যতদূর দম যায়, টান দাও ছিলিমে। তারপর, রসিয়ে-রসিয়ে ধোঁয়া ছাড়া। পাশের জনের হাতে ছিলিম চালান করে, বসে থাকা ব্যোম হয়ে। বাবার পেসাদ বলে কথা! এতটুকু অবহেলা করতে নেই যে!
তবে, টানের আগে যত্ন-আত্তির পদ্ধতিও নেহাত কম নয়। কাগজে রোল করে লিফ-টিফ— ওসব তো ছেলে-ছোকরাদের কাজ! আসল গাঁজা খেতে হয় কলকেয়। প্রথমে খাঁটি সবজে-রঙা গাঁজা রতন-কাটারি দিয়ে কেটে নেওয়া। সামান্য জল মিশিয়ে হাতের তালুতে পেষাই, মণ্ড হয় যাতে। চাও তো বিড়ি বা সিগারেটের তামাক মিশিয়ে নিতে পারো খানিক। তারপর কলকে সাজানোর পালা। কলকের ভেতরে টিকলি(পাথর-টুকরো) রেখে, তার ওপরে সেই মণ্ড চাপানো। নিচের মুখে ভালো করে জড়িয়ে নেওয়া সাফি(লাল শালু কাপড়)। পেন্নাম সেরে-টেরে, কলকের মাথায় সামান্য ছোবড়া রেখে, অগ্নিসংযোগ। সেইসঙ্গে ভেজা শালু-জড়ানো মুখে জোর টান। দমকে-দমকে উঠবে মাথার আগুন। ধোঁয়ায় ঢেকে যাবে চারপাশ। আহ্! ভোলেবাবা কি জয়—
এমন বন্ধুসঙ্গ আমারও যে হয়নি, তা নয়। সাধু-সন্নিসিদের সঙ্গেও ভাগ করেছি ছিলিম। তবে গাঁজার নেশায় ডুবিনি কোনোদিনই। তাতে কী! দেখে-শুনে বুঝে নেওয়ার পরিমাণও নেহাত কম নয়। ঘোষপাড়ার মেলায়, মধ্যরাতের শ্মশানে গাঁজায় দম দেওয়ার জন্য বালকনাথের কাকুতি-মিনতি ভুলিনি। বালকনাথ— উগ্র অঘোরী— গঞ্জিকার অধীনে এসে কী শিশু-ব্যবহার তাঁর! দেখেছি রক্তবস্ত্র-পরিহিত তান্ত্রিকের ‘তারা-তারা’ধ্বনিতে নিস্তব্ধতা বিদীর্ণ করে গঞ্জিকাসেবন। সেই প্রসাদ জুটেছে আমাদের কপালেও। মন্দ অথচ ভালো, নিষিদ্ধ অথচ জায়েজ, ওঁচা অথচ চিরন্তন— গাঁজার মতো নেশাদ্রব্য আর কই! ‘শিবের পেসাদ’ হওয়ায়, লৌকিক আভিজাত্যও নেহাত মন্দ হয়। ‘জলের নেশা’র বিপরীতে, এই শুকনো নেশা যে মজিয়ে রেখেছে কতজনকে!
