হারুকি মুরাকামি। আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে নামটা সকলের কাছেই অল্পবিস্তর পরিচিত। দেশকালের গণ্ডি পেরিয়ে জাপানি লেখক ও ঔপন্যাসিকের জনপ্রিয়তা ছেয়েছে গোটা পৃথিবী-জুড়েই। যাঁরা মুরাকামির লেখার সঙ্গে পরিচিত, তাঁরা অনেকেই হয়তো লক্ষ করেছেন তাঁর গদ্যের ছত্রে ছত্রে লুকিয়ে থাকে অজস্র গানের প্রসঙ্গ। কখনও উঠে আসে ‘বিটলস’, কখনও আবার ‘দ্য ডোরস’ কিংবা ‘মাইলস ডেভিস’-এর কথা। কিন্তু বার বার কোনো দৃশ্যের চিত্রায়নের জন্য কেন গানের কাছে আশ্রয় নেন খ্যাতনামা জাপানি ঔপন্যাসিক?
‘আমি যা হতে চেয়েছিলাম, বাস্তবে তা উনিশ-বিশ হয়ে খানিকটা বদলে গিয়েছিল।’ এক সাক্ষাৎকারে একথা নিজেই জানিয়েছিলেন মুরাকামি (Haruki Murakami)। হ্যাঁ, লেখক হয়ে ওঠার আগে থেকেই তাঁর গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল গানের সঙ্গে। এমনকি শুধুমাত্র গানকে পাথেয় করেই জীবিকা নির্বাহের কথাও চিন্তাভাবনা করেছিলেন মুরাকামি।
অবাক লাগছে নিশ্চয়ই? লাগারই কথা। তবে মুরাকামির প্রথম জীবনের গল্প শুনলে স্পষ্ট হয়ে যাবে সেই ঘটনা। কলেজের গণ্ডি পেরনোর আগেই বিবাহ করেন মুরাকামি। স্বাভাবিকভাবেই সংসারের খরচ টানতে প্রয়োজন পড়েছিল চাকরির। অবশ্য চাকরি জুটলেও, খুব বেশিদিন মন টেকেনি সেখানে। স্নাতকতা শেষ করার কিছুদিনের মধ্যেই নিজেই ব্যবসা শুরু করেন মুরাকামি। কফিশপ, রেস্তোরাঁ কাম বারের ব্যবসা।
সেটা ১৯৭৪ সালের কথা। টোকিও শহরের বুকে মুরাকামি তৈরি করেছিলেন ছোট্ট একটি ক্যাফে। নাম রাখেন ‘পিটার-ক্যাট’। কিন্তু শুধুমাত্র আয়ের জন্য এই কফিশপ খোলা? বরং মুরাকামির কথায়, সারাদিন নিশ্চিন্তে যাতে গান শোনা যায় সেই জন্যই এই দোকান খুলেছিলেন তিনি। হ্যাঁ, ক্যাফে না বলে তাকে জ্যাজ-বার বলাই ভালো। কেননা সন্ধে হলেই সেখানকার পরিবেশ আন্দোলিত হয়ে উঠত জ্যাজ মিউজিকের আবহে। বেজে উঠতেন স্ট্যান গেজ কিংবা জেরি মুরিগান। বাড়িতে অপরাইট পিয়ানো ছিলই। সেটিকেও নিজের কফিশপে নিয়ে গিয়ে হাজির করলেন মুরাকামি। কাজের ফাঁকে মাঝে মাঝে টুংটাং সুর তুলতেন তিনি নিজেও।
আরও পড়ুন
ইউক্রেন সীমান্তে পিয়ানোবাদন, শান্তির বার্তা জার্মান সঙ্গীতশিল্পীর
পরবর্তীতে মুরাকামির এই জ্যাজ-বারই হয়ে উঠেছিল জাপানের তরুণ সঙ্গীতশিল্পীদের আখরা। বলতে গেলে জাপানের জ্যাজ-বারে লাইভ মিউজিকের সূত্রপাত হয়েছিল তাঁর হাত ধরেই। গান শোনাতে আসতেন বহু তরুণ শিল্পী। যাঁদের অধিকাংশই আজ বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত জাপানের সঙ্গীতমহলে।
আরও পড়ুন
অজস্র ‘আধুনিক’ গানের পরও শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে নিবেদিতপ্রাণ সন্ধ্যা
মুরাকামির এই জ্যাজ-বার দিব্যি গমগম করেই চলেছিল প্রায় ৭ বছর। এই জ্যাজ-বারে বসেই তিনি লেখা শুরু করেছিলেন তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘হিয়ার দ্য উইন্ড সিং’। তখন তাঁর বয়স ২৯। তারপর ব্যবসা বন্ধ হয়েছে। মুরাকামি ধীরে ধীরে হয়ে উঠেছেন ‘ফুলটাইম রাইটার’। শুধু অটুট রয়ে গেছে তাঁর সঙ্গে গানের সম্পর্ক। আজও নিয়ম করেই তিনি ঘুমাতে যাওয়ার আগে গান শোনেন কয়েক ঘণ্টা। সে জ্যাজই হোক কিংবা পাশ্চাত্যের রক মিউজিক। আর খুব স্বাভাবিকভাবেই সেসব গানের কলি অনেকটা অলঙ্কারের মতোই সুযোগ বুঝে ঢুকে পড়ে তাঁর লেখার ফাঁকে ফাঁকে। এমনকি মুরাকামির পছন্দের প্লে-লিস্ট নিয়ে প্রকাশিত হয়েছে একাধিক সিডিও। সে-সব গান পরিচিত ‘মুরাকামি’স লালাবাই’ বলে। গান নিয়ে তাঁর পড়াশোনাও রয়েছে বিস্তর। সঙ্গীতের বিভিন্ন দর্শন ও তত্ত্বের ওপর রয়েছে বিস্তর আধিপত্য।
আরও পড়ুন
শুধুমাত্র তাঁর বই নিয়েই আস্ত লাইব্রেরি; হারুকি মুরাকামি-কে বিরল সম্মাননা জাপানি বিশ্ববিদ্যালয়ের
মাস চারেক আগের কথা। ইউক্রেন-রুশ যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বক্তব্য রাখতে মুরাকামিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল টোকিও এফএম। না, কোনো যুদ্ধবিরোধী কবিতা শোনাননি তিনি। পাঠ করেননি নিজের কোনো লেখাও। বরং, শুনিয়েছিলেন জেমস টেইলরের ‘নেভার ডাই ইয়াং’। অকপট জানিয়েছিলেন, সঙ্গীতের ক্ষমতা নেই যুদ্ধ থামানোর। তবে গানই মানুষের মানসিকতা বদলে ফেলতে পারে। ভাবিয়ে তুলতে পারে যুদ্ধ কতটা ভয়াবহ। কবিতার ঊর্ধ্বে গিয়ে যুদ্ধের হাতিয়ার হিসাবে তাঁর এই গানকে বেছে নেওয়া থেকেই বোঝা যায়, কতটা সঙ্গীতের অনুরাগী তিনি…
Powered by Froala Editor