দুই দেশের মাঝে দাঁড়িয়ে সম্প্রীতির গল্প বলে এই লাইব্রেরি

আর পাঁচটা লাইব্রেরির সঙ্গে এমনিতে কোনো তফাৎ নেই কানাডার হাসকেল লাইব্রেরির (Haskell Library)। ভিতরে প্রায় কুড়ি হাজার বইয়ের সম্ভার। এদিক-ওদিক ছড়িয়ে আছে কয়েকটা পড়ার টেবিল, সোফা। বই পড়ে কাটিয়ে দেওয়া যায় সারাটা দিন। ব্যতিক্রম বলতে শুধু চোখে পড়বে একটাই জিনিস। লাইব্রেরির মাঝখান দিয়ে তেরচাভাবে আঁকা আছে একটি দাগ। পরিচিত পাঠকরা খুব একটা মাথাব্যথা করে না এই নিয়ে। তবে বিদেশি পর্যটক এসে একটু অবাক হতেই পারে। পুরো ইতিহাস জেনে বড়োজোর একটা ছবি তুলে নিয়ে যায়। নয়তো আর সব কিছুই অত্যন্ত সাদামাটা হাসকেল লাইব্রেরির। 

কী সেই ইতিহাস? মাঝখানের এই দাগ আসলে আমেরিকা-কানাডার সীমান্ত। অর্থাৎ দুই দেশের মাঝখানে গড়ে উঠেছে এই লাইব্রেরি। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, সীমান্ত তৈরির দায়িত্বে থাকা মানুষদের উদ্দেশ্য নিয়ে। ঠিক কী ভেবে তাঁরা তৈরি করেছিল এরকম সীমান্তরেখা? যদিও আমেরিকার ভার্মন্ট ও কানাডার কিউবেকের মধ্যেকার সীমানা তৈরি হয় আঠারো শতকে। সে অর্থে কোনো কাঁটাতারের বেড়া ছিল না দু’দেশের মধ্যে। এদেশ থেকে ওদেশে যাতায়াত করা ছিল অত্যন্ত স্বাভাবিক ব্যাপার। এমনকি কানাডার লোকেরা চিকিৎসার জন্য আসত ভার্মন্টের হাসপাতালে। তবুও সীমান্ত মানেই বিভেদ। সেই দূরত্ব ঘোচানোর জন্যই ১৯০৫ সালে কানাডার হাসকেল পরিবার তৈরি করে গ্রন্থাগারটি। মূল উদ্যোক্তা মার্থা স্টুয়ার্ট হাসকেল ও তাঁর পুত্র হোরেস স্টুয়ার্ট হাসকেল। উদ্দেশ্য ছিল বই দিয়ে রুখে দেওয়া হবে রাষ্ট্রচিহ্নিত গণ্ডিকে।

সেভাবেই একশো বছরের বেশি সময় ধরে চলে আসছে লাইব্রেরির কাজকর্ম। মূল দরজা আর শিশুপাঠ্য বইপত্র পড়েছে আমেরিকার দিকে। আর বেশিরভাগটাই কানাডায়। ইংরেজি বইয়ের পাশাপাশি বিশাল সংকলন আছে ফরাসি গ্রন্থের। যে কারণে গ্রন্থাগারিককে সাবলীল হতে হয় দুই ভাষাতেই। সাধারণ পাঠক দু’দেশের সীমানায় বসে নিজের কাজে ব্যস্ত থাকেন বেশিরভাগ সময়। কে আমেরিকার আর কে কানাডার, এই নিয়ে কেউ প্রশ্নও করে না। 

শুধু এই লাইব্রেরি নয়, হাসকেল অপেরার সঙ্গেও ঘটেছে একই ঘটনা। ১৯০৪ সালে প্রতিষ্ঠিত অপেরা হাউজটিতে এখনও নিয়মিত অনুষ্ঠান হয়। এর দর্শকাসনের মাঝখান দিয়েও চলে গেছে সীমান্তরেখা। টিকিটের ক্ষেত্রে দু’রকম মুদ্রাই ব্যবহার করা যায় এখানে। তবে পরিস্থিতি পালটে যেতে থাকে ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর থেকে। কড়া পাহারা বসানো হয় দেশের প্রতিটি সীমান্তে। বাদ যায়নি ভার্মন্ট ও কিউবেকও। দ্রুত কাঁটাতারের বেড়া বসাতে না পারলেও অস্থায়ীভাবে কাঠ দিয়েই পার্থক্য গড়া হয় দু’দেশের মধ্যে। অবস্থা আরও খারাপ হয়ে ওঠে ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকার রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন। মেক্সিকো সীমান্তে বিরাট প্রাচীর তুলে দেওয়া ছাড়া কড়াকড়ি করা হয় সীমান্ত সংক্রান্ত নিয়মনীতিতে। যারা সীমানা ভুলে এতদিন নিজেদের প্রতিবেশী মনে করে এসেছে, দূরত্ব তৈরি হয় তাদের মধ্যে। সম্পূর্ণভাবে নষ্ট হয়ে যেতে থাকে দুই শহরের মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক। 

আরও পড়ুন
ঐতিহ্য ও প্রযুক্তির মেলবন্ধন ঘটাচ্ছে দুবাইয়ের নবনির্মিত লাইব্রেরি

ঠিক তখনই যেন সার্থক হয়ে ওঠে হাসকেল পরিবারের উদ্দেশ্য। একমাত্র লাইব্রেরি আর অপেরাটিই মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকে সম্প্রীতির চিহ্ন হিসেবে। উভয় দেশের ঐতিহাসিক স্থান হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায় কোনো কাঁটাতার বসানো যায়নি এর মধ্যে। আমেরিকার পুলিশ সর্বদা নজরে রাখলেও গতিবিধি নিয়ন্ত্রণের অধিকার নেই। ফলে বইয়ের সূত্রে দেখাসাক্ষাৎ হয় মানুষের মধ্যে। শিল্প-সাহিত্য নিয়ে জমে ওঠে আড্ডা। মাঝখানে একটা কালো সীমান্তরেখা শুয়ে থাকে হতভম্ব হয়ে। তার পক্ষে জানা সম্ভব নয় যে, বইয়ের কোনো দেশকাল হয় না। মানচিত্র দিয়ে আলাদা করা যায় না সাহিত্য-সংস্কৃতিকে। 

আরও পড়ুন
কখনও উটের পিঠে, কখনও যুদ্ধযানে— পৃথিবীর আশ্চর্য কিছু ভ্রাম্যমাণ লাইব্রেরির গল্প

Powered by Froala Editor