৩. ভারতচন্দ্রের গা-জোয়ারি অথবা এক্সপিরিমেন্ট

যে-সমস্ত শব্দ বাঙালি জাতির জীবনে জলের মতো মিশে গেছে, সেটাই বাংলা শব্দ— যখনই বিতর্ক ওঠে, এ-কথা বলতে ইচ্ছে হয় আমার। নির্দিষ্ট সময় অন্তর, বিশেষত ভাষাদিবস এলেই এই এক ঝামেলা— অমুক শব্দটি বাংলা নয়— আরবি-ফারসি— ভাষাকে দূষিত করছে। তথাকথিত বুদ্ধিজীবীরাও প্রায়শই জড়িয়ে পড়েন এ-তর্কে। এদিকে শব্দের উৎস-সন্ধানে বেরোলে, প্রচুর বাংলা শব্দের মূলে পাব সংস্কৃত ভাষাটিকে। সেখান থেকেই আত্তীকৃত হয়েছে বাংলায়; ঠিক যেভাবে আরবি-ফারসি ভাষা থেকেও।

যাঁরা বাংলাভাষায় আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের বহু-ব্যবহারকে বাঁকা চোখে দেখেন, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে ভাষার ইতিহাস ও বিবর্তন সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। সেইসব বিজ্ঞবাগীশের সামনে হাজির করতে ইচ্ছে করছে রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের একটি কবিতা। দেখি তো, এই টেক্সটের সাপেক্ষে ভারতচন্দ্রের ‘বাঙালি’ পরিচয়কে কেউ চ্যালেঞ্জ করেন কিনা!

অন্ত্য-মধ্যযুগ থেকেই বাংলা সাহিত্যে আরবি-ফারসি-উর্দু শব্দের অহরহ অনুপ্রবেশ ঘটেছে। তিন-চারশো বছর আগের সেইসমস্ত কাব্য ও গানের শব্দব্যবহারকে কেউ আক্রমণ করতে চাইলে আমি নাচার। শুধু শব্দই নয়, কৃষ্ণরাম দাসের ‘রায়মঙ্গল’ সহ একাধিক কাব্যে দেখেছি ভাঙা-ভাঙা উর্দু ভাষায় লেখা ডায়লগ(বাঙালির বিদ্যেয় যতটুকু কুলোয়), তাতে আরবি-ফারসি শব্দের ভরপুর উপস্থিতি! বলাই বাহুল্য, সে-সব বক্তাদের কেউই বাঙালি নন; পরিচয়ে গাজী বা পীর অর্থাৎ ধর্মে মুসলমান, এসেছেনও বাংলার বাইরে থেকেই। তারপরও, ধর্মমাহাত্ম্য প্রচারের জন্য লেখা বাংলা কাব্যে তাঁদের বয়ান হুবহু তুলে ধরা হচ্ছে— এ কি বাংলা ভাষারই সহনশীলতার পরিচয় নয়!

পড়ুন প্রথম পর্ব - সৈয়দ মর্তুজার কৃষ্ণপ্রেম

কৃষ্ণরামের রায়মঙ্গল লেখা হয়েছিল সপ্তদশ শতকের শেষার্ধে, ১৬৮৬ খ্রিস্টাব্দে— আজ থেকে প্রায় ৩৪০ বছর আগে। সেখানে, এক ক্রোধান্বিত গাজীর কথা বলা হয়েছে, যিনি—

‘একথা ওকথা শুন্যা গাজী গোসা খান।
সাপ দিল সাধুরে সভার বিদ্যমান।।
ভাগ গীয়া বেটীচোদ এবে কিআ কর আব।
হোগা হারামজাদ খানেখারাব।।
শোস্তে হো দক্ষিণরায় এসা দাগাবাজী।
বাঁধকে লে আনেছে তবে হাম গাজী।।
কানান সেবক তোড়নে কহে কান।
শীতাব দেখনে চাই কেছাই সয়তান।।
আদিমীকু উপর রুক্তায় হররোজগাটা।
খাড়ায় মুলুক লৌটে বড়ি বড়ি পাট্টা।।’ ইত্যাদি

