শীত এসে পড়েছে ঘরের দরজায়। উত্তরে বাতাসে কাঁপন ধরিয়ে দিচ্ছে মাঝেমধ্যে। আর গ্রামবাংলা মেতে উঠছে নবান্ন উৎসবে। বৈশাখ নয়, একসময় অগ্রহায়ণ মাসকেই ধরে নেওয়া হত বছরের প্রথম মাস হিসেবে। সেখান থেকেই সূত্রপাত হত বাংলা নববর্ষের। কারণ, এই সময়েই শুরু হয় ধান কাটার পর্ব। আর কত বাহার সেই সব ধানের নামের—ঝিঙাশাল, কনকচূড়, কলমা, সীতাশালী আরো কত কী! নতুনের ধানের অন্ন দিয়েই পালিত হয় ‘নবান্ন’। বৃহদ্ধর্মপুরাণেও উল্লেখ আছে এই উৎসবের।
নিছক লোকাচার নয়, নবান্ন আসলে গ্রামীণ মানুষের জীবনযাত্রার পূর্ণ প্রতিরূপ। জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকল মানুষের উৎসব। হেমন্তের দিনগুলিতে যখন সোনালি ধান মাথা দুলিয়ে সুখ-সমৃদ্ধির আহ্বান জানায়, তখনই তো শুরু হয় উদযাপনের প্রস্তুতি। ধান হয়ে ওঠে প্রতিটি ঘরের মঙ্গলময়তার প্রতীক। নতুন পোশাকে, আল্পনার কারুকার্যে আর নতুন দিনের স্বপ্নে আবহমান কাল ধরে ঐতিহ্য আর সংস্কৃতির চিহ্ন বহন করে আসছে নবান্ন উৎসব। সঙ্গে থাকে হরেকরকম খাওয়াদাওয়া। অঞ্চলভেদে সময়কাল আর রীতিনীতির সামান্য পার্থক্য ঘটলেও, মূল যোগসূত্রটা একই থেকে যায়। গ্রামে-গ্রামে আয়োজিত হয় মেলা। গানের আসরে কিংবা লোকসংস্কৃতির বিভিন্ন আঙ্গিকের চর্চায় যেন সজীব হয়ে ওঠে কয়েকশো বছর পুরনো শিকড়ের টান। আধুনিক শহুরে জীবনের ছাপ হয়তো প্রবলভাবে দাঁত ফুটিয়েছে এই সংস্কৃতির অঙ্গে, তবু মাটিকে আজও অস্বীকার করেনি নবান্ন উৎসব।
ভাবতে আশ্চর্য লাগে, যে মাটিতে নতুন ধানের আবির্ভাব উদযাপন করা হয়, সেখানে বহুবার বহুরূপে আগমন ঘটেছে দুর্ভিক্ষের। সোনালি ফসলের আশা-নিরাশায় মৃত্যু ঘটেছে লক্ষ-লক্ষ বাঙালির। মন্বন্তরের কথা যদি বাদ রাখা যায়, তাহলেও কি কোনোদিন অব্যাহতি মিলেছিল খাদ্যাভাব থেকে? মুকুন্দ চক্রবর্তীর ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের ‘গ্রন্থ-উৎপত্তির কারণ’-এ কবি লিখছেন, “সরকার হইলা কাল/ খিলভূমি লিখে লাল/ বিনা উপকারে খায় ধুতি।” অর্থাৎ কর্তৃপক্ষ থেকে অনুর্বর জমিকেও উর্বর লিখে দেওয়া হচ্ছে, মাঝখান থেকে দিতে হচ্ছে ‘ধুতি’ বা ‘ঘুষ’। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর মুকুন্দ চক্রবর্তী শেষ পর্যন্ত আশ্রয় খুঁজেছিলেন দেবী চণ্ডীর পায়ে। একইভাবে ভারতচন্দ্রের কাব্যে ঈশ্বরী পাটনী সন্তানকে দুধে-ভাতে রাখার চেয়ে বেশি কিছু চাওয়ার সাহস পাননি অন্নপূর্ণার কাছে।
বর্গি আক্রমণে তখন বিধ্বস্ত গোটা বাংলা। ‘বুলবুলি’ ইউরোপীয়রা কেড়ে নিয়ে গেছে যাবতীয় ফসল। এখন ‘খাজনা দেব কীসে?” পথে পথে ভিক্ষা করে বেড়ান মহাদেব। নোংরা পোশাক দেখে মাটির ঢেলা ছোঁড়ে বাচ্চাদের দল। আর যখন রামপ্রসাদ সেন গেয়ে ওঠেন, “নুন মেলে না আমার শাকে”, তখন ধর্মীয় ব্যাখার পাশাপাশি উঠে আসে ইংরেজ-মোঘল-স্থানীয় জমিদারদের ‘মৃগয়াক্ষেত্র’ বাংলার অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কথা। মধ্যযুগের কবিরা তবু আশ্রয় পেয়েছিলেন আরাধ্যা দেবীদের কাছে, কিন্তু ছিয়াত্তরের মন্বন্তরের এক কোটি মৃতপ্রায় মানুষ তাকিয়েছিলেন কার দিকে? তারপর ১৮০২, ১৮২৪, ১৮৩৭ ইত্যাদি সালে ‘ছোটোখাটো’ দুর্ভিক্ষ বাংলার সঙ্গ ছাড়েনি। জানতে ইচ্ছে হয়, এই সময়গুলিতে কীভাবে পালিত হত ‘নবান্ন উৎসব’? উত্তর মেলে না, গুঁড়ি মেরে এগিয়ে আসে পঞ্চাশের মন্বন্তরের কালো ছায়া।