রামানন্দের গানেও সেই মৌজের আভাস। কবেকার মানুষ তিনি? ইতিহাস তা লিখে রাখেনি। আঠেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধ বা উনিশ শতকের প্রথম দু-এক দশক— তার বাইরে নয়। কাছাকাছি সময়েই গজিয়ে উঠছে পক্ষীর দল— গাঁজা ও গুলির নেশায় ব্যোম কলকাতা। রামানন্দ এসব থেকে দূরে, গ্রামবাংলার মানুষ। একটি পুথির একটিমাত্র পৃষ্ঠায় তাঁর লেখা গান— আমাদের সম্বল বলতে এ-ই।
পড়ুন প্রথম পর্ব - সৈয়দ মর্তুজার কৃষ্ণপ্রেম
‘সাধু’ সাজার বাসনা ছিল না রামানন্দের। ছিল না কবি বা গীতিকার হিসেবে নিজেকে মহান করে তোলার স্বপ্নও। ভণিতার ‘রামানন্দ নাড়ায় বলে’ থেকে জানা যায়, তিনি ‘ন্যাড়া রামানন্দ’ নামে পরিচিত ছিলেন। ন্যাড়া কেন? মাথায় চুল না-থাকার জন্য, নাকি সহজিয়া বৈষ্ণবধর্মের পথিক ছিলেন তিনি? একসময় দল বেঁধে ‘নেড়া-নেড়ি’ তথা ‘নিম্নশ্রেণি’-র বৌদ্ধরা বৈষ্ণবধর্মে দীক্ষিত হন; কালক্রমে বৈষ্ণবদের একটি অংশও ‘নেড়া’ নামে পরিচিত হয়। রামানন্দ সম্ভবত সেই গোত্রেরই মানুষ ছিলেন।
‘গাঁজার গান’-এর প্রসঙ্গ উঠলে, সাম্প্রতিককালে বহুল-প্রচারিত, ঘোর-লাগা গানটিই প্রথমে মনে পড়ে— ‘গাঁজার নৌকা পাহাড়তলি যায়।’ অবশ্য শৈশবেই টিভির পর্দায় শুনে ফেলেছি গাঁজা-বিষয়ক গান। ‘যমালয়ে জীবন্ত মানুষ’, কৈলাসে প্রবেশের দৃশ্য। নন্দী-ভৃঙ্গীর চরিত্রে নৃপতি চট্টোপাধ্যায় ও তুলসী চক্রবর্তী। শ্যামল মিত্রের কণ্ঠ, পাশে ‘ভূতে’দের কোরাস। কী সেই গান? ‘এক ছিলিমে একটু আগুন, তার যে কত গুণ / একটি টানেই মাত ভোলানাথ ব্যোম ভোলানাথ...’। মাঝের অংশটুকু, সুর ও কথায় আরও নেশা-ধরানো— ‘প্রভু ছিলিম হাতে নাও, পেসাদ করে দাও / তাল তুলেছে ওই খ্যাপা নাচে তাতা থৈ / একটি টানেই মাত...’ ইত্যাদি।
পড়ুন প্রথম পর্ব - সৈয়দ মর্তুজার কৃষ্ণপ্রেম
রামানন্দের লেখা গাঁজার গান শোনার সুযোগ নেই। সন্তুষ্ট থাকতে হয় কথা পড়েই। তবে তা থেকেও তাঁর গঞ্জিকাপ্রেম বোঝা শক্ত নয়। পুথির পাতায়, গাঁজা-মাহাত্ম্য লেখার আগে, যত্ন করে ‘শ্রীহরিঃ’ লিখতে ভুলছেন না তিনি। তারপর নেশায় ডুব। গাঁজা টেনে জগৎসংসার ভুলে যাওয়া— ব্রহ্মাণ্ডই তখন নেশাড়ুর বিচরণক্ষেত্র। এই গানের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে ‘ভাঙ্গি’ অর্থাৎ ভাঙখোরের কথা। যে লোক ভাঙের নেশায় অভ্যস্ত, গাঁজায় দম দিয়ে তার মৌজ ও প্রতিক্রিয়া ফুটে উঠেছে গানে। ‘গাঁজার পাতা জলে ভাসে তাহা দেখি ভাঙ্গি হাঁসে / আর য়েক ভাঙ্গি ওর্যে বলে জাহাদ এইল মোর।’ ভাঙ সেবনের পর হাসির প্রাবল্যের কথা সকলেরই জানা। এখানে, গাঁজার পাতা জলে ভাসতে দেখে হেসে উঠছে এক ভাঙ্গি। প্রসঙ্গত, একই গাছের ফুল থেকে তৈরি হয় গাঁজা, আর পাতা থেকে ভাঙ। সে যা-ই হোক, আরেক ভাঙ্গি নেশার ঘোরে বলছে, আমার জাহাজ(জাহাদ) এসে হাজির হল। জলে ভাসমান গাঁজার পাতা তার কাছে জাহাজের মতো বিশাল হয়ে উঠেছে। সত্যিই, নেশায় কীই-না সম্ভব!