স্পষ্টতই, এ-ভাষা বাংলা নয়। পাঠক, আপনি এই টেক্সটে কাঁচা গালাগালির উপস্থিতি দেখে যদি ভুরু কোঁচকান, তাহলে জানিয়ে রাখি, সে-আমলের কাব্যগুলিতে খাঁটি বাংলা গালাগালির পরিমাণও কিন্তু নেহাত কম নয়! ফলে, এ-অ্যাঙ্গেলে বিশেষ সুবিধে করতে পারবেন না। তবে এ-কথা অনস্বীকার্য, বাংলা ও বাঙালি নায়কের বিপ্রতীপে অন্য বাকভঙ্গি ও চরিত্র প্রতিষ্ঠা করতেই কৃষ্ণরাম লিখেছেন এই অংশটি।

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব - রামানন্দের গাঁজার গান

ভারতচন্দ্রের প্রসঙ্গে ফিরি। সমালোচকেরা বলেন, বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগের সূচনা তাঁর হাত ধরে। ভারতচন্দ্রের সমকাল অর্থাৎ অষ্টাদশ শতাব্দীতে সরকারি ভাষা হিসেবে ব্যবহৃত হত ফারসি। সে-আমলের বহু শিক্ষিত বাঙালি বাংলা ও সংস্কৃতের পাশাপাশি ফারসি ভাষাতেও দক্ষ ছিলেন। ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল, বিদ্যাসুন্দর ইত্যাদি কাব্য বাংলা ভাষায় কিংবদন্তির পর্যায়ে পৌঁছেছে বহু শতাব্দী আগেই। এহেন ভারতচন্দ্রই আবার এমন এক কবিতা লিখেছেন, যা দেখে চমকে যেতে হয়। বাংলা-সংস্কৃত-হিন্দি-ফারসি মিলিয়ে জগাখিচুড়ি সে-ভাষা। কথা বাড়ানোর আগে, পড়ে নেওয়া যাক একবার—

‘শ্যাম হি তূ প্রাণেশ্বর, বায়দ্‌ কি গোয়দ্‌ রূ-বর,
কাতর দেখে আদর কর, কাহে মরো রোয়কে।
বক্তুং বেদং চন্দ্রমা, চূণ্‌ লালঃ চেহর-এ-মা,
ক্রোধিতপর দেও ক্ষেমা, মিট্টিমে কাহে শোয়কে।।
যদি কিঞ্চিৎ ত্বং বদসি, দর্‌ জান্‌-ই-মন্‌ আয়দ্‌ খুশী,
আমার হৃদয়ে বসি, প্রেম কর খোস্‌ হোয় কে।
ভূয় ভূয় রোরুদসি, য়াদ্‌-অৎ নমুদাঃ জাঁ কুসী,
আজ্ঞা কর মিলে বসি, ভারত ফকীরি খোয়কে।।’

পড়তে গিয়ে দাঁতকপাটি লাগার জোগাড়। কীভাবে দেখব এই কবিতাকে? এক্সপিরিমেন্ট, না পাণ্ডিত্য ফলানোর জন্য গা-জোয়ারি? তবে এমন গা-জোয়ারি দেখানোর জন্যেও যে ভাষাগুলোর প্রতি পোক্ত দখল থাকা প্রয়োজন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। বাংলা ও হিন্দি মেশানো গান তো শুনেছি অনেক আগেই, নজরুলের লেখা— ‘আলগা করো গো খোঁপার বাঁধন, দিল ওহি মেরা ফাস্‌ গ্যয়ি।’ এত অপূর্ব সৃষ্টি যে, দু-ভাষার মিশ্রণেও আবেদন ক্ষুণ্ণ হয়নি একটুও। 