আরও পড়ুন
দীপান্বিতা, বঙ্গের লক্ষ্মী : একটি ভিন্ন দৃষ্টিপাত
১৯৪৩-র দুর্ভিক্ষের কারণ বা ফলাফল নিয়ে বিস্তৃত আলোচনার প্রয়োজন নেই। বাংলার বুকে এক দগদগে ঘা হয়ে রয়েছে সেই মৃত্যু বিভীষিকা। ‘কার্তিকের নবান্নের দেশে’ না খেতে পেয়ে মারা গেছিল ৩৫ থেকে ৫০ লক্ষ মানুষ। একদিকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকারের নীতি, অন্যদিকে দেশীয় কালোবাজারির রমরমা। এর মাঝে পিশে মরেছিল গ্রামীণ বাঙালি। সেইদিনে এক নতুন ‘নবান্ন’-এর কথা বলেছিলেন বিজন ভট্টাচার্য। ১৯৪৪ সালের ২৪ অক্টোবর গণনাট্য সংঘের প্রযোজনায় মঞ্চস্থ হয় ‘নবান্ন’ নাটক। এর আগের ‘জবানবন্দী’ নাটকের মাথাল গ্রামের পরান মণ্ডল যেন জাতিস্মর রূপে ফিরে আসেন আমিনপুর গ্রামে। কলকাতার রাস্তায় মৃতদেহের ভিড়ের মধ্যেও বিজন ভট্টাচার্য শুনেছিলেন, “পার্কের রেলিং-এর ধারে বসে এক পুরুষ আর এক নারী তাদের ছেড়ে আসা গ্রামের গল্প করছে, নবান্নের গল্প, পুজোপার্বণের গল্প, ভাববার চেষ্টা করছে, তাদের অবর্তমানে গ্রামে তখন কী হচ্ছে?” আর তাই বোধহয় নাটকের শেষে দয়ালের মুখে শোনা যায় ‘জোর প্রতিরোধ’-এর কথা। ফেকু মিঞা, রহমৎউল্লা মেতে ওঠেন মোরগ লড়াই আর গরু দৌড়ের উৎসবে। ধান কাটা হয়ে জমা হয়েছে ধর্মগোলায়। দুর্ভিক্ষের মাটিতে দাঁড়িয়ে চলে ‘নবান্ন উৎসব’-এর প্রস্তুতি।
আরও পড়ুন
মুঠপুজো - গ্রামবাংলার যে আদিম লক্ষ্মী-আরাধনায় শুরু হয় নবান্নের মাস
শহরে তৈরি থিয়েটারের প্রসঙ্গ সরিয়ে রেখে তাকানো যেতে পারে লোকনাট্যের দিকে। কার্তিক মাসে শুরু হয়ে আলকাপ শেষ হত বৈশাখে। এটাই ছিল রীতি। বলে রাখা ভালো, আলকাপ ‘সম্রাট’ ঝাঁকসুর মৃত্যু ঘটে বিনা চিকিৎসায়, চরম দারিদ্র্যে। ঢেঁকিমঙ্গল বা ঢেঁকিচুমানো গানে থাকে লক্ষ্মীদেবীর আবাহন আর শস্য উৎপাদনের জন্য গৃহস্থের আবেদন। আর গম্ভীরাতে ‘দুঃখ প্রপীড়িত ভারতবাসীগণের উক্তি’-তে বলা হয়,
“হায় রে ভাই রে কী লড়াই রে লেগেছে জগত জুড়ে
বেঁধেছে যে রণ সব অনটন পাই না খেতে পেট ভরে।”
আবার ‘লেটো’ গানে বলা হচ্ছে, “ঘরে ঘরে লতুন চালের ভাত রে,/ আমার ঘরে লতুন চাল নাই রে।” এই দারিদ্র্য, অনাহারের মধ্যেই যুগ যুগ ধরে পালিত হয়ে আসছে ‘নবান্ন’। হয়তো অভাবের জন্যই আরো বেশি করে প্রয়োজন পড়ে উৎসবের। দেবী অন্নপূর্ণা এখানে চাল ঢেলে দেন ‘ভিখারি’ স্বামীর পাত্রে। এটাই তো আসলে চিরন্তন কামনা। মন্বন্তর-আকাল যাই আসুক না কেন, জারি থাকবে বেঁচে থাকার লড়াই। ‘নবান্ন’ বলে ভরা হাঁড়ির গল্প, বলে গরম ভাতের সুগন্ধের গল্প।
Powered by Froala Editor