল রে/রঙে-রঙে মনপ্রাণ রাঙা হল রে।’ আমার কাছে বাংলাভাষার সেরা দোল বা হোলির গান এটিই। ‘এসো হে বন্ধু থেকো না দূরে গাও ফাগুয়ার গান’— দেখুন দিকি, লিখতে-লিখতে আনন্দে জলও চলে আসছে চোখে!
তবে আজকের কথাবার্তা এমন কয়েকটি গান নিয়ে, যেগুলির বেশিরভাগই কোনোদিন শুনিনি, ভবিষ্যতে শুনব— সে-আশাও নেই। কেন-না এই গান থুড়ি পদগুলি গ্রন্থভুক্ত হয়েই টিকে আছে। তবে সম্পূর্ণ গানও নয়, আমরা আলোচনা করব গানের বিশেষ কিছু অংশ নিয়ে। গৌর-গদাধরের দোলখেলা।
পড়ুন প্রথম পর্ব - সৈয়দ মর্তুজার কৃষ্ণপ্রেম
বাংলা ও হিন্দিতে রাধা-কৃষ্ণের হোলিখেলার গানের সংখ্যা নেহাত কম নয়। লিখতে-লিখতে মনে পড়ছে মহম্মদ রফির কণ্ঠে নজরুলের গান— ‘বসন্তে এ কোন কিশোর দুরন্ত/রাধারে জিনিতে এল পিচকারি হাতে।’ তবে গৌরাঙ্গ ওরফে নিমাই-এর দোলখেলার গান আমাদের মতো সাধারণ শ্রোতার কানে বিশেষ পৌঁছোয়নি। বৈষ্ণবসমাজে প্রচলিত থাকলেও থাকতে পারে, সে আলাদা কথা। তেমনই কিছু গানে চোখ বোলাতে গিয়ে, মন মজল গৌর-গদাধরের লীলায়।
পঞ্চতত্ত্বের ব্যাখ্যা ছাড়া গৌর-গদাধর জুটিকে ঠিকঠাক চেনা মুশকিল। সংক্ষেপে বলতে গেলে, বৃন্দাবনলীলার কৃষ্ণ নবদ্বীপলীলায় গৌরাঙ্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিলেন এবং রাধা গদাধর পণ্ডিত রূপে। অবশ্য পঞ্চতত্ত্বের প্রথম তত্ত্ব অর্থাৎ গৌরতত্ত্ব অনুযায়ী, গৌরাঙ্গের মধ্যে রাধা-কৃষ্ণ দুই-ই উপস্থিত। এসব তত্ত্বকথা সরিয়ে যদি গৌরাঙ্গের সমকাল অর্থাৎ ষোড়শ শতকের প্রথম দশকটিকে দেখি, কিছু কৌতূহল উঁকি দেয় মনে। গদাধর কি বহিরঙ্গে পুরুষ ও অন্তরে নারী ছিলেন? গৌরাঙ্গ-গদাধরের সম্পর্কটিকে কি ‘সমকাম’ হিসেবেও চিহ্নিত করা যায়?