এবার প্রথম পঙক্তিতে ফিরে গেলে, নেশার প্রভাব আরও স্পষ্ট হয়। ‘মনের গৌরবেতে চিন্লি না রে অরে গাঁজাখোর।’ কলকেয় টান দিয়ে বাস্তববোধ হারিয়ে ফেলেছে নেশাড়ু। সামান্য গাঁজার পাতা নিয়েও কল্পনা করছে আকাশকুসুম। সেই কল্পলোকে উত্তরণের জন্য গাঁজাখোরের বাহন ‘মনের গৌরব’ অর্থাৎ ঘোর, যা তাকে বাস্তবজগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে।
এই বিচ্ছিন্নতার আবেশ রয়েছে গানের পরের দুটি পঙক্তিতেও। ‘ভাঙ্গা ঘরে সুঞা থাকে গগনেতে তারা দেখে / আর এক ভাঙ্গি উঠ্যা বলে বালাখানা মোর।’ আহা, গাঁজা কী মেজাজই না তৈরি করেছে ততক্ষণে! ভাঙা ঘরে শুয়ে, ভাঙা ছাদে একদৃষ্টিতে তারা-নক্ষত্রাদি দেখছে, হেলদোল নেই কোনো। আরেক ভাঙ্গি গাঁজা টেনে ভাবছে, ওই ভাঙা ঘরই তার বালাখানা অর্থাৎ দ্বিতল বাড়ি। হাজার দারিদ্র্যের মধ্যেও এমন বড়োলোকি মেজাজ নিয়ে এল নেশা, আর কী চাই মশাই!
পড়ুন প্রথম পর্ব - সৈয়দ মর্তুজার কৃষ্ণপ্রেম
চাই ঘোর। অক্ষয় হউক তাহা। ‘রামানন্দ নাড়ায় বলে এক ছিলুম গাঁজা খাইলে চক্ষে হয় ঘোর’— এক ছিলিম গাঁজাতেই ঘোর নেমে আসে চোখে। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে ভ্রমণ করা যায় সেই ঘোরে। বটেই তো, গাঁজার নেশা মানুষকে মদ্যপের মতো উত্তেজিত করে না, বরং শান্ত হয়ে বসতে শেখায়। চোখের সামনে ফুটে ওঠে অলৌকিক এক জগত, সচেতন অবস্থায় যার নাগাল পাওয়া দুঃসাধ্য।
মনের গৌরবেতে চিন্লি না রে অরে গাঁজাখোর।।
গাঁজার পাতা জলে ভাসে তাহা দেখি ভাঙ্গি হাঁসে
আর য়েক ভাঙ্গি ওর্যেে বলে জাহাদ এইল মোর।
ভাঙ্গা ঘরে সুঞা থাকে গগনেতে তারা দেখে
আর এক ভাঙ্গি উঠ্যা বলে বালাখানা মোর।
রামানন্দ নাড়ায় বলে এক ছিলুম গাঁজা খাইলে
চক্ষে হয় ঘোর।।
গানটি কি সংকেতবাহী? এ-সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না, বিশেষত সে-সময়ের দিকে তাকালে। হয়তো গাঁজা বলতে এখানে ঈশ্বরকে বোঝানো হয়েছে— ঈশ্বরসেবা করলে, তাঁর নাম জপলে বাহ্যজ্ঞানহীন দশায় পৌঁছে যায় সাধারণ মানুষও— সাধনমার্গের গূঢ় ইঙ্গিত লুকিয়ে এ-গানে? আপাতদৃষ্টিতে দেখলে, এ-ব্যাখ্যা জোর করে চাপানো। প্রত্যক্ষত গাঁজার মহিমা প্রচারই এর উদ্দেশ্য। কিন্তু রামানন্দ আরও গেঁজেল থুড়ি ঘোড়েল ছিলেন কিনা, কে জানে!
যা-ই বলুন-না কেন, গানটি কিন্তু বেশ! গাঁজার মহিমা কতদূর পর্যন্ত বিস্তৃত, তার দু-আড়াইশো বছর আগের উদাহরণ ন্যাড়া রামানন্দের এই সৃষ্টি। ভদ্রলোক আজ বিস্মৃত, কিন্তু তাঁর গানটি এখনো প্রেরণা জোগাতে পারে হাজার-হাজার নেশাড়ুকে। এই যে, আত্মপক্ষ সমর্থনের উপাদান তুলে দিলাম তাদের হাতে...
অলঙ্করণ - অমর্ত্য খামরুই
Powered by Froala Editor