ভারতচন্দ্র-কে তাঁর কিংবদন্তি সত্তা থেকে সরিয়ে এনে অগ্রজ কবি হিসেবে যদি সমালোচনা করি, স্পষ্টই বোঝা যায়, জ্ঞান জাহির করা ছাড়া এমন পাঁচমিশালি লেখার আর-কোনো কারণ থাকতে পারে না। দীনেশচন্দ্র সেন তো এই কবিতাটিকে কেন্দ্র করে ভারতচন্দ্রকে ফালাফালা করে দিয়েছেন— ‘বিদ্যার দৌড় দেখাইতে যাইয়া সংস্কৃত, ফারসী, বাঙ্গালা, হিন্দী— এই চতুর্ব্বিধ উপকরণে যে বীভৎস অবয়বের ভাষা প্রস্তুত করিয়াছিলেন তাহা যজ্ঞান্তে পুনর্জ্জীবিত দক্ষমূর্ত্তির ন্যায় উৎকট।’ বাস্তবিকই, অসংখ্য লেখায় যে প্রাণ সঞ্চারিত করেছেন ভারতচন্দ্র, তা এই কবিতায় অনুপস্থিত। একাধিক ভাষা ও শব্দের মিশ্রণেও সার্থক সাহিত্য জন্ম নিতে পারে, কিন্তু তা পরিকল্পিতভাবে করতে গেলে শুধু নির্মাণের দিকেই নজর থেকে যায়, শিল্পসম্মত হয়ে ওঠা হয় না আর। ভারতচন্দ্রের লেখাটিও সেই দোষেই দুষ্ট। বাক্যের অর্ধাংশ যখন চেনা-শোনা ভাষার জন্য বোধগম্য, তার পাশেই অনভ্যস্ত ভাষার উপস্থিতি কবিতাটির থেকে দূরে সরিয়ে নিচ্ছে পাঠককে। বস্তুত, এই লেখাটিকে ‘কবিতা’ বলা যায় কিনা, তা নিয়েও সংশয় আমার। ভাষাজ্ঞান ও নির্মাণকৌশলের বাইরে উত্তরণ ঘটেনি আদৌ।

পড়ুন প্রথম পর্ব - সৈয়দ মর্তুজার কৃষ্ণপ্রেম

তা বলে লেখাটি ফেলনাও নয়। সার্থক হোক বা না-হোক, ভারতচন্দ্র যে পরীক্ষানিরীক্ষার মধ্যে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন, সেই চেষ্টাকে সম্মান না-জানানো অন্যায়। একই কবিতার অবয়বে সংস্কৃত ও বাংলার পাশে ফারসি ও হিন্দিতে লিখে তিনি উপমহাদেশের ভাষা-ঐক্যের ইঙ্গিত দিতে চেয়েছেন— এ-অনুমানও অন্যায্য নয়। পাণ্ডিত্য জাহিরের প্রসঙ্গ তো রইলই, তার পাশে এ-ও যেন ভুলে না যাই— অন্নদামঙ্গল-রচয়িতা, মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভাকবি ভারতচন্দ্র নিজের ইমেজ ও খ্যাতির তোয়াক্কা না করে অনায়াসে মিলিয়ে দিচ্ছেন চারটি ভাষাকে। ভাষাকেন্দ্রিক ধর্ম-বিভাজন সেখানে তুচ্ছ। আর, তাঁরর সময়ে তা স্বাভাবিকও ছিল, যেহেতু আগেই বলেছি, সরকারি ভাষা হিসেবে ফারসির ব্যবহার তখন গোটা দেশজুড়েই। সেই ভাষা-ইতিহাসই রন্ধ্রে-রন্ধ্রে ঢুকে পড়েছে বর্তমান বাংলাভাষায়; শব্দ হয়ে মিশে গেছে আমাদের নৈমিত্যিক বুলিতে। 