আমরা দোলযাত্রার গানগুলিতে গৌর-গদাধরের যে বোঝাপড়া দেখতে পাই, তা নিছক ভক্তি বা বন্ধুত্বের নয়। প্রেম যেন অন্তঃসলিলা হয়ে বয়েই চলেছে দুজনের মধ্যে। এই যেমন, দীন কৃষ্ণদাস লিখছেন—
‘দোহে দোহে ফাগু খেলে হোরি হোরি ধ্বনি।
গদাধর সহ খেলে গোরা দ্বিজমণি।’
অবশ্য আশেপাশের অন্যান্যরা— নিত্যানন্দ, অদ্বৈত আচার্য, শ্রীবাস পণ্ডিত, মুরারি গুপ্ত প্রমুখও খেলায় মাতোয়ারা। ‘ক্ষণে গালি ক্ষণে কেলি প্রেমে মাতোয়াল।’ এ যেন একদল ছেলে-বুড়ো দোলের দিন পথে নেমেছে, পরস্পরকে আবির মাখাতে-মাখাতে হুল্লোড় চলছে পথে। নিছক খেলাই নয়, ছেলেপুলেদের স্বভাববশত ‘গালি’ও চলে আসছে মুখে। তবে এই পরিবেশের মধ্যেও দুজন যেন কিছুটা আলাদা— গদাধর সহ খেলে গোরা দ্বিজমণি।’ ভিড়ের মধ্যেও নিজস্ব গণ্ডি তৈরি করে নিয়েছেন তাঁরা।
পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব - রামানন্দের গাঁজার গান
এই নিজস্ব গণ্ডির আভাস পাই শিবানন্দ সেনের পদেও—
‘হোলি খেলত গৌরকিশোর।
রসবতী নারী গদাধর কোর।।
স্বেদবিন্দু মুখে পুলক শরীর।
ভাবভরে গলতহি নয়নে নীর।’
পাঠক, আপনি গদাধরের আগে ‘রসবতী নারী’ শব্দদুটি নিশ্চয়ই এড়িয়ে যাননি! গৌরকিশোর অর্থাৎ গৌরাঙ্গের কোলে অধিষ্ঠিতা গদাধর। হোলি খেলছেন দুজনে। মুখে বিন্দু-বিন্দু ঘাম, শরীরে পুলক। কখনো ভাবাবেশে গলে যাচ্ছেন, কখনো আবার চোখে জল। প্রচ্ছন্নে কামের ইঙ্গিত। শিবানন্দ সেন ছিলেন গৌর-পার্ষদ, নিমাই-এর নবদ্বীপলীলা প্রত্যক্ষ করেছেন তিনি। ফলে তাঁর লেখা পদে বাস্তবের প্রতিফলন আশা করা অন্যায় নয়।
আমরা দোলের দিন কিশোর-কিশোরীর রংখেলা নিয়ে যে রোম্যান্টিকতা করি— নিষিদ্ধ স্পর্শের শিহরণ— রঙের অজুহাতে একবার ছুঁতে পারা— গৌর-গদাধরের সম্পর্কও কি তেমনই? পরস্পরকে রং মাখিয়ে দেওয়ার পর, যখন প্রাথমিক সংকোচ ঘুচে গেছে, গৌরাঙ্গের কোলে বসেছেন গদাধর। রংমাখা মুখে ঘাম, শরীরে কৌতূহল— না-জানি কী হবে এরপর! দুরুদুরু-বুকের এই মুহূর্তগুলোই তুলে ধরেছেন শিবানন্দ। সঙ্গে, ভণিতায় লিখতে ভোলেননি— ‘শিবানন্দ কহে পহুঁ শুনি রসবাণী।/যাঁহা পহুঁ গদাধর তাঁহা রসখনি।।’ যেখানে প্রভু(গৌরাঙ্গ) ও গদাধর, সেখানেই রসখনি। এ-রস নিছক ভাবরস নয়, প্রেমরসও বটে।
এদিকে মনোহর দাসের পদে দেখি, গৌরাঙ্গের অন্যান্য পার্ষদরা গৌর-গদাধর সম্পর্ককে অত্যন্ত সহজভাবেই নিয়েছেন। সেবার দোলের দিন, নদীর পাড়ে দুই দলে ভাগ হয়ে চলছে খেলা। একদলের প্রধান গৌরাঙ্গ, অন্যদলের গদাধর। নারী-পুরুষে যেমন খেলা হয় আরকি! গদাধরের দলে রয়েছেন স্বরূপ দামোদর, বাসু ঘোষ, গোবিন্দ ঘোষ প্রমুখ। আর গৌরাঙ্গের দিকে গৌরীদাস পণ্ডিত-সহ অন্যরা। প্রথমে গৌরীদাসের দল চন্দনকাঠের পিচকারিতে রং ভরে গদাধরের শরীরে ছিটোয়— ‘গৌরীদাস আদি করি/চন্দন পিচকাভরি/গদাধর অঙ্গে দেয় পেলি।’ বদলা নিতে এবার এগোলেন স্বরূপ দামোদরও— ‘স্বরূপ নিজগণ সাথে/আবীর লইয়া হাতে/সঘনে পেলায় গোরা-গায়।’
খেলার শেষে শুরু খুনসুটি। গৌরীদাসের দাবি, জিতেছে তাঁদের দলই— ‘গৌরীদাস খেলি খেলি/গৌরাঙ্গ জিতল বলি/করতালি দিয়া আগে ধায়।’ এতে আবার স্বরূপের গোঁসা হয়। প্রতিবাদ করে বলেন—‘রুষিয়া স্বরূপ কয়/হারিলা গৌরাঙ্গরায়/জিতল আমার গদাধর।’ বাংলা বা হিন্দি সিনেমার গানে, নারী-পুরুষ দু-দলে ভাগ হয়ে যেমন খুনসুটি-ঝগড়ার দৃশ্য দেখা যায়, মনোহর দাসের পদেও ঠিক তেমন ছবি।
পড়ুন তৃতীয় পর্ব - ভারতচন্দ্রের গা-জোয়ারি অথবা এক্সপিরিমেন্ট
এর পরের পদটি গোবিন্দদাসের। পটভূমি নবদ্বীপ নয়, নীলাচল। অর্থাৎ, গৌরাঙ্গ ততদিনে সন্ন্যাসী, হয়েছেন ‘চৈতন্য’ও। তারপরও, দোলের দিনে ‘ফাগু’ ওড়ায় কমতি নেই। এমনকী, গদাধরকে দেখে মৃদু-মৃদু হাসছেনও তিনি—
‘কত কত ভাব বিথারল অঙ্গ।
নয়ন ঢুলাঢুলি প্রেমতরঙ্গ।।
হেরি গদাধর লহু লহু হাস।
সো নাহি সমুঝল গোবিন্দদাস।।’
গোবিন্দদাস প্রকাশ্যে ‘বুঝলাম না’ বলে হাত তুলে নিলেও, ভেতরে-ভেতরে লীলাটি ঠিকই বুঝেছেন। চতুরের মতো ইঙ্গিত দিয়ে থেমে গেলেন— ‘হেরি গদাধর লহু লহু হাস।’ বাকিটা যারা বোঝার, বুঝে নিক গে।
গৌরাঙ্গ-গদাধরের দোলখেলা নিয়ে যে-চারজন পদকর্তার পদ উদ্ধৃত হল, তাঁদের মধ্যে একমাত্র শিবানন্দ সেন ছাড়া সকলেই পরবর্তী সময়ের মানুষ, অর্থাৎ প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা নেই কারোরই। প্রচলিত কথা শুনে ও পঞ্চতত্ত্বের প্রভাবে গৌর-গদাধর লীলা লিখেছেন। কিন্তু শিবানন্দ সম্ভবত সেসবের প্রত্যক্ষ সাক্ষী, আর তাঁর বর্ণনাই সবচেয়ে কৌতূহলোদ্দীপক।
বসন্তে ‘ফুলদোল’ খেলার সময়ও গৌরাঙ্গের অবিচ্ছেদ্য সঙ্গী গদাধর। ‘গদাধর সঙ্গে পহুঁ করয়ে বিলাস’— লিখছেন বাসুদেব ঘোষ। দুজনার সম্পর্ক নিয়ে, পঞ্চতত্ত্বকে কেন্দ্র করে ব্যাখ্যার অভাব নেই। আমরা শুধু দোলকে কেন্দ্র করে নবদ্বীপলীলার রাধা-কৃষ্ণ ওরফে গৌর-গদাধরের প্রেমটুকুকে নিলাম। এই তত্ত্ব, সাধনমার্গ ইত্যাদির আড়ালে সত্যি-সত্যিই জাগতিক প্রেম ছিল কিনা দুজনের, তা রহস্য থাকাই ভালো। আসুন, আমরা গৌরাঙ্গের কোলে উপবিষ্ট গদাধর ও তাঁদের গাঢ় দোলখেলাটি উপভোগ করি...
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই
Powered by Froala Editor