ভারতচন্দ্রের কবিতাটির দুরূহ শব্দগুলির অর্থ ব্যাখার স্পর্ধা আমি দেখাব না। বরং মদনমোহন গোস্বামী যে অনুবাদটি করেছিলেন, তা-ই তুলে ধরা যাক—

‘শ্যাম তব প্রাণেশ্বর, বলেছে মুখের পর,
কাতরে আদর কর, বৃথা কাঁদ কেন গো।
ইন্দুনিভ মুখখানি, কায়া ফুল্ল মল্লি জিনি,
ক্রোধিতেরে ক্ষমা মানি, ভূমিশায়ী কেন গো।।
যদি কিছু কহ আসি, হৃদয় হইবে খুশী,
আমার হিয়াতে বসি, সুখে প্রেম কর গো।
পুনঃ পুনঃ কাঁদ কেনে, তব স্মৃতি প্রাণ টানে,
আজ্ঞা কর বসি মেনে, ফকীরি তেয়াগি গো।।’

রায়গুণাকরের পক্ষে এভাবে লেখা অসম্ভব ছিল না; এমনকী, পুরোটা বাংলায় লিখবেন স্থির করলে এই অনুবাদের চেয়েও শতগুণ উত্তম কবিতার জন্ম দিতে পারতেন তিনি। তারপরেও, সচেতনভাবেই বাংলায় অপ্রচলিত ফারসি ও সংস্কৃত শব্দবন্ধের ব্যবহার ঘটিয়েছেন। হাজার সমালোচনার পরেও, এই কম্মটি যে ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’, তা যেন ভুলে না যাই।

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব - রামানন্দের গাঁজার গান

তবে এই একটি কবিতাই নয়; বাংলাভাষার বাইরে খাঁটি হিন্দিতেও বেশ কিছু কবিতা রচনা করেছেন ভারতচন্দ্র। কয়েকটি পঙক্তি তুলে ধরলে মন্দ হয় না—

১। সেলাম হমারা পাঁড়ে, ধূপমেঁ তুম কাহে খাড়ে, পরেশান দেখ বড়ে, মেরি বাত ধর্‌ তো।
২। ধূম বড়া ধূম কিয়া, খানে শোনে নহীঁ দিয়া, চহুয়ার ঘের লিয়া, ফৌজ কিসী কৌরা।
৩। এক সমৈ বৃকভানু কুমারী। মাত-পিত সঙ্গ বৈঠ নিহারী।।

সংস্কৃততেও বহু পদ লিখেছেন রায়গুণাকর, সেগুলোর উল্লেখ এখানে না-করলেও চলে। বেশ বোঝা যাচ্ছে, মাতৃভাষা বাংলা তাঁর মূল ভিত্তি হলেও, অন্যান্য ভাষায় সাহিত্যরচনার দিকেও ঝোঁক ছিল তাঁর। সেসব ততটা প্রচারিত না-হলেও পরোয়া করেননি। উল্টে লিখেছেন একটি মিশ্র ভাষার কবিতা, যার উল্লেখ আগেই করেছি। আমার কৌতূহল, যাঁরা বাংলাভাষায় আরবি-ফারসি শব্দ ব্যবহারকারীদের বাঙালি বলতে রাজি নন, তাঁরা ভারতচন্দ্রের আলোচ্য কবিতাটি পড়লে কী বলবেন! তাঁকেও কি আক্রমণ করবেন, না বুঝতে শিখবেন, বাংলাভাষার জন্ম উনবিংশ শতাব্দীতে হয়নি; তার আগেও প্রবহমান ছিল এর বিচিত্র ধারা। 

ভাষাকে গড়েপিটে একটা ছাঁচে ফেললেই তা ধ্রুব হয়ে যায় না, এ-কথা যেন সেই বাঙালিরা বুঝতে পারেন!


অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই

Powered by Froala Editor

Latest News